দেশের ব্যাংক খাতে ডলারের সর্বোচ্চ বিনিময় হার ১০৭ টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনুমোদিত এ দরেই বিদেশী এক্সচেঞ্জ হাউজগুলো থেকে রেমিট্যান্স কিনছে দেশের ব্যাংকগুলো। তবে ডলারের অনুমোদিত এ দরের বাইরেও দেশে আরো দুই বাজারে ভিন্ন দরে ডলার লেনদেন হচ্ছে। এক্ষেত্রে দেশের মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানগুলোতে (কার্ব মার্কেট) প্রতি ডলার লেনদেন হচ্ছে ১১৩-১১৪ টাকায়। আর হুন্ডির বাজারে প্রতি ডলার লেনদেন হচ্ছে ১১৯ টাকারও বেশি দরে। অবৈধ পথে বিদেশে অর্থ পাঠাতে হুন্ডির বাজার এখন বেশ জমজমাট বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
ডলার সংকটের কারণে গত বছরের জুন থেকে আমদানি নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এক্ষেত্রে ঋণপত্র (এলসি) খোলায় কড়াকড়ি আরোপের পাশাপাশি এলসি মূল্য বড় হলে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অনুমোদনের শর্তও বেঁধে দেয়া হয়। অনুসন্ধানের তথ্য বলছে, এলসি খোলায় শর্তারোপের পর থেকে হুন্ডির বাজার আরো বেশি সম্প্রসারিত হয়েছে। হুন্ডি তত্পরতায় ব্যবহূত হচ্ছে অনুমোদিত মানি এক্সচেঞ্জের পাশাপাশি অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জ হাউজগুলো। আবার প্রভাবশালী কিছু ব্যক্তিও হুন্ডির মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা রাখছেন। এক্ষেত্রে কিছু ব্যাংকের পরিচালক ও ব্যাংকারও জড়িত বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে অর্থ পাঠানোর অংকের ওপর নির্ভর করে ডলারের দর। অর্থের পরিমাণ বেশি হলে ডলারের দরও বেশি হয়। দেশ থেকে বড় অংকের অর্থ পাচারের তত্পরতা চললে হুন্ডির বাজারে এর প্রভাব পড়ছে। গত কয়েক মাসে হুন্ডির বাজারে প্রতি ডলারের দর ১২০-১২৫ টাকা পর্যন্তও উঠে গিয়েছিল।
একটি বেসরকারি ব্যাংকের শীর্ষপর্যায়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘আমার ছোট ভাই পড়ালেখার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে গেছে। গত ডিসেম্বরে হঠাৎ করেই তার ৫ হাজার ডলার দরকার পড়ে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে ওই অর্থ পাঠাতে হয়েছে। এজন্য বিকাল ৫টার দিকে মতিঝিলের একটি মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানে ফোন করি। তারা ৩ ঘণ্টার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে ভাইয়ের কাছে ডলার পৌঁছে দিয়েছে।’
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ভ্যাট-ট্যাক্স ফাঁকি দেয়ার জন্য ব্যবসায়ীরা আমদানি পর্যায়ে পণ্যের দাম কম দেখাচ্ছেন। এক্ষেত্রে এলসিতে উল্লিখিত পণ্যের মূল্য যাচ্ছে ব্যাংকিং চ্যানেলে। বাকি অর্থ পাঠানোর জন্য বেছে নেয়া হচ্ছে হুন্ডিকে। অবৈধ উপায়ে উপার্জিত অর্থ বিদেশে পাচার করার জন্যও হুন্ডিকে ব্যবহার করা হচ্ছে। বাংলাদেশীরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাড়ি-গাড়িসহ সম্পত্তি কিনছেন। এক্ষেত্রে দেশ থেকে অর্থ যাচ্ছে হুন্ডিতে। আবার উচ্চশিক্ষা বা বিভিন্ন কারণে বসবাসকারী ব্যক্তিদের কাছে অর্থ পাঠানোর জন্যও হুন্ডিকে বেছে নেয়া হচ্ছে।
বহু বছর ধরে ফল আমদানি করে বাজারজাত করেন পুরান ঢাকার ব্যবসায়ী ইকবাল মাহমুদ (প্রকৃত নাম নয়)। এবারের রমজান উপলক্ষে তিনি সৌদি আরব থেকে খেজুর আমদানির উদ্যোগ নেন। একই সঙ্গে ভারত, চীনসহ কয়েকটি দেশ থেকে আপেল, কমলাসহ বিভিন্ন ধরনের ফল আমদানির চেষ্টা করেন তিনি। কিন্তু কোনো ব্যাংকেই কাঙ্ক্ষিত এলসি খুলতে না পেরে শেষ পর্যন্ত তিনি বিকল্প পথে হাঁটেন।
এ ব্যবসায়ী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বিদেশী যেসব ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ফল আমদানি করি, তাদের সঙ্গে দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। ওই সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে খেজুরসহ বিভিন্ন ধরনের ফল আমদানি করেছি। এক্ষেত্রে নামমাত্র মূল্যে ব্যাংকে এলসি খুলেছি। পণ্যের বাকি অর্থ হুন্ডির মাধ্যমে তাদের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছি। হুন্ডিতে ডলারপ্রতি ১২১ টাকাও পরিশোধ করতে হয়েছে। কিছু পণ্য ভারত হয়ে দেশে এসেছে।’
দেশে পণ্য আমদানিতে মূল্য কম দেখানোর মতো ঘটনা দেখা যাচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) দেয়া তথ্যেও। চলতি অর্থবছর আমদানিকারকরা কাস্টমসে ৪৩৮ কোটি টাকার খেজুর আমদানির ঘোষণা দিয়েছেন। ঘোষিত এ মূল্যের ওপর শুল্ক ও কর আদায় করা হয়। যদিও বাস্তবে দেখা যাচ্ছে আমদানীকৃত খেজুরের মূল্য দেড় হাজার কোটি টাকারও বেশি। দেশের বাজারে প্রতি কেজি মরিয়ম কিংবা আজওয়া খেজুর বিক্রি হচ্ছে হাজার টাকায়। অথচ এ মানের খেজুর আমদানির দর দেখানো হয়েছে মাত্র ১০০ টাকা। আবার বাজারে হাজার টাকায় বিক্রি হওয়া কাজুবাদামের আমদানিতে কেজি দেখানো হয়েছে ১২০-১৯০ টাকা।
শুধু খাদ্যপণ্য আমদানিই নয়, শিল্পের কাঁচামাল, মূলধনি যন্ত্রপাতি থেকে শুরু করে খেলনা সামগ্রীও কম মূল্য দেখিয়ে আমদানি করা হচ্ছে। আবার পণ্যের দাম বেশি দেখিয়ে ব্যাংকিং চ্যানেলে দেশ থেকে অর্থ পাচারের ঘটনাও নিয়মিত ঘটছে। দেশের প্রথম প্রজন্মের একটি বেসরকারি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী এ বিষয়ে জানান, ব্যবসায়ীরা দাম কম দেখিয়ে যেসব পণ্য আমদানি করছেন, সেগুলোর প্রকৃত মূল্য দেখানো হলে বাজারে ওইসব পণ্যের দাম আরো অনেক বেশি হতো। শুল্ক ও কর কাঠামোর বৈষম্যের কারণেই ব্যবসায়ীরা পণ্যের দাম কম দেখিয়ে আমদানি করছেন। এক্ষেত্রে হুন্ডির বাজারই বেশি লাভবান হচ্ছে। কারণ পণ্যের বাকি অংশ হুন্ডির মাধ্যমেই দেশ থেকে পাঠানো হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুুবুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দেশে হুন্ডির বাজার যে বেশ সক্রিয় এতে কোনো সন্দেহ নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থা হুন্ডি কারবারিদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে ব্যবস্থাও নিচ্ছে। তার পরও হুন্ডির বাজার সংকুচিত হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। দেশের অর্থনীতির স্বার্থেই হুন্ডি তত্পরতা কঠোর হস্তে দমন করা দরকার।’
দেশে ডলারের খুচরা বাজার বা কার্ব মার্কেট মূলত মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানগুলোকে কেন্দ্র করে পরিচালিত হয়। বর্তমানে দেশে ২৩৫টি মানি এক্সচেঞ্জের লাইসেন্স রয়েছে। যদিও দেশে এক হাজারেরও বেশি মানি এক্সচেঞ্জ কার্যক্রম পরিচালনা করছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগসহ (সিআইডি) বিভিন্ন সংস্থার অনুসন্ধানে জানা গেছে। গত ছয় মাসে সিআইডির পক্ষ থেকে অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালিত হয়। ওইসব অভিযানে ডজনখানেক মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়ার পাশাপাশি অর্ধশতাধিক ব্যক্তিকে আটকও করা হয়েছিল। কিন্তু দেশে হুন্ডি তত্পরতা কমানো যায়নি বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
একাধিক মানি এক্সচেঞ্জের কর্মকর্তা জানান, দেশে বৈধ মানি এক্সচেঞ্জগুলো মূলত মানুষের বিদেশ ভ্রমণে যাওয়া ডলারের জোগান দেয়। আবার বিদেশ থেকে ফিরে অনেকে মানি এক্সচেঞ্জগুলোতে ডলার বিক্রি করে। কিন্তু দেশে বড় মাপের হুন্ডি তত্পরতার সঙ্গে অনেক রাঘববোয়াল জড়িত। তারা দেশে-বিদেশে বসে হুন্ডির বাজার নিয়ন্ত্রণ করছেন। মধ্যপ্রাচ্যসহ রেমিট্যান্সের প্রধান উেসর দেশগুলোতে প্রভাবশালীদের বিস্তৃত হুন্ডির নেটওয়ার্ক রয়েছে। তাদের নিয়োগকৃত এজেন্ট প্রবাসীদের কাছ থেকে বিদেশী মুদ্রা সংগ্রহ করছেন। আর দেশে তাদের প্রতিনিধিরা ব্যাংকসহ অন্যান্য উত্স থেকে সংগৃহীত নগদ টাকা প্রবাসী পরিবারের হাতে পৌঁছে দিচ্ছেন।
গত ফেব্রুয়ারিতে রাজধানীর ধানমন্ডিতে নিজেদের পৈত্রিক ফ্ল্যাট বিক্রি করে দিয়েছেন কানাডা প্রবাসী মনসুরুল ইসলাম। হুন্ডি ব্যবহার করে ফ্ল্যাট বিক্রির ২ কোটি টাকা তিনি কানাডায় নিয়ে গিয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে ওই প্রবাসী জানান, দেশে এখন আর ঘনিষ্ঠ আত্মীয় বলতে তেমন কেউ নেই। এ কারণে দেশে যাওয়াও হয় খুব কম। এজন্যই ফ্ল্যাটটি বিক্রি করে দিয়েছেন। ফ্ল্যাট যিনি কিনেছেন, তিনিই নিজ দায়িত্বে কানাডায় টাকা পাঠিয়ে দিয়েছেন। কানাডায় স্থায়ী হওয়া বহু বাংলাদেশীই এখন একই প্রক্রিয়ায় দেশ থেকে সম্পদ বিক্রির অর্থ নিয়ে যাচ্ছেন বলেও জানান তিনি।
বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যাংকগুলোর সংগঠন ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) ও ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) পক্ষ থেকে রেমিট্যান্সের ডলার সর্বোচ্চ ১০৭ টাকায় কেনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় গত বছরের সেপ্টেম্বরে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপে ডলারের এ দর নির্ধারণ করা হয়েছিল। এরপর থেকে দেশের রেমিট্যান্স প্রবাহ নিম্নমুখী। আমদানি দায় পরিশোধের চাপে দিশেহারা ব্যাংকগুলো বিভিন্ন সময়ে ঘোষিত দর মানেনি। অনেকেই ১১০ টাকার বেশি দরে রেমিট্যান্স কিনে ব্যাংকে কম দর দেখিয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ১২টি ব্যাংককে চিহ্নিত করে সতর্ক করেছে।
গতকাল কেন্দ্রীয় ব্যাংকে অনুষ্ঠিত ব্যাংকার্স সভায় গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার রেমিট্যান্স কেনায় দর ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে নিজের কঠোর মনোভাব জানিয়েছেন। গভর্নর বলেছেন, ‘ব্যাংকগুলোতে বৈদেশিক মুদ্রা কেনাবেচার তথ্য তদন্তে নিরীক্ষক দল পাঠানো হবে। যেসব ব্যাংকে ডলারের ঘোষিত দর ভঙ্গের প্রমাণ পাওয়া যাবে, তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে।’