আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ পেতে তাদের দেওয়া সব শর্ত এখনই মানছে না সরকার। তবে সংস্থাটির প্রধান শর্তগুলো ইতোমধ্যে মেনে নেওয়া হয়েছে। আরও কিছু শর্ত পর্যায়ক্রমে মানা হবে বলে জানিয়েছে আইএমএফ’কে। বাকি শর্তগুলোর ব্যাপারে সময় চাওয়া হয়েছে।
আইএমএফ’র সঙ্গে ঋণের বিষয়ে আজ অর্থ মন্ত্রণালয়ে চূড়ান্ত বৈঠক হবে। এতে অর্থমন্ত্রীসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকবেন। ওই বৈঠকে আইএমএফ’র সঙ্গে এখন পর্যন্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে তাদের শর্তের ব্যাপারে বাংলাদেশের অবস্থান আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়ে দেওয়া হবে। এর মাধ্যমেই বাংলাদেশে এবারের আইএমএফ’র মিশন শেষ হবে।
বৈশ্বিক মন্দার প্রভাব ও দেশীয় পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে সরকার আইএমএফ’র কাছে ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ চেয়েছে। ওই ঋণের বিষয়ে আলোচনা করতে আইএমএফ’র মিশন ২৬ অক্টোবর ঢাকায় এসেছে। তারা ইতোমধ্যে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার সঙ্গে আলোচনা করেছে। এসব আলোচনায় যেসব শর্ত উঠে এসেছে সেগুলো নিয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ে আলোচনার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে যে, আইএমএফ’র শর্ত অনুযায়ী এখনই জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হবে না। কারণ এগুলোর দাম ইতোমধ্যে বাড়ানো হয়েছে। তবে আইএমএফ’র শর্ত অনুযায়ী এসব পণ্যের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে দেশের বাজারেও বাড়ানো বা কমানোর অবকাঠামো তৈরি করবে সরকার। পরে এগুলোর দাম আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করা হবে। সূত্র জানায়, আইএমএফ’র ঋণ পেতে সরকার তাদের প্রধান শর্তগুলো আলোচনা শুরুর আগেই বাস্তবায়ন করেছে। এর মধ্যে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে ৪৯ থেকে ৫২ শতাংশ। সার ও গ্যাসের দামও বাড়ানো হয়েছে। ভর্তুকি কমানোই হচ্ছে আইএমএফ’র প্রধান শর্ত। এসব ক্ষেত্রে দাম বাড়িয়ে ভর্তুকি কমানো হয়েছে। আজকের বৈঠকে আইএমএফকে জানানো হবে, চলতি অর্থবছরে ভর্তুকি বাজেটে ঘোষিত সীমার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা হবে। দরিদ্রের সেবা দেওয়া ছাড়া অন্যান্য খাতে ভর্তুকির হার পর্যায়ক্রমে কমানোর কথাও তাদের জানানো হবে।
আইএমএফ জিডিপির হিসাব আন্তর্জাতিক মানে নিয়ে যাওয়ার শর্ত আরোপ করেছে। এ বিষয়ে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এটি রাতারাতি করা সম্ভব নয়। এ বিষয়ে হিসাব পদ্ধতি আধুনিকায়নের কাজ চলছে। এটি শেষ হলে হিসাব পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনা হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের যে হিসাব প্রকাশ করছে তা নিয়েও আইএমএফ’র জোর আপত্তি রয়েছে। তারা বলেছে, আইএমএফ’র দেওয়া আন্তর্জাতিক মানে হিসাব করতে ও তা প্রকাশ করতে। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সিদ্ধান্ত নিয়েছে, রিজার্ভের নিট হিসাব করা হচ্ছে। এটি সব সময় করা হবে। তবে তা এখনই প্রকাশ করা সম্ভব নয়। একটু সময় নিয়ে পরিস্থিতির উন্নতি হলে এটি প্রকাশ করা হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র জানায়, রিজার্ভের নিট তথ্য সংশ্লিষ্টরা জানেন। এটি গণমাধ্যমে প্রকাশ হচ্ছে।
ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিট হিসাব করতে কোনো আপত্তি নেই। তবে একটু সময় নিয়ে প্রকাশ করা হবে। খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা আন্তর্জাতিক মানের করতে বলেছে আইএমএফ। বর্তমানে কোনো ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময় শেষ হওয়ার পর থেকে ছয় মাস পরে তা খেলাপি করা হয়। আন্তর্জাতিক মানে তা তিন মাস করতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, করোনার কারণে এ ছাড় দেওয়া হয়েছিল। করোনার প্রভাবের পর বৈশ্বিক মন্দার কারণে এ খাতে ছাড় দেওয়া হচ্ছে। এর প্রভাব কেটে গেলে তা তুলে নেওয়া হবে। আগে খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা আন্তর্জাতিক মানেই ছিল। ২০২০ সালে তা শিথিল করা হয়।
আইএমএফ’র আরেকটি শর্ত অনুযায়ী ইতোমধ্যে ডলারের বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। আইএমএফ বলেছে, এটি বাজারে সব সময় প্রয়োগ করতে হবে। কোনো হস্তক্ষেপ করা যাবে না। আইএমএফ’র আরও একটি প্রধান শর্ত হচ্ছে, রাজস্ব আয় বাড়ানো। বর্তমানে বাংলাদেশের কর জিডিপি অনুপাত ১০ শতাংশের নিচে। আইএমএফ এটিকে ১৪ শতাংশে উন্নীত করতে বলেছে। এ প্রসঙ্গে সরকারের সিদ্ধান্ত হচ্ছে, রাজস্ব আয় বাড়ানোর পদক্ষেপ চলমান আছে, এটি থাকবে।
আইএমএফ বাংলাদেশে মিশন শেষ করে তারা ওয়াশিংটনে ফিরে গিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে তা তাদের প্রধান কার্যালয়ের উচ্চপর্যায়ে উপস্থাপন করবে। তার আলোকে নির্বাহী বোর্ডের সভা হবে। ওই সভায় ঋণ অনুমোদনের প্রক্রিয়াটি চূড়ান্ত হবে। এটি চূড়ান্ত হতে ২ থেকে ৩ মাস সময় লাগতে পারে। তবে বাংলাদেশ যে এবার আইএমএফ থেকে ঋণ পাবে সেটি আগেই তারা আভাস দিয়েছে। তিনটি কিস্তিতে এ ঋণ দেওয়া হবে।