আজ (১০ জানুয়ারি) জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। পাকিস্তানে বন্দীদশা থেকে মুক্তি পেয়ে ১৯৭২ সালের এদিন বেলা ১টা ৪১ মিনিটে জাতির অবিসংবাদিত নেতা ও মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে প্রত্যাবর্তন করেন। তিনি পাকিস্তান থেকে লন্ডন যান এবং তারপর দিল্লী হয়ে ঢাকায় ফিরে আসেন।
বার্তা সংস্থা বাসস জানিয়েছে, দিবসটি পালন উপলক্ষে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও দলের বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনসহ বিভিন্ন দল ও সংগঠন ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
বাসস এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানে নিয়ে কারাগারে আটক করে রাখে।
শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান থেকে ছাড়া পান ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি। এদিন তাকে ও কামাল হোসেনকে বিমানে তুলে দেওয়া হয়। সকাল সাড়ে ৬টায় তারা পৌঁছান লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে। বেলা ১০টার পর থেকে তিনি ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ, তাজউদ্দিন আহমদ ও ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীসহ অনেকের সঙ্গে কথা বলেন। পরে ব্রিটেনের বিমান বাহিনীর একটি বিমানে তিনি পরের দিন ৯ জানুয়ারি দেশের পথে যাত্রা করেন।
১০ তারিখ সকালেই তিনি নামেন দিল্লিতে। শেখ মুজিবুর রহমান সেখানে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভিভি গিরি, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, সমগ্র মন্ত্রিসভা, নেতৃবৃন্দ, তিন বাহিনীর প্রধান এবং অন্যান্য অতিথি ও সেদেশের জনগণের কাছ থেকে উষ্ণ সংবর্ধনা লাভ করেন।
বঙ্গবন্ধু ভারতের নেতৃবৃন্দ এবং জনগণের কাছে তাদের অকৃপণ সাহায্যের জন্য আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানান।
শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা এসে পৌঁছেন ১০ জানুয়ারি। ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয়ের পর বাঙালি জাতি তাকে প্রাণঢালা সংবর্ধনা জানানোর জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় ছিল। আনন্দে আত্মহারা লাখ লাখ মানুষ ঢাকা বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স ময়দান পর্যন্ত তাকে স্বতঃস্ফূর্ত সংবর্ধনা জানান। বিকাল পাঁচটায় রেসকোর্স ময়দানে প্রায় ১০ লাখ লোকের উপস্থিতিতে তিনি ভাষণ দেন। সশ্রদ্ধ চিত্তে তিনি সবার ত্যাগের কথা স্মরণ করেন, সবাইকে দেশ গড়ার কাজে উদ্বুদ্ধ করেন।
নয় মাসের যুদ্ধের এক পর্যায়ে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ চূড়ান্ত রূপ নিতে শুরু করে। ধীরে ধীরে স্বাধীনতা অর্জনের পথে মুক্তিযোদ্ধা, জনতা ও মিত্রবাহিনীর যৌথ আক্রমণ তীব্র হয়। জয় তখন সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় মাত্র। একই সাথে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে বিশ্বব্যাপী জনমত গড়ে তোলা হয় প্রবাসী সরকারের নেতৃত্বে। বিশ্ব নেতৃবৃন্দ বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে সোচ্চার হলে পাকিস্তানী বর্বর শাসকগোষ্ঠী বাধ্য হয় তাঁকে সসম্মানে মুক্তি দিতে।
১২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। ২৩ সদস্য বিশিষ্ট আওয়ামী লীগের মন্ত্রিসভা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করে।
দিবসটি উপলক্ষে আওয়ামী লীগের কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে, আজ সকাল সাতটায় শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন। আগামীকাল ১১ জানুয়ারি বিকেল আড়াইটায় ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির ভাষণ দেবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
দিবসটি উপলক্ষে দেওয়া এক বাণীতে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ দেশপ্রেম ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে দেশকে এগিয়ে নেয়ার জন্য সকলের প্রতি আহবান জানিয়েছেন।
রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু নিজেই এই স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকে ‘অন্ধকার হতে আলোর পথে যাত্রা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন।’
রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ক্ষমতা হস্তান্তরে অনীহার কারণে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলার মুক্তিকামী মানুষ অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালোরাতে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী তাদের পূর্বপরিকল্পিত বাঙালি নিধনযজ্ঞের নীলনকশা ‘অপারেশন সার্চলাইট’ বাস্তবায়নের মাধ্যমে গণহত্যা চালায়।
এ প্রেক্ষাপটে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং সর্বস্তরের জনগণকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার ডাক দেন। এরপরই পাকিস্তানিরা বঙ্গবন্ধুকে তাঁর ৩২ নম্বরের বাসা থেকে গ্রেফতার করে তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানের মিয়ানওয়ালি কারাগারে আটকে রাখে। সেখানে বঙ্গবন্ধু ৯ মাস ১৪ দিন কঠিন কারাভোগ করেন। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তাঁর নামেই মুক্তিযুদ্ধ চলতে থাকে। তিনিই ছিলেন মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি জাতির প্রেরণার উৎস।’
আবদুল হামিদ বলেন, বঙ্গবন্ধু বিজয়ীর বেশে দেশের মাটিতে পা রেখেই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। সেদিন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লাখো জনতার উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দেন, ‘রক্ত দিয়ে হলেও আমি বাঙালি জাতির এই ভালোবাসার ঋণ শোধ করে যাব।’
রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে নিজের বুকের তাজা রক্ত দিয়ে বঙ্গবন্ধু তাঁর কথা রেখে গেছেন। ষড়যন্ত্রকারীরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে তাঁর আদর্শ মুছে দিতে এবং দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব খর্ব করার অপচেষ্টা চালিয়েছিল। কিন্তু বাঙালি বীরের জাতি। যতদিন বাংলাদেশ ও বাঙালি থাকবে ততদিন বঙ্গবন্ধু সবার অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবেন।’
দিবসটি উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘কোনো অপশক্তি যাতে দেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রার ধারাকে ব্যাহত করতে না পারে, জাতির পিতার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে এ হোক আমাদের অঙ্গীকার।’
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘সে সময় বন্দুকের জোরে ক্ষমতা দখলকারীরা গণতন্ত্র হত্যা, সংবিধানকে ক্ষতবিক্ষত এবং প্রগতি ও উন্নয়নের ধারা রুদ্ধ করে দিয়েছিল।’
অনেক সংগ্রাম আর ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে তার সরকার দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা আরো বলেন, ‘তার সরকার জনগণের জীবনমানের ইতিবাচক পরিবর্তনে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস বঙ্গবন্ধু নিভৃত কারাগারে অসহনীয় নির্যাতনের শিকার হন। প্রহসনের বিচারে ফাঁসির আসামি হিসেবেও তিনি মৃত্যুর প্রহর গুণতে থাকেন।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘জাতির পিতা ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বাংলার মাটিতে প্রত্যাবর্তন করে এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। যেখানে উঠে আসে তার উপর পাকিস্তানি সামরিক জান্তার নির্মম নির্যাতনের বর্ণনা।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর জাতির পিতা যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনে সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। প্রথমেই তিনি ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সদস্যদের দ্রুত দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।’
জাতির পিতা ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং বাঙালি জাতি সে আহবানে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাঙালি জাতির চূড়ান্ত মুক্তির লক্ষ্যে জাতির পিতা ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানের ঐতিহাসিক ভাষণেই ঘোষণা দিয়েছিলেন “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম; এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
বর্তমান সরকার বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে এগিয়ে যাচ্ছে বলেই দেশ আজ উন্নয়নের ধারায় রয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এখন আমাদের মাথাপিছু আয় প্রায় এক হাজার ৩১৪ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। রিজার্ভ ২৭ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ, তথ্যপ্রযুক্তি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের প্রতিটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের বুকে রোল মডেল।’