প্রতিনিধি
শাহরাস্তি উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল ডাকাতিয়া নদীর দক্ষিণাংশে পরিবেশ ও জনজীবনের ক্ষতি করে অবাধে গড়ে উঠছে একের পর এক অপরিকল্পিত ইটভাটা। আর ওই সকল ইটভাটার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে ট্রাক্টর নামক যন্ত্রদানব। এ যন্ত্রদানবের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এতে উপজেলা সদরের প্রধান সড়কসহ গ্রামীণ সড়কগুলোর বেহাল অবস্থা হয়ে পড়েছে। প্রতিনিয়ত ট্রাক্টরের যাতায়াতে ভেঙ্গে পড়েছে বহু সেতু-কালভার্ট। যাতায়াতসহ নিত্য নৈমিত্তিক কাজে ভোগান্তিতে পড়ছে এ উপজেলার সাধারণ মানুষ। তাছাড়া এ এলাকার অধিকাংশ মানুষ কৃষি পেশায় নিয়োজিত। অবাধে ইটভাটা নির্মাণ হওয়ায় হারিয়ে যাচ্ছে দেশের কৃষি সম্পদ। বেকার হয়ে পড়ছে কৃষি কাজে সম্পৃক্ত মানুষগুলো। দিনে দিনে ইটভাটার সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকলে দেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ কৃষি হারিয়ে যাবে অচিরেই। সরকার কৃষি জমি ও কৃষকদের রক্ষার্থে নানামুখি পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও ভ্রুক্ষেপ করছে না ইটভাটা নির্মাণকারী ব্যক্তিরা। সরকারের কোনো নিয়ম- নীতির তোয়াক্কা না করে আবাদি জমিতেই গড়ে উঠছে ব্যাঙের ছাতার মতো ইটভাটা।
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, উপজেলায় ভূমিহীন, প্রান্তিক, ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বড় কৃষক পরিবার সর্বমোট ৩৬ হাজার ৫শ’ ২৮জন। ভূমি ব্যবহার সংখ্যা-আবাদযোগ্য জমি ১১ হাজার হেক্টর, আবাদি জমি ১০ হাজার ৮শ’ ৫০ হেক্টর, স্থায়ী পতিত ১শ’ ৫০ হেক্টর, পুকুর-জলাশয় ৬শ’ ৩০ হেক্টর, বাড়ি ঘর ১ হাজার ৮শ’ ৫০ হেক্টর, স্থায়ী ফল বাগান/সামাজিক বনায়ন ৩শ’ ১৭ হেক্টর, রাস্তাঘাট অবকাঠামো ১ হাজার ৬শ’ ৫ হেক্টর। এক ফসলি জমির পরিমাণ ৯শ� ৫০ হেক্টর, দুই ফসলি জমির পরিমাণ ৮ হাজার ৪শ’ ৫০ হেক্টর এবং তিন ফসলি জমির পরিমাণ ১ হাজার ৪শ’ ৫০ হেক্টর।
কৃষি অফিস সূত্রে আরো জানা যায়, বছরে ৫২ হাজার ৩শ’ ৫২ মেট্রিক টন খাদ্য উৎপাদন হয় আর খাদ্য চাহিদা হলো ৪১ হাজার ৫শ’ ২১ মেট্রিক টন। ১০ হাজার ৮শ’৩১ মেট্রিক টন খাদ্য উদ্বৃত্ত থাকে।
এক অনুসন্ধানে জানা যায়, দুই ফসলি ও আবাদযোগ্য জমিতে এলাকার একশ্রেণির অর্থশালী ব্যক্তি ইটভাটা নির্মাণ করছে। লাগামহীনভাবে আবাদি জমি ভরাট করে ঘর-বাড়ি নির্মাণ হচ্ছে। কমে যাচ্ছে ফসলি জমি, প্রতিনিয়ত খাদ্য ঘাটতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। ইটভাটার ধোঁয়ায় জমির ফসল এবং ফলদ গাছে ফল ধরা বন্ধ হয়ে পড়েছে। ইটভাটার ধোঁয়ায় ও ট্রাক্টরের বেপরোয়া চলাচলে অতি ধূলাবালিতে বায়ু দূষণ এবং উচ্চস্বরে শব্দ দূষণ হচ্ছে। এতে লোকজন বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছে।
জানা যায়, শাহরাস্তি উপজেলায় মোট ২১টি ইটভাটা ও আড়াই শতাধিক ট্রাক্টর রয়েছে।
উপজেলার ভড়�য়া গ্রামের কৃষক আবদুর রহিম জানান, বাবা-দাদার সময় হতে কৃষি কাজই আমাদের প্রধান পেশা। কিন্তু যে হারে কৃষি জমিতে ইটভাটা নির্মাণের প্রতিযোগিতা চলছে তাতে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে কৃষি বলতে কিছুই থাকবে না। তাছাড়া ওই সকল ইটভাটা নির্মাণের পর পার্শ্ববর্তী সকল আবাদি জমি হতে ইটভাটার মালিকরা চড়া মূল্যে মাটি কিনে নেয়। ওই মাটি বহনের জন্য ব্যবহৃত হয় যন্ত্রদানব ট্রাক্টর। মাটি আনা-নেয়ায় ফসলি জমির ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। ফলে যে পরিমাণ ফসল পাওয়ার কথা তা থেকে বঞ্চিত হয় কৃষকরা। এছাড়া ট্রাক্টরের অবাধ বিচরণে সড়কগুলো একেবারে রুগ্ন হয়ে গেছে। এখন অধিকাংশ ছেলে-মেয়ে স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসামুখি। প্রতিদিন সকালে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের শিক্ষা অর্জনের জন্য ওই সকল সড়ক দিয়ে যাতায়াত করতে হয়। যেভাবে নিয়ন্ত্রণহীন ট্রাক্টর চলাচল করছে এতে প্রতিনিয়ত ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটছে, অকালে ঝরে যাচ্ছে বহু নিষ্পাপ প্রাণ।
কলেজ ছাত্র নাজমুল হাসান জানান, আমরা কলেজে যাওয়া ছাড়াও গ্রামের বাজারে প্রয়োজনীয় কাজে যাতায়াত করে থাকি। যে হারে রাস্তায় ট্রাক্টর চলাচল করে এতে নিরাপদে বাজারে যাওয়া-আসা হুমকির মুখে পড়েছে।
এ বিষয়ে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাইফুল ইসলামের সাথে আলাপে তিনি জানান, আশপাশে আবাসিক এলাকা, কৃষি জমি থাকলে ইটভাটা নির্মাণ করা যাবে না। ওই সমস্ত এলাকায় ইটভাটা নির্মাণ হলে পরিবেশ দূষণ হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই।
এদিকে উপজেলার সূচীপাড়া উত্তর ইউনিয়নের ধামরা গ্রামের লোকজন জানান, ওই গ্রামে আল-মদিনা ব্রিকস নামে একটি ইটভাটা রয়েছে। ইটভাটার পার্শ্ববর্তী খালের পশ্চিম পাশে ওই ইউনিয়নের বসুপাড়া-ধামড়া-হাড়াইরপাড়া মৌজার মধ্যবর্তী স্থান হাড়াইরপাড়া এলাকার কৃষি জমিতে স্থানীয় সূচীপাড়া বাজারের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আবুল হোসেন প্রকাশ আবু মিয়া আরেকটি ইটভাটা নির্মাণের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এজন্য জমির মালিক ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট তিনি দৌড়-ঝাঁপ শুরু করে দিয়েছেন। তাদের দাবি, প্রতিযোগিতা করে অর্থশালীরা একই গ্রামে পাশাপাশি আবাদি জমিতে ইটভাটা নির্মাণ করে দেশের কৃষি সম্পদকে চিরতরে বিলীন করার স্বপ্ন বুনছে। তাই ওই সকল আবাদি জমি, দেশের কৃষক ও কৃষি সম্পদকে রক্ষার্থে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে এমনটাই প্রত্যাশা করছে এলাকাবাসী।