ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত বুলেট ট্রেন নির্মাণে প্রস্তাবিত একটি প্রকল্পের সমীক্ষা ও নকশা করানো হয়েছিল চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি চায়না রেলওয়ে ডিজাইন করপোরেশনকে (সিআরডিসি) দিয়ে। প্রকল্পে শুধু সমীক্ষা ও নকশা করতে গিয়েই ব্যয় হয়েছে শত কোটি টাকার বেশি। একপর্যায়ে ব্যয়বহুল এ প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত থেকে ‘আপাতত’ নীতিগতভাবে সরে এসেছে সরকার। এ অবস্থায়ও রেলপথটি নির্মাণ করে দিতে চাইছে সিআরডিসি। এর বিনিময়ে রেলপথটির ৮০ শতাংশ মালিকানা চাচ্ছে কোম্পানিটি। সিআরডিসির প্রস্তাবটি নিয়ে রেলওয়ের মতামত চেয়ে গত সপ্তাহে একটি চিঠি পাঠিয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। চিঠিতে রেলওয়েকে ২০ ডিসেম্বরের মধ্যে মতামত দিতে বলা হয়েছে।
ইন্দোনেশিয়ায়ও একই ধরনের একটি হাইস্পিড রেলপথ তৈরি করছে চীন। রাজধানী জাকার্তা থেকে পশ্চিম জাভার প্রাদেশিক রাজধানী বানদুং পর্যন্ত নির্মীয়মাণ রেলপথটি নির্মাণের কাজ পেয়েছে চীন ও ইন্দোনেশিয়ার মালিকানাধীন একটি জয়েন্ট ভেঞ্চার কোম্পানি। রেলপথটি থেকে অর্জিত মুনাফার ৪০ শতাংশ পাবে চীন। ‘বিল্ড ওন অপারেট ট্রান্সফার (বিওওটি)’ মডেলে নির্মীয়মাণ রেলপথটি ৫০ বছর পরিচালনার পর এর পুরো মালিকানা ইন্দোনেশিয়ার কাছে হস্তান্তর করা হবে।
কিন্তু রেলপথ মন্ত্রণালয়কে দেয়া সিআরডিসির প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইস্পিড রেলপথের পুরো মালিকানা কখনই পাবে না বাংলাদেশ। রেলপথটি তৈরি করা হবে ‘বিল্ড ওন অপারেট’ বা ‘বিওও’ মডেলে। মডেল অনুযায়ী, রেলপথটি নির্মাণের জন্য ‘বাংলাদেশ হাইস্পিড রেলওয়ে লিমিটেড’ বা ‘বিএইচএসআর’ নামে একটি কোম্পানি গঠন করা হবে। রেলপথ নির্মাণ ও তা পরিচালনার দায়িত্ব এ কোম্পানির হাতেই ন্যস্ত করা হবে। কোম্পানিতে ২০ শতাংশ শেয়ার থাকবে বাংলাদেশের। ৮০ শতাংশ শেয়ারের মালিক হবে চীন সরকারের অধীন কোম্পানি সিআরডিসি। কোম্পানিতে দুই দেশ কিছু অর্থ জোগান দেবে মূলধন হিসেবে। নির্মাণ ব্যয়ের একটি বড় অংশ সংগ্রহ করা হবে ব্যাংকঋণের মাধ্যমে। কোম্পানির শেয়ার মালিকানার ভিত্তিতে বাংলাদেশ ও চীন এর ঋণ শোধ করবে।
ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইস্পিড রেলপথ নির্মাণে ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে প্রায় ১ হাজার ১১০ কোটি ডলার। চীনের প্রস্তাব অনুযায়ী, নির্মাণ ব্যয়ের ২০ শতাংশ বা ১৬৯ কোটি ডলার দিতে হবে বাংলাদেশকে। এর মধ্যে ৩৪ কোটি ডলার মূলধন সরবরাহ করবে বাংলাদেশ সরকার। ঋণ নেয়া হবে ১৩৫ কোটি ডলার। ৮০ শতাংশ শেয়ারের হিসাবে চীন বিনিয়োগ করবে ৬৭৭ কোটি ডলার। এর মধ্যে ১৩৫ কোটি ডলার তারা মূলধন হিসেবে সরবরাহ করবে। ঋণ নেয়া হবে ৫৪২ কোটি ডলার। ঋণের সুদহার কত হবে তা প্রস্তাবিত কোম্পানি এবং ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান মিলে ঠিক করবে।
চীনের প্রস্তাব অনুযায়ী, ঢাকা-চট্টগ্রাম করিডোর নির্মাণের পরবর্তী পাঁচ বছর শতভাগ চীনা কর্মী দিয়ে রেলপথটি পরিচালনা করা হবে। একই সময়ে বাংলাদেশ থেকে একদল কর্মীকে প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হবে চীনে। ট্রেন পরিচালনায় প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করে তারা বাংলাদেশে ফেরত আসবে। ষষ্ঠ থেকে দশম বছর পর্যন্ত রেলপথটি পরিচালনার দায়িত্বে থাকা চীন ও বাংলাদেশের কর্মীর সংখ্যা সমান হবে। আর ১১ থেকে ১৫ বছর পর্যন্ত অন্তত ১০ শতাংশ চীনা কর্মী রাখা হবে। ১৬তম বছরে গিয়ে রেলপথটি শতভাগ বাংলাদেশী কর্মী দিয়ে পরিচালনা করা হবে।
গত ২ নভেম্বর রেলপথ মন্ত্রণালয়ে স্বপ্রণোদিত হয়ে প্রস্তাবটি দিয়েছে সিআরডিসি। এ প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে ২০ ডিসেম্বরের মধ্যে মতামত দেয়ার জন্য বাংলাদেশ রেলওয়েকে নির্দেশ দিয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। প্রস্তাব অনুযায়ী, জয়েন্ট ভেঞ্চার কোম্পানি ‘বিএইচএসআর’ ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইস্পিড রেলপথের নকশা প্রণয়ন, যাবতীয় কেনাকাটা ও নির্মাণকাজ করবে। পাশাপাশি রেলপথটি পরিচালনা, ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণও করবে তারা। কোম্পানি পরিচালনা করবে একটি যৌথ ব্যবস্থাপনা বোর্ড।
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর পাঠানো সিআরডিসির প্রস্তাবে বলা হয়েছে, বিপুল নির্মাণ ব্যয়ের কারণে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব (পিপিপি) কিংবা ‘বিওওটি’ মডেলে ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইস্পিড রেলপথ নির্মাণে কেউ বিনিয়োগ করবে না। এমন প্রেক্ষাপটে ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তা-বানদুং হাইস্পিড রেলপথ ‘সফলভাবে’ বাস্তবায়নের উদাহরণ দিয়ে ‘বিওও’ মডেলে বাস্তবায়নের আগ্রহের কথা জানানো হয়েছে।
প্রস্তাবে আরো বলা হয়েছে, প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় জমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসনসহ আনুষঙ্গিক কাজ করে দেবে বাংলাদেশ। পাশাপাশি প্রকল্পটির কাজ বাস্তবায়নে প্রস্তাবিত কোম্পানিকে কর ছাড় সুবিধাও দেয়া হবে।
চীন সরকারের সঙ্গে হাইস্পিড রেলপথটি নির্মাণের জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে একটি ‘ওয়ার্কিং গ্রুপ’ গঠনেরও সুপারিশ করা হয়েছে প্রস্তাবে। গ্রুপটি চীনের ‘ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রিফর্ম কমিশন’ এবং ‘চায়না স্টেট রেলওয়ে গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেড’ (চীনের সাবেক মন্ত্রণালয়)-এর সঙ্গে যোগাযোগ করবে। ‘ওয়ার্কিং গ্রুপ’কে সার্বিক সহযোগিতা করবে চায়না রেলওয়ে ডিজাইন করপোরেশন।
রেলপথ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভায়ও সম্প্রতি চীনের প্রস্তাবটি নিয়ে আলোচনা হয়। সভায় চীনের প্রস্তাবের বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেন স্থায়ী কমিটির সভাপতি এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী।
চীনের প্রস্তাবের বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক ডিএন মজুমদার বণিক বার্তাকে বলেন, ঢাকা-চট্টগ্রামের হাইস্পিড রেলপথটি বাস্তবায়ন করা নিয়ে বিভিন্ন ধরনের প্রস্তাব আমরা পাচ্ছি। প্রস্তাবগুলো পর্যালোচনা করে দেখা হচ্ছে।
ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত হাইস্পিড ট্রেন নির্মাণের জন্য ‘ঢাকা-চট্টগ্রাম ভায়া কুমিল্লা/লাকসাম দ্রুতগতির রেলপথ নির্মাণের জন্য সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ও বিশদ ডিজাইন’ নামে একটি প্রকল্প এরই মধ্যে বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। সমীক্ষাটি করতে খরচ হচ্ছে ১১৩ কোটি টাকা। সমীক্ষায় রেলপথটি নির্মাণে সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয় ১ হাজার ১৪০ কোটি ডলার।
সমীক্ষা অনুযায়ী, ২২৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এ রেলপথে একটি ট্রেন বিরতিহীনভাবে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে যেতে সময় নেবে ৫৫ মিনিট। আর বিরতি দিয়ে চললে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পৌঁছাতে সময় লাগবে ৭৩ মিনিট। দিনে হাইস্পিড রেলপথটি দিয়ে প্রায় ৫০ হাজার যাত্রী পরিবহন করা যাবে।
শামীম রাহমান