মুহাম্মদ মাসুদ আলম ॥
দেশের সব ধরনের খাদ্য সামগ্রীতে এখন ভেজাল মিশ্রিত হয়ে বাজারজাত হচ্ছে। এক শ্রেনীর অসাধু ব্যবসায়ীরা অধিক মুনাফা অর্জন করতে পরিকল্পিতভাবে করছে এ জঘন্যতম কাজ। মানুষের দৈনন্দিন চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় খাদ্য সমাগ্রী ক্রয় করতে হচ্ছে। শিশু, যুবক ও বৃদ্ধ সকল শ্রেনীর মানুষের স্বাস্থ্য রক্ষায় ভিন্ন ভিন্ন খাদ্যের চাহিদা থাকে। তবে এসব খাদ্য সামগ্রীর মধ্যে ফল সব শ্রেনীর মানুষের কাছে আকর্ষণ একটু বেশী। ফলে ভিটামিনের অংশ বেশী থাকার কারণেই হয়তো স্বাদ গ্রহন করতে আগ্রহী। কিন্তু বর্তমান বাজারে যে সব ফল বিক্রি হচ্ছে এর অধিকাংশ ফলেই কম-বেশী ফরমালিন মিশ্রিত হচ্ছে।
সরকার অবৈধ পন্থায় ফলের মধ্যে ফরমালিন বন্ধে চলতি বছরেই একটি আইন করেছে। এরপূর্বেও এই বিষয় আইনি বিধান ছিলো। কিন্তু আইনের প্রয়োগ না থাকায় এখনো প্রকাশ্যে বিক্রি হচ্ছে ফরমালিন যুক্ত ফল। আর এসব ফল খেয়ে প্রতিদিন স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে দেশের কোটি কোটি মানুষ। ফরমালিন যুক্ত ফল বাজারে সরবরাহ বৃদ্ধির পর থেকে এখন ফলের দোকানগুলোতেও আগের মত ভীড় দেখা যায় না। আর ব্যবসায়ীরা যেভাবে ফল সাজিয়ে রাখছে, তাতে ঘ্রাণ থাকলেও বিষক্রিয়ার কারণে কোন মাছি কিংবা পোকা মাকড়ও ফলের উপর বসছে না। হাট-বাজারে ঘুরলে ফলের দোকানের এমন চিত্রই বেশী চোখে পড়ে।
জাতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদনের মাধ্যমে জানাযায়, দেশে ভয়াবহ মাত্রায় মাছ, শাক-সবজি ও ফলমূলে ফরমালিন ব্যবহার হলেও এটি নিয়ন্ত্রণে কোন আইন ইতোপূর্বে দেশে ছিল না। এতে করে দেশে ফরমালিনের ব্যবহার ভয়াবহ আকারে বেড়ে যায়। রাজধানী থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে এর বিস্তার লাভ করে। জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়ার মতো অবস্থা তৈরি হয়। তাই এর অপব্যবহার বন্ধে বর্তমান সরকার ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১৩ প্রণয়ন করেছে। এটি ফরমালিন নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি একক আইন। আইনের শুরুতেই বলা হয়েছে, যেহেতু ফরমালিন আমদানি, উৎপাদন, পরিবহন, মজুদ, বিক্রি ও ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ এবং ক্ষতিকর পদার্থ হিসেবে অপব্যবহার রোধ করার লক্ষ্যে বিধান করা সমীচীন ও প্রয়োজনীয় তাই এই আইন প্রণয়ন করা হলো। এই আইনটি ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১৩ নামে অভিহিত করা হয়। যাতে সর্বোচ্চ ১০ বছর ও সর্বনি¤œ ৫ বছর সশ্রম কারাদন্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
যদিও এর আগে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, পিউর ফুড অর্ডিন্যান্স ১৯৫৯ ও স্পেশাল পাওয়ার এ্যাক্ট ১৯৭৪ বিদ্যমান রয়েছে। এসব আইনে পণ্যের সঙ্গে কেমিক্যাল, ফরমালিন মেশানোর জন্য তিন বছরের কারাদন্ড ও সর্বোচ্চ ২ লাখ টাকা অর্থদন্ডের বিধান রাখা হয়েছে। কিন্তু এসব আইনে খোলাবাজারে বিক্রি, অবাধে ব্যবহার ও সহজে প্রাপ্যতা রোধে কোন শাস্তির বিধান রাখা হয়নি। ফলে তিনটি বিদ্যমান আইন থাকলেও ফরমালিন ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না। আর এ কারণেই কঠোর শাস্তি ও অর্থদন্ডের বিধান রেখে ফরমালিন আইন প্রণয়ন করা হয়েছে।
সম্প্রতি বিদেশ থেকে মাছ ও ফলে ফরমালিন সনাক্তকারী কিট বের হয়েছে। এসব কীট মূল্য বেশী হলেও পরীক্ষা খরচ খুবই কম। তবে জেলা সদর, উপজেলা ও মফস্বল এলাকার বাজারে বাজার কমিটি, সমিতি, ব্যাক্তিগত উদ্যোগ ও বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে এসব কীট মেশিন ক্রয় করে পরীক্ষার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। আর ফরমালিন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য জনপ্রতিনিধিগণও বিশেষ ভূমিকা পালন করার সুযোগ রয়েছে বলে বিভিন্ন সভা ও গণমাধ্যমে আলোচনা হয়ে আসছে।
সম্প্রতি চাঁদপুর জেলা প্রশাসনের কার্যালয়ে মাসিক সভায় ফরমালিন বিষয়ে আলোচনা হয়। জেলা প্রশাসক মো. ইসমাইল হোসেন উপস্থিত সকলের মাঝে ফরমালিনের ভয়াবহতার সংক্ষিপ্ত চিত্র তুলে ধরেন। আপেল ও অন্যান্য ফলে যে পরিমাণ ফরমালিন যুক্ত হয়, তা পানিতে বেশ সময় ধরে রেখে খেলে স্বাস্থ্য ঝুঁকি কম থাকে। কিন্তু আঙ্গুর ফলে যে পরিমাণ ফরমালিন থাকে তা যে কোন মানুষের দেহে প্রবেশ করলে মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। সবচেয়ে বেশী ঝুঁকিতে পড়ার আশংকা থাকে শিশুদের।
সম্প্রতি চাঁদপুরে এক সংবাদকর্মী শহরের বাসস্ট্যান্ড এলাকার ফলের দোকান থেকে একটি আপেল খায়। ওই দিন রাত থেকেই তার গলার মধ্যে ক্ষত হয়ে দুই সপ্তাহ গলার রোগে আক্রান্ত থাকে। পরে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ঔষধ সেবনের মাধ্যমে রক্ষা পায়।
একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার জানান, কিছু অসৎ ব্যবসায়ী ভোক্তাদের প্রতারিত করে অধিক মুনাফা লাভের জন্য এ কাজ করে। খাদ্য বেশিদিন সংরক্ষণ করে মজুদদারীর জন্যও এ অপকর্ম করে। এধরনের খাদ্য গ্রহণ মানব দেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ। অসাধু ব্যবসায়ীরা শাকসবজি, মাছ, গোশত, ফলমূল বেশিদিন তাজা রাখার উদ্দেশ্যে ফরমালিন, কারবাইড ইত্যাদি ব্যবহার করে থাকেন। এসব কেমিক্যাল একধরনের বিষ, যা খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু হবে না; কিন্তু ধীরে ধীরে মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়।
এছাড়াও ফরমালিন যুক্ত খাদ্য আমাদের দেহে নানান রোগের সৃষ্টি করে। যেমন প্যানক্রিয়েটাইটিস, লিভার ক্যান্সার, ইপিগ্যাস্ট্রিক পেইন, খাদ্যনালির ঘা, ইরাইথমিয়া, সোরিয়াসি, গ্যাস্ট্রিক, আলসার, অন্ত্রনালির প্রদাহ, ফুসফুসে পানিজমা, কোলন ক্যান্সার, জন্ডিস, চর্মরোগ, পেটের পীড়া, আমাশয়, উদরাময়, কিডনী ও নেফ্রনের ক্ষতি, দ্রুত বার্ধক্য আনয়ন, সেক্সুয়াল ডিসফাংশন, শিশুদের অপুষ্টি রোগ, এলার্জিসহ নানা রকম শারীরিক ক্ষতি ঘটিয়ে থাকে। বিশেষজ্ঞদের মতে ফরমালিন যুক্ত খাবার ক্রয় করা থেকে বিরত থাকা ও জনসচেতনাই পারে এই ভয়াভহতা থেকে রক্ষা করতে।
শিরোনাম:
সোমবার , ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ , ৫ ফাল্গুন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।