প্রতিদিন আর্দ্রতা কমছে বাতাসে। শুষ্ক-রুক্ষ হয়ে উঠছে আবহাওয়া। প্রকৃতিতে এখন শীতার্ত আমেজ। শিশির ভেজা ঘাসের ডগায় মুক্তোর দানা। ভোরের কাঁচা রোদ, মৃদু হিমস্পর্শ প্রাণে শিহরন তুলে বিদায় নিয়েছে অগ্রহায়ণ। ঘন কুয়াশায় মুখ ঢেকে উত্তরের হাওয়ায় প্রকৃতিতে শীতল পরশ নিয়ে এলো পৌষ মাস। ঋতুচক্রে পৌষ আর মাঘ মিলে শীতকাল।
এই শীতে রিক্ত প্রকৃতিকে বাঙালি নতুন করে আবিষ্কার করে। এক অদ্ভুত আচ্ছন্নতা ঘিরে রাখে। দিনের সূর্য ঢেলে দিচ্ছে মায়াবী রোদ। রাতের আকাশের বুকভরা রুপালি তারাখচিত উজ্জ্বলতা। চাঁদের ধবধবে দুধ সাদা জোছনা। পূর্ণিমা চাঁদ হয়ে ওঠে শিশির ধোয়া রূপার থালা। খালবিল থেকে বর্ষার পানি শুকাচ্ছে। আকাশে ছন্নছাড়া নীল মেঘের ভেলা। কাশবনের শনশন শব্দ আর পাখপাখালির কিচিরমিচিরে জনপদ মুখর। পরানে তীব্র শিস দেয় কোনো এক আকুলতা। গ্রামাঞ্চলে শুরু মাছ ধরার উত্সব। এখন গ্রামীণ জনপদের আবহাওয়া বলে দিচ্ছে শীত এসেছে। এ সময় সূর্য দক্ষিণ গোলার্ধে অবস্হান করে বলে বাংলাদেশে সূর্যের রশ্মি তির্যকভাবে পড়ে। তাপমাত্রার পরিমাণ কমতে থাকে। শীতের রাত দীর্ঘ হয়।
শীতকাল অন্য ঋতুগুলোর চেয়ে একেবারেই আলাদা। গ্রীষ্মের মাঠ-ঘাট ফাটা প্রখর তাপ, বর্ষার নূপুর শব্দের অবিরল বারিধারা, শরতের স্নিগ্ধতা ও স্বচ্ছতা পেরিয়ে আসে ঋতুরাণী হেমন্ত। নবান্নের ঋতুর হাত ধরেই আসে শীতকাল। মাঠে মাঠে সোনালি ধান গোলায় ভরার উত্সবে মেতে থাকা মানুষের শরীরে লাগে শীতের কাঁপন। নতুন ধানের পিঠা-পায়েস নিয়ে সকালের মিঠে রোদ্দুরে পিঠ ঠেকিয়ে রসনা তৃপ্তি শীতের সে এক অন্যরকম অনুভূতি। খেজুরের মিষ্টি রসের হাঁড়িতে পাটকাঠি ডুবিয়ে গ্রামের ছেলেমেয়েদের চুকচুক করে রস খাওয়ার সেই দৃশ্য আজও বদলায়নি। বদলায়নি বাঙালির সেই অতিথি পরায়ণ মন-মানসিকতা। খেজুরের রস, পাটালি গুড়, কোচাভর্তি মুড়ি-মুড়কি, পিঠা-পায়েস, খড়-পাতার আগুন তাপানো, গমের খেতে পাখি-তাড়ানো, লেপ-কম্বলের উত্তাপ, কুয়াশাঢাকা ভোরে ও সন্ধ্যায় আনন্দ-কষ্টের মিশেল নিয়ে আমাদের জীবনে শীতকাল উপস্হিত হয়।
শীতের মিঠেরোদ, কুয়াশার চাদর, উঠোনের কোণে মাটির চুলায় রান্না, চুলার পাশে বসে বসে হাতের তালু গরম করে নেওয়া, চায়ের কাপের শাদাটে ধোঁয়া, হলুদের ডালি বিছানো সর্ষের মাঠ এইসব ছবি আর ছবির পেছনের গল্প আমাদের কাছে খুব বেশি চেনা। আর আছে গ্রামের স্কুলমাঠে যাত্রা-সার্কাস-অপেরার মাতোয়ারা সব রাত। হিম হাওয়ায় ঠান্ডা-কাশি তো আছেই। শীতকে কেউ ভেবেছেন উত্সব, কেউ-বা মৃত্যু। অনেকে হতাশা ও আশাহীনতার কাল হিসেবে বিবেচনা করেছেন শীতকে। শীত প্রধান দেশগুলোতে ‘এক শীত পেরোলে আরেক জীবনের সম্ভাবনাকে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পঞ্জিকার অনুশাসন মানছে না আর প্রকৃতি। শীত-গ্রীষ্মকে আলাদা করে চেনা কঠিন হয়ে উঠছে। শীত তার দশ প্রহরণ ছড়াতে না ছড়াতেই বসন্ত এসে প্রকৃতিকে অধিকার করে নিচ্ছে। গ্রিন হাউজ এফেক্টের কারণে প্রকৃতিতে প্রকৃতি আর স্বাভাবিক থাকছে না। শীতে শীতের তীব্রতা অথবা উষ্ণতা বেড়েছে। তবে শীতকাল উপভোগ্য হলেও এই মৌসুমটাতে নানান রোগব্যাধির প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। এ সময়টাতে শরীরের প্রতি বাড়তি যত্ন নিতে নয়। যাতে ঠান্ডাজনিত রোগব্যাধি থেকে সহজেই রক্ষা পাওয়া যায়।
এদিকে ইউরোপিয়ান, আমেরিকান ও কানাডার মডেল পূর্বাভাস বিশ্লেষণ করে কানাডার সাসকোয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া গবেষক মোস্তফা কামাল জানিয়েছেন, ‘পৌষের সাথে সাথে শীতের তীব্রতা বাড়তে থাকবে। সামনের সপ্তাহে শুরু হতে যাচ্ছে মাঝারি মানের শৈত্যপ্রবাহ। কোনো কোনো অঞ্চলে তাপমাত্রা নেমে যেতে পারে ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসেরও নিচে। তবে এটা চলবে তিন থেকে চার দিন। এ সময়ের মধ্যে রংপুর ও রাজশাহী বিভাগের তাপমাত্রা ৫ থেকে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ওঠানামা করতে পারে। সামনের ২১ ডিসেম্বর থেকে মূল শৈত্যপ্রবাহ শুরু হলেও ১৮ ডিসেম্বর থেকে রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে শীতের তীব্রতা বাড়বে।’