ডা. এস.জামান পলাশ:
কারো ঠান্ডায় অ্যালার্জি, কারো ধুলোবালিতে, কারো অ্যালার্জি খাবারে, এমনকি কারো বিশেষ কোনো রঙেও অ্যালার্জি হতে পারে।
অ্যালার্জি কী ঃ-শরীরে একটি স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকে। শরীর যখন কোনো ক্ষতিকর বস্তুর সংস্পর্শে আসে, তখন এই রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা সক্রিয় হয়ে বিশেষ কিছু প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সেই বস্তুকে প্রতিহত করে বা করার চেষ্টা করে। কিন্তু এই রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থ্য যখন স্বাভাবিকভাবে ক্ষতিকর নয়, এরূপ বস্তুর বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়ে অস্বাভাবিক বা অতিরিক্ত কোনো রিঅ্যাকশন করে, যা শরীরের জন্য, এমনকি কখনো জীবনের জন্য হুমকি হয়ে ওঠে তখন তাকে অ্যালার্জি বলা হয়।
কিভাবে হয়ঃ-কোনো ব্যক্তি যদি কোনো জিনিসের প্রতি অ্যালার্জিক হন, প্রথমবার সেই বস্তুর সংস্পর্শে এলে শরীরের মধ্যে ইমিউনোগ্লোবিওলিন-ই নামের একটি অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। তখনই কোনো লক্ষণ প্রকাশিত হয় না। এই ইমিউনোগ্লোবিওলিন -ইগুলো শরীরের বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত মাস্ট কোষের (শ্বসনতন্ত্র, পরিপাকতন্ত্র) গায়ে লেগে থাকে। ওই ব্যক্তি যখন পুনর্বার ওই অ্যালার্জেনের সংস্পর্শে আসেন, তখন ওই অ্যালার্জেনগুলো অ্যান্টিবডি ইমিউনোগ্লোবিওলিন -ই-এর সঙ্গে মিলে মাস্ট কোষ থেকে বিশেষ কিছু রাসায়নিক দ্রব্য (যেমন হিস্টামিন) রক্তে নিঃসরণ করে, যেগুলো শরীরে অ্যালার্জি তৈরি করে।
বিভিন্ন ধরনের অ্যালার্জি ঃ-ঠান্ডা বা কোল্ড অ্যালার্জি সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। এটিতে অনেকেই আক্রান্ত হন। যদি কেউ প্রতিবছর একটি নির্দিষ্ট সময়ে ঠান্ডায় আক্রান্ত হন ও হঠাৎ করে
* নাক দিয়ে পানি পড়া
* চোখ জ্বালা
* চোখ দিয়ে পানি পড়া
* হাঁচি।
* খুশখুশে কাশি ইত্যাদিতে ভোগেন তবে মনে করতে হবে ঠান্ডা অ্যালার্জি আছে। মনে রাখবেন, ফ্লু বা ভাইরাসের আক্রমণেও একই রকম সমস্যা হয়ে থাকে।
* ফ্লু হলে সাধারণত সাত থেকে ১০ দিন এ ধরনের সমস্যা থাকে। কিন্তু ঠান্ডার অ্যালার্জি হলে পুরো ঋতুতেই সমস্যা চলতে থাকে।
* ফ্লু হলে সাধারণত জ্বর, মাথাব্যথা ও শরীরে ব্যথা হয়; অ্যালার্জির ক্ষেত্রে কখনোই জ্বর ও গায়ে ব্যথা থাকে না।
* ফ্লু সর্বদাই বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে বা প্রতিবছরই হয় না, কিন্তু অ্যালার্জি প্রায় প্রতিবছর একটি নির্দিষ্ট সময়ে হয়।
কেন হয়ঃ-নির্দিষ্ট ঋতুতে কোনো ফুলের রেণু, কোনো বিশেষ শস্য বা সবজির আঁশ এ ধরনের অ্যালার্জি তৈরি করে।
* শীতকালে শুষ্ক আবহাওয়ায় প্রচুর ধুলা তৈরি হয়, যা অ্যালার্জি তৈরি করে।
* শীতের সোয়েটার বা পশমি কাপড়ের বা উলের রোয়া অ্যালার্জি তৈরি করে।
চিকিৎসাঃ-
* অ্যান্টিহিস্টামিনজাতীয় ওষুধ সেবন করতে হয়।
* নাকের স্টেরয়েড স্প্রে বা ড্রপ বা ডিকনজেসট্যান্ট ব্যবহারও উপকার করে।
অ্যাজমাঃ-অ্যাজমা শ্বসনতন্ত্রের একটি বিশেষ অসুখ, যেখানে শ্বাসনালি বন্ধ হয়ে বা সরু হয়ে শ্বাসকষ্ট তৈরি করে। অ্যাজমা দুই ধরনের
* অ্যালার্জিজনিত অ্যাজমা
* অ্যালার্জি ছাড়া অ্যাজমা।
অ্যালার্জিক অ্যাজমাই বেশি হয়। বাচ্চাদের ক্ষেত্রে ৯০ শতাংশ ও বড়দের ৭০ শতাংশ অ্যাজমাই অ্যালার্জিক হয়। এ ক্ষেত্রে কাশি, দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস, বুকব্যথা ও শ্বাসকষ্ট হয়ে থাকে। ধুলোবালি, পোষা জীবজন্তুর লোম, ফুলের রেণু ইত্যাদি কারণে শ্বসনতন্ত্রের বায়ু পরিবাহী নালি ফুলে যায় ও প্রদাহ হয়।
* অ্যান্টিহিস্টামিন, স্টেরয়েড, ব্রংকোডায়ালেটর ইত্যাদির মাধ্যমে চিকিৎসা করা হয়।
* অ্যাজমা প্রতিরোধের জন্য ধুলোবালি, ফুলের রেণু ইত্যাদি থেকে যথাসম্ভব দূরে থাকার চেষ্টা করতে হবে।
* বর্তমানে লিউকোটেরিন মডিফায়ারের মাধ্যমে অ্যাজমার অ্যালার্জি প্রতিহত করা যায়।
অ্যালার্জি যখন আকস্মিক ও দ্রুত জটিল রূপ ধারণ করে এবং একটি নির্দিষ্ট স্থানে সীমাবদ্ধ না থেকে পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়ে জীবনাশঙ্কা তৈরি করে, তখন তাকে অ্যালার্জিক অ্যানাফাইল্যাঙ্সি বলা হয়।
কী হয়ঃ-
* হঠাৎ গায়ে চুলকানি হয় বা চাকা হয়ে ফুলে যায়।
* শ্বাসকষ্ট হয়।
* বুকে চাপ ধরা ব্যথা অনুভূত হতে পারে।
* পেটে ব্যথা হয়
* হাত, পা, মুখ ও ঠোঁটের চারপাশে অস্বাভাবিক অনুভূতি হয়।
* অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে।
* রোগী শকে চলে যেতে পারে
খাবারে অ্যালার্জিঃ-এ ক্ষেত্রে কেউ কেউ খাবারের কোনো বিশেষ উপাদান, বিশেষ করে কোনো প্রোটিনজাতীয় খাবারের প্রতি অ্যালার্জিক হয়ে থাকেন।
কী ধরনের খাবার অ্যালার্জি তৈরি করেঃ-
* দুধ বা দুগ্ধজাত খাবার
* ডিম
* সামুদ্রিক মাছ যেমন ইলিশ, কোরাল। গরুর মাংস, সবজি যেমন-বেগুন, টমেটো, মাশরুম, কচু, ওল বিভিন্ন ধরনের বাদাম।
কী হয়ঃ-এ ক্ষেত্রে বিশেষ খাবারটি খাওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে অথবা দুই ঘণ্টার মধ্যেই লক্ষণ প্রকাশ পেতে শুরু করে। এ ক্ষেত্রে
* ঠোঁট ও ঠোঁটের চারপাশে অস্বাভাবিক (চুলকানো) অনুভূতি হয়।
* জিহ্বা ফুলে যায়।
* গলা ব্যথা করে ও গিলতে অসুবিধা হয়।
* গায়ে লালচে র্যাশ বা চাকা চাকা দেখা দেয় এবং পুরো শরীর চুলকাতে থাকে।
* বমি বা ডায়রিয়া হতে পারে।
* শ্বাসকষ্ট ও বুকে ব্যথা হয়।
* রক্তচাপ কমে রোগী হঠাৎ জ্ঞান হারাতে পারে।
সাধারণত বোঝা যায় কে কোন খাবারের প্রতি অ্যালার্জিক, তাই সেসব খাবার এড়িয়ে চলাই যুক্তিযুক্ত। তবে কোনো সময় খাওয়ার প্রয়োজন হলে অ্যান্টিহিস্টামিনজাতীয় ওষুধ খেয়ে নিতে হবে। যদি অ্যালার্জিক রিঅ্যাকশন খুব বেশি হয়, স্টেরয়েড দেওয়া যেতে পারে, তবে এপিনেফ্রিন ইনজেকশনই সবচেয়ে কার্যকর চিকিৎসা।
ত্বকের অ্যালার্জিঃ-এ ক্ষেত্রে বিশেষ কোনো বস্তু ত্বকের সংস্পর্শে এলে ত্বকে অ্যালার্জি তৈরি হয়।
কী কী ধরনের হয়ঃ-কনট্যাক্ট ডার্মাটাইটিস : এ ক্ষেত্রে কোনো বিশেষ বস্তু, যেমন-রাবার, প্লাাস্টিক, ল্যাটেঙ্ ইত্যাদির সংস্পর্শে এলে ৩০ মিনিটের মধ্যেই ওই নির্দিষ্ট স্থানে চুলকানি, লাল হওয়া, ফুলে যাওয়া, এমনকি ফোসকা পড়তে পারে।
এ অবস্থায় এ ধরনের বস্তু এড়িয়ে চলা উচিত এবং কখনোই আক্রান্ত স্থান চুলকানো উচিত নয়। চুলকালে নতুন ইনফেকশনের ঝুঁকি থাকে, তাই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
এটপিক ডার্মাটাইটিস : সাধারণত শিশু-কিশোর ও যুবকরা এ ধরনের অ্যালার্জিতে ভোগে। ১ শতাংশ মানুষ এর শিকার হয়ে থাকে। একটি বিশেষ বস্তু ত্বকের সংস্পর্শে এসে চর্মরোগ তৈরি করে, যা দীঘস্থায়ী হয়। এতে চুলকানি, ফোসকা, পানি নিঃসরণ ইত্যাদি হয়। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই চর্ম বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে।
ওষুধে অ্যালার্জিঃ-কোনো বিশেষ ওষুধ সেবন করলে শরীরে অ্যালার্জিক লক্ষণগুলো প্রকাশ পায়।
কী ওষুধে হয়ঃ-
* পেনিসিলিন ও পেনিসিলিন গ্রুপের ওষুধে।
* সালফার গ্রুপের ওষুধে।
* আয়োডিনযুক্ত ড্রাগ (কনট্রাস্ট ডাই, যা সাধারণ কোনো স্বাস্থ্য পরীক্ষায় ব্যবহার করা হয়)।
* ইনসুলিন।
কিভাবে হয়ঃ-
* অ্যান্টিবডি তৈরির মাধ্যমে হতে পারে।
* প্রথমবার খাওয়া বা ইনজেকশনের সময়ই হতে পারে। এর প্রকৃত ব্যাখ্যা এখনো জানা যায়নি।
বেশির ভাগ রোগীই জানে কী ওষুধে তার ড্রাগ অ্যালার্জি আছে, সেসব ওষুধ পরিহার করতে হবে। আর হঠাৎ ড্রাগ অ্যালার্জি দেখা দিলে তৎক্ষণাৎ ওষুধ বন্ধ করে লক্ষণ অনুযায়ী অ্যান্টিহিস্টামিন, স্টেরয়েড, ব্রংকডায়ালেটর, এমনকি প্রয়োজন হলে এপিনেফ্রিন ইনজেকশনের সাহায্যে চিকিৎসা করা হয়।
অ্যালার্জি সম্পর্কিত ভুল ধারণাঃ-
* সবার অ্যালার্জি থাকে, এমন ধারণা অনেকেরই থাকে। এমন অনেক মানুষ আছে যাদের কোনো কিছুতেই অ্যালার্জি নেই।
* অনেকে ভাবেন গরুর মাংস বা ইলিশ মাছ খেলেই অ্যালার্জি হয়। অন্য একজনের অ্যালার্জি হলেই যে ওইসব বস্তুর প্রতি অ্যালার্জিক হবেন, এমন কোনো কথা নেই।
* অনেকে ভাবেন, বয়স বেশি হলে অ্যালার্জি তৈরি হয় না। এটি ঠিক নয়। আপনি যদি নতুন কোনো স্থানে, নতুন কোনো পরিবেশে প্রথমবারের মতো যান, তবে সব বয়সেই অ্যালার্জির শিকার হতে পারেন। তবে খাদ্যের প্রতি বা কোনো ওষুধের প্রতি অ্যালার্জি সাধারণ শৈশব থেকেই বোঝা যায়।
* কোনো খাবার খেয়ে যদি হঠাৎ পেট ব্যথা, বমি ইত্যাদি শুরু হয় তার মানেই যে আপনি ওই খাবারের প্রতি অ্যালার্জিক, তা কিন্তু নয়, হয়তো আপনি খাদ্য বিষক্রিয়ার শিকার।
* ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় কিন্তু অ্যালার্জি হয়। যেমন-অ্যাসপিরিন খেলে অনেকের শরীরে র্যাশ হয়, শ্বাসকষ্ট পর্যন্ত হতে পারে। এটি কিন্তু অ্যালার্জি নয়।
লেখক পরিচিতিঃ- ডা. এস.জামান পলাশ
জামান হোমিও হল
মুক্তিযোদ্ধা মার্কেট,চাঁদপুর
০১৭১১-৯৪৩৪৩৫