শরীফুল আলম সুমন
করোনার জাঁতাকলে পড়ে শিক্ষাঙ্গনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি খেই হারিয়েছে কিন্ডারগার্টেন (শিশুদের প্রাক-বিদ্যালয়)। অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মতো দেড় বছর ধরে কিন্ডারগার্টেনের দরজায়ও ঝুলছে তালা। এসব স্কুল পায় না সরকারি কোনো অনুদান। শিক্ষার্থীদের বেতনের মাধ্যমেই মেটাতে হয় কিন্ডারগার্টেনের বাড়িভাড়া, শিক্ষকদের বেতনসহ নানা খরচ। কিন্তু বাড়িভাড়া দিতে না পারায় অনেক কিন্ডারগার্টেন এরই মধ্যে তল্পিতল্পা গুটিয়েছে। এর অনেকগুলো আবার শিক্ষা কার্যক্রমে আর যাবেই না। এ সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। ছাত্র-ছাত্রীর খরায় শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়ে
কেউ কেউ আবার শিক্ষালয়টিকে মেস, গোডাউন বা ফ্ল্যাট হিসেবে ভাড়া দিয়েছেন। দীর্ঘদিন বেতন না পেয়ে অনেক শিক্ষক পেশা ছেড়েছেন। তাঁদের কেউ কেউ আর ফিরবেন না শিক্ষাকতায়। এমনকি অনেক শিক্ষার্থীও যুক্ত হয়েছে শিশুশ্রমে, তারা আর আসবে না কিন্ডারগার্টেনের আঙিনায়।
বাংলাদেশে কিন্ডারগার্টেন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ঐক্য পরিষদের তথ্য বলছে, দেশে কিন্ডারগার্টেনের সংখ্যা প্রায় ৬০ হাজার। এর অর্ধেকই করোনার অতিমারিতে বন্ধ রয়েছে। কেউ কেউ আবার স্কুলের বড় পরিসর ছেড়ে দিয়ে দু-এক রুমের বাসায় মালপত্র রেখে কবে আসবে সুদিন, সেই সময় গুনছেন। তবে ২০ শতাংশ (প্রায় ১০ হাজার) কিন্ডারগার্টেন আর শিক্ষা কার্যক্রমেই যাবে না।
জানা যায়, রাজধানীর মোহাম্মদপুরের নবীনগর হাউজিংয়ের ৪ নম্বর সড়কের ফুলকুঁড়ি কিন্ডারগার্টেনটি এরই মধ্যে তাদের শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ করেছে। এই স্কুলের উদ্যোক্তা বিক্রির নোটিশ দিয়েও কোনো ক্রেতা পাননি। পরে তিনি স্কুলটি বন্ধ করে দেন। রাজধানীর মাটিকাটায় আইডিয়াল পাবলিক স্কুল, জুরাইনে নলেজ হ্যাভেন আইডিয়াল স্কুল, জুরাইন আইডিয়াল স্কুল, মিরপুরে আশার আলো বিদ্যানিকেতন, সাভারের বাইপাইলে সৃজন সেন্ট্রাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, রাজধানীর কালাচাঁদপুরে লন্ডন ইন্টারন্যাশনাল মডেল একাডেমিসহ অসংখ্য স্কুল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এসব কিন্ডারগার্টেন এই বছর আর খোলার পরিকল্পনা নেই।
মোহাম্মদপুরের প্রাইম গাইডলাইন মডেল স্কুলটিও বন্ধ। এই স্কুলের পরিচালক শাহানাজ আক্তার নিপু বলেন, ‘আমার স্কুলে সোয়া ২০০ শিক্ষার্থী ছিল। বড় ক্লাসের বেশির ভাগ বাচ্চাই কাজে যুক্ত হয়েছে। শিগগিরই স্কুল খুললে চিন্তাভাবনা করে দেখব, নতুন করে চালু করা যায় কি না? কিন্তু স্কুল খুলতে আরো দেরি হলে হয়তো আর খোলাই সম্ভব হবে না।’
শুধু স্কুলই নয়, খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না শিক্ষার্থীদেরও। অনেক শিক্ষার্থীকে আগের বাসার ঠিকানায় পাওয়া যাচ্ছে না। তাদের অভিভাবকরাও করছেন না যোগাযোগ।
চট্টগ্রামের অন্যতম কিন্ডারগার্টেন সারজন স্কুল অ্যান্ড কলেজে অধ্যক্ষ ও বাংলাদেশে কিন্ডারগার্টেন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ঐক্য পরিষদের চেয়ারম্যান এম ইকবাল বাহার চৌধুরী বলেন, ‘সেপ্টেম্বরের শেষে বা অক্টোবরে স্কুল খুললেও আমরা শিক্ষার্থী পাব না। তবে নভেম্বর থেকেই আমরা ভর্তি কার্যক্রম শুরু করি। তাই আগামী বছরের জন্য প্রস্তুতি নিতে পারব। শিক্ষার্থীদের অনেকেই নানা কাজে যুক্ত হয়েছে, যারা আর স্কুলে ফিরবে না। শিক্ষকদের অনেকেই আর এই পেশায় আসবেন না। আর অনেক স্কুলই বন্ধ হয়ে গেছে। আমাদের তথ্য মতে, এই সংখ্যা ১০ থেকে ১২ হাজারের কম হবে না।’
রাজধানীর মাটিকাটায় স্কাইলার্ক মডেল স্কুলের অধ্যক্ষ মো. সাফায়েত হোসেন বলেন, ‘শুধু শিক্ষার্থী নয়, অনেক শিক্ষকও আর ফিরবেন না স্কুলে। আমার দুজন শিক্ষক ঝালকাঠির রুমানা বেগম ও দিনাজপুরের শরীফুল ইসলাম বাড়ি চলে গেছেন। তাঁদের আর শিক্ষকতায় ফেরার ইচ্ছা নেই। আমরা কোনোমতে ধারদেনা করে স্কুলটি টিকিয়ে রেখেছি। বাড়িভাড়া দিতে গিয়ে যে পরিমাণ ঋণের বোঝা মাথায় নিয়েছি, তা কত বছরে শোধ হবে জানি না। কিন্তু শিক্ষকতা পেশা ছাড়া অন্য কোনো কাজ তো করিনি। তাই এই পেশা ছাড়তে পারছি না।’ ওই স্কুলের শিক্ষক মামুনুর রশীদ বলেন, ‘পরিবার গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি। দেড় বছর ধরে দোকানের কর্মচারীসহ নানা ধরনের কাজ করছি। আর রাতের বেলায় আমাদের স্কুলে থাকার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। তাই থাকতে পারছি। যদি স্কুল খোলে, তাহলে আবার শিক্ষকতায় ফিরে আসব।’
জানা যায়, ছোটখাটো কিন্ডারগার্টেনে নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানরাই বেশি পড়ে। করোনার এই দুঃসময়ে দারিদ্র্য বেড়ে যাওয়ায় অনেক অভিভাবকই রাজধানী ছেড়েছেন। অনেকেই গ্রামের বাড়িতে পাড়ি জমিয়েছেন। এ পরিস্থিতি বিবেচনা করে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে টিসি (ট্রান্সফার সার্টিফিকেট) ছাড়াই ভর্তির সার্কুলার জারি করেছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। যাতে যেসব কিন্ডারগার্টেন এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে বা যাঁরা গ্রামে চলে গেছেন, তাঁরা তাঁদের সন্তানদের কাছাকাছি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে টিসি ছাড়া ভর্তি করাতে পারেন। তবে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষার্থীদের সরকারি প্রাথমিকে ভর্তির সুযোগ দিলেও এ বছর কতজন অতিরিক্ত শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে, সে তথ্য এখনো তাদের হাতে নেই।
কিন্ডারগার্টেনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে সেপ্টেম্বরের শেষ নাগাদ স্কুল খুললেও তাঁদের শিক্ষার্থীদের খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে। কারণ বছরের শেষ সময়ে কেউ স্কুলে আসবে না। অনেক অভিভাবকই মনে করবেন, স্কুলে আসতে হলে হয়তো ভর্তি ফিসহ পুরো বছরেরই বেতন দিতে হবে। এ কথা চিন্তা করে তাঁরা তাঁদের বাচ্চাদের কিন্ডারগার্টেনে পাঠাবেন না। এ ছাড়া অনেক শিক্ষার্থীকে কাজে দিয়ে দিয়েছেন অভিভাবকরা। অনেক মেয়ে বাল্যবিয়েরও শিকার হয়েছে।
রাজধানীর জুরাইনের আলমবাগের স্কলার্স ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের পরিচালক ইমন আহমেদ বলেন, ‘কোনোভাবে একটি কক্ষ নিয়ে স্কুলটি টিকিয়ে রেখেছি। কিন্তু শিক্ষার্থীদের খোঁজ নেই। তাদের কেউ কেউ গ্রামের বাড়িতে চলে গেছে, কেউ মাদরাসায় ভর্তি হয়েছে, অনেক শিক্ষার্থীই শিশুশ্রমে জড়িয়েছে। ফলে স্কুল খুললেও এ বছর তেমন শিক্ষার্থী পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। এর পরও আগামী বছরের জন্য প্রস্তুতি নিতে পারব।’
রাজধানীর কালাচাঁদপুরে কনফিডেন্স ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা মো. শাওন আহমেদ তাঁর স্কুলে মেস ভাড়া দিয়েছেন। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘স্কুল বন্ধ থাকলেও প্রতি মাসে বাড়িভাড়া দিতে হয়। তাই বাধ্য হয়ে মেসভাড়া দিয়েছি। যদি সরকার স্কুল খুলে দেয়, তাহলে মেস তুলে দিয়ে আবার স্কুলের জন্য প্রস্তুতি নেব।’
এ ব্যাপারে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (বিদ্যালয়) রতন চন্দ্র পণ্ডিত কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘৬৫ হাজার ৫৬৬টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে টিসি ছাড়াই ভর্তির সুযোগ রাখা হয়েছে। আমাদের প্রয়োজনীয় স্কুল ও পর্যাপ্ত আসন রয়েছে। কিন্ডারগার্টেনে পড়ুয়া কোনো শিক্ষার্থী যদি আমাদের বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চায়, তাহলে তার কোনো কাগজপত্র লাগবে না। কিন্তু কোন শ্রেণিতে ভর্তি হবে, সে জন্য যদি তার বর্তমান বা আগের ক্লাসের কোনো বই-খাতা বা যেকোনো কাগজপত্র দেখাতে পারে, তাহলে ভালো হয়। তাহলে ওই শিক্ষার্থীর লেভেল অনুযায়ী তাকে ভর্তি করা হবে। ফলে স্কুলের অভাবে কোনো শিক্ষার্থীর পড়ালেখা ব্যাহত হওয়ার সুযোগ নেই।’