প্রতিনিধি
আজ ৫ জানুয়ারি বহুল আলোচিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ। যদিও এ নির্বাচন ঠেকাতে সারাদেশে হরতাল ও অবরোধ চলছে। তবে চাঁদপুরসহ দেশের পাঁচটি জেলায় এ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ হচ্ছে না। কারণ, এসব জেলার সব ক�টি আসনেই প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে গেছেন। চাঁদপুর জেলার পাঁচটি আসনেই আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীরা দশম জাতীয় সংসদের এখন সংসদ সদস্য। তবে এঁরা এখনো বেসরকারিভাবে নির্বাচিত এমপি। আজকের ভোটগ্রহণ শেষে ফলাফল ঘোষণার পর গেজেট প্রকাশ হয়ে গেলেই তাঁরা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় সংসদ সদস্য হয়ে যাবেন। চাঁদপুরের যে পাঁচজন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি নির্বাচিত হয়েছেন তাঁদের মধ্যে চার জন এর আগে এক ও একাধিকবার এমপি ছিলেন। আর এই প্রথম বারের মতো এমপি হয়েছেন চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ড. মোহাম্মদ শামছুল হক ভূঁইয়া। তিনি চাঁদপুর-৪ (ফরিদগঞ্জ) আসন থেকে দশম জাতীয় সংসদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি নির্বাচিত হন। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত চাঁদপুরের অন্য চার এমপি হচ্ছেন ঃ চাঁদপুর-১ (কচুয়া) আসনে ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর, চাঁদপুর-২ (মতলব উত্তর ও মতলব দক্ষিণ) আসনে মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীর বিক্রম, চাঁদপুর-৩ (সদর ও হাইমচর) আসনে ডাঃ দীপু মনি এবং চাঁদপুর-৫ (হাজীগঞ্জ ও শাহরাস্তি) আসনে মেজর (অবঃ) রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম।
এই নির্বাচন কারো মতে গণতন্ত্র রক্ষার নির্বাচন, কারো মতে সংবিধান রক্ষার নির্বাচন, কারো কারো মতে প্রহসনের নির্বাচন, আবার কেউ কেউ বলছেন ক্ষমতায় থাকার নির্বাচন। তবে যে যাই বলুক নির্বাচন হচ্ছে। নির্বাচনী প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে প্রয়োজনীয় সকল প্রকার প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে নির্বাচন কমিশন। শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচনের লক্ষ্যে ইতিমধ্যে মাঠে নামানো হয়েছে সেনা সদস্যদের। তাদের পাশাপাশি মাঠে থাকছে র্যাব, বিজিবি ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যগণ। নির্বাচনী কাজে আরো সহযোগিতা প্রদানের লক্ষ্যে রাখা হয়েছে আনসার বাহিনীর মহিলা ও পুরুষ সদস্যদের। এতো নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও চলছে সহিংস ঘটনা। বলা আছে নির্বাচনী কাজে বাধা প্রদান দণ্ডনীয় অপরাধ। এই দণ্ডনীয় অপরাধের কথা জেনেও থেমে নেই বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট। তারা এ নির্বাচন প্রতিহত করতে বিক্ষিপ্ত ভাংচুর, আগুন ও সহিংসতার মধ্য দিয়ে চালিয়ে যাচ্ছে লাগাতার কর্মসূচি।
গত ২৫ নভেম্বর দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে ১৮ দলের লাগাতার হরতাল অবরোধ শুরু হয় তফসিল বাতিলের দাবিতে। এ আন্দোলনে চাঁদপুরেই বিএনপি-জামাতের তিনজন নিহত হয়। এর আগে অক্টোবরে ফরিদগঞ্জ ও চাঁদপুরে চারজন নিহত হয়। এরা সবাই পুলিশের সাথে সংঘর্ষে মারা যায়। আজকের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রতিহত করতে গত ৩০ ডিসেম্বর সোমবার রাতে অনির্দিষ্ট কালের অবরোধ কর্মসূচির ঘোষণা দেন বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা খন্দকার মাহবুব হোসেন। এর আগে ২৬ নভেম্বর থেকে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে ৫ দফায় মোট ২২ দিনের অবরোধ কর্মসূচি পালন করে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট। এর সাথে যোগ হয় হরতাল এবং জামায়াত নেতা যুদ্ধাপরাধী আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের ঘটনায় সহিংসতা। এতকিছু পার করে আজ অনুষ্ঠিত হচ্ছে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ।
নির্বাচন প্রতিহতকারীদের ডাকা ২ দিনব্যাপী হরতালের শেষ দিন এই নির্বাচন নির্ধারিত থাকায় স্বাভাবিকভাবে ভোটারসহ ভোট কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের মাঝে সংশয় ও সহিংসতার ভয় দূর হচ্ছে না। তবে নির্বাচন কমিশন ভোট কাজে নিয়োজিতদের সাহস জোগাতে অর্থনৈতিক সহযোগিতার ঘোষণা দিয়েছেন ইতিমধ্যে। যারা নির্বাচনী দায়িত্ব পালনকালে নিহত হবেন তাদেরকে ৫ লাখ টাকা, আর যারা মারাত্মক আহত হবেন তাদেরকে ২ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে। আর যারা নির্বাচনী কাজে বাধা প্রদান পূর্বক নির্বাচনী কার্যক্রম ব্যাহত করবে ঐ সকল দোষী ব্যক্তিকে ২ থেকে ৭ বছরের সাজা প্রদানসহ অর্থদণ্ডেরও ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। তবে এবারে নির্বাচনে সবচে� লক্ষ্যণীয় দিক হলো�জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩টি আসনের প্রার্থীরা ইতিমধ্যেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। যা বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ১৫৩টি আসন বাদ দিলে বাদ বাকি ১৪৭টি আসনে আজ ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আর এই ১৪৭টি আসনের নির্বাচন প্রতিহত করতেই মরিয়া হয়ে মাঠে নেমেছে ১৮ দলীয় জোট। তাদের সহিংসতার কারণে অনেকেই আতঙ্কিত। তবে সহিংস, অহিংস যাই থাকুক না কেনো, নির্বাচন কমিশনের আহ্বানে এবার নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মাত্র ১২টি দল। আর এই ১২টি দলের ১৪৭টি আসনে প্রার্থী সংখ্যা ৩৯০। অথচ নির্বাচন কমিশনের রেজিস্ট্রিকৃত দল হলো ১৪০টি। দেখা যায়, বিরোধী দলসহ একটি বৃহৎ অংশই নির্বাচনী কার্যক্রমে অংশ নেয়া থেকে নিজেদেরকে দূরে রেখেছে। যার জন্যই এই নির্বাচন অনেকের কাছে অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। তবে প্রশ্ন যাই থাকুক, এবারের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেশের ৫২ শতাংশ ভোটার তাদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। আর ১৪৭টি আসনে ভোট প্রদান করবেন ৪ কোটি ৩৯ লাখ ৪৮ হাজার ৯৩৮ জন ভোটার। এবার নির্বাচনে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কমনওয়েলথভুক্ত দেশের পর্যবেক্ষরা না আসলেও পর্যবেক্ষক হিসেবে থাকছে সার্কভুক্ত ভারত, ভুটানসহ জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থার প্রায় দশ সহস্রাধিক পর্যবেক্ষক।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হলো কিশোরগঞ্জ-৪ আসনের ভোটার রাষ্ট্রপতি অ্যাডঃ মোঃ আঃ হামিদ, ঢাকা-১০ আসনের ভোটার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ঢাকা-১১ আসনের ভোটার প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী মোঃ রকিব উদ্দিন ভোট দিতে পারছেন না ঐ সকল আসনের প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার কারণে।
এদিকে রংপুর-৩ আসনের ভোটার সাবেক রাষ্ট্রপতি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ভোটাধিকার প্রদান নিয়েও রয়েছে সংশয়। কারণ তিনি ইতিমধ্যে তাঁর প্রার্থিতা প্রত্যাহারসহ নির্বাচন বয়কটের ঘোষণা দেয়ায় তাঁর ভোট প্রদান অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে। অপরদিকে বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার দল নির্বাচন প্রত্যাহারসহ প্রতিরোধের ঘোষণা দেয়ায় তাঁর ভোটাধিকার প্রদানের আর কোনো বাস্তবতা দেখা যায় না। এত কিছু মিলিয়ে আজ ভোট হচ্ছেই। তাই ভোটের গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু আছে বা নেই তা প্রমাণ হয়ে যাবে আজকের ভোট দান পর্ব শেষ হয়ে গেলেই। কত শতাংশ ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রদান করে তা ভোট পর্ব শেষ হলেই স্পষ্ট হয়ে যাবে।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কার্যক্রম শেষ হলে আগামী ২৪ জানুয়ারির আগে সাংসদের শপথ বা সংসদ গঠন হচ্ছে না। আইন ও সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতায় ২৪ জানুয়ারির পরপরই সংসদ সদস্যদের গেজেট, শপথ গ্রহণ করা হবে। তবে চলতি মাসের শেষ সপ্তাহের মধ্যেই নতুন সরকার শপথ গ্রহণ করতে পারে।