চিকিৎসা বিজ্ঞানী হ্যানিম্যান জার্মানির স্যাক্সানি প্রদেশের মিশেন নামক গ্রামে ১০ এপ্রিল ১৭৫৫ সালে জন্ম গ্রহণ করেন। তার জন্মদিনকে আবর্তিত করে বিশ্ব হোমিওপ্যাথি দিবস পালন করা হয়। বিজ্ঞানী ডাঃ হ্যানিম্যান কর্তৃক হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা প্রণালী সর্ব প্রথম প্রবর্তিত হয়।
হ্যানিম্যানের জীবন কাহিনী এক মহান বিপ্লবের ইতিহাস। অষ্টাদশ শতাব্দীর চিকিৎসা জগতে যে নৈরাজ্য, নীতিহীনতা ও অমানবিক প্রথাসমূহ প্রচলিত ছিল হ্যানিম্যান তার বিরুদ্ধে সদৃপ্ত বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। এর জন্য তাকে সমকালীন স্বার্থান্বেষী মানুষের হাতে অশেষ লাঞ্ছনা, অমানুষিক নির্যাতন ও নিষ্ঠুর অত্যাচার ভোগ করতে হয়। তিনি সেই সব হাসিমুখে বরণ করে নেন এবং কঠোর সংগ্রাম ও সাধনার মধ্য দিয়ে আর্তমানবের দুঃখ মুক্তির জন্য এব ধ্র“ব সত্য ও পথ আবিষ্কার করেন। তার সমগ্র জীবন অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রাম এবং সমগ্র মানবজাতির কল্যাণ সাধনে উৎসর্গীকৃত। বস্তুত পক্ষে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মনীষী ও মহাপুরুষগণের মধ্যে ডা. স্যামুয়েল ক্রিশ্চিয়ান ফ্রেডারিক হ্যানিম্যান অন্যতম।
১৭৭৯ সালে তৎকালীন প্রচলিত চিকিৎসাশাস্ত্রে এম.ডি. ডিগ্রিপ্রাপ্ত ‘ডা. স্যামুয়েল হ্যানিম্যান’ ১৭৯৬ খ্রিস্টাব্দে আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা পদ্ধতি হিসাবে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। বিজ্ঞান মানে যদি বিশেষ জ্ঞান হয় আর হোমিওপ্যাথি যদি একটি বিশেষ জ্ঞান তপস্যার ফল হয় তবে হোমিওপ্যাথিও একটি আদর্শ বিজ্ঞান।
শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে জগতে হোমিওপ্যাথির গ্রহণযোগ্যতা, প্রচার, প্রসার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাথে সাথে এই চিকিৎসা ব্যবস্থা আজ বাংলাদেশও সমাদৃত। পৃথিবীজুড়ে হোমিওপ্যাথি ক্রমান্বয়ে বিজ্ঞানমনস্ক চিকিৎসক ও সচেতন রোগিদের অন্তরে স্থান করে নিচ্ছে। জনকল্যাণমূলক এই পেশায় শিক্ষা পরিচালনা করার জন্য রয়েছে বাংলাদেশে একটি বোর্ড। প্রতিবছর হোমিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরীক্ষা অনুষ্ঠানের যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ, ফলাফল প্রকাশ, নম্বরপত্র বন্টন ইত্যাদি কাজ করে থাকে এই বোর্ড। পরীক্ষা অনুষ্ঠানের কার্যাবলীর জন্য একটি পৃথক পরীক্ষা পরিষদ রয়েছে। বোর্ডের সুপারিশের ভিত্তিতে সরকারের অনুমোদনক্রমে প্রতিবার এক বছরের জন্য পরীক্ষা পরিষদ গঠিত হয়। ৪২টি ডিপ্লোমা হোমিও কলেজের পাশাপাশি ঢাকায় একটি বেসরকারি ও মিরপুরে একটি সরকারি হোমিওপ্যাথি ডিগ্রি কলেজ রয়েছে এবং দুটি হোমিওপ্যাথিক কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। হোমিওপ্যাথিক বোর্ডের অন্যতম কাজ হলো হোমিও কলেজ থেকে হোমিওপ্যাথি পেশায় আগমনে ডিপ্লোমা চিকিৎসকদের নিবন্ধন প্রদান ও তদারকি করা। শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে বোর্ড কোন কাজই সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতেপারে না।
বোর্ডের নিয়ন্ত্রণাধীন হোমিওপ্যাথিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ মূলত ছাত্র বেতন নির্ভর। এই উৎস হতে প্রাপ্ত অর্থ দ্বারাই কোন ক্রমে চলতে হচ্ছে। ফলে কলেজগুলিতে শিক্ষা উপকরণ সংগ্রহের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এই সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ইহাদের শিক্ষক / কর্মচারীগণ হতাশাগ্রস্থ জীবনে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ঝুঁকি নিয়ে কালাতিপাত করছেন। হোমিও বোর্ড সরকারিভাবে কোন হোমিও ডিপ্লোমা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। ফলে হোমিও বোর্ডের ডিপ্লোমা শিক্ষা কার্যক্রম স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের স্বীকৃতি নেই। এই কারণে সরকারি কোন হাসপাতালে হোমিও ডিপ্লোমাধারীদের নিয়োগের জন্য পদ সৃষ্টি করা হয়নি।
একমাত্র সরকারি হোমিওপ্যাথি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে হাতেগোনা কয়েজন রোগি ভর্তি থাকে। ডিপ্লোমা সনদ প্রদানকারী কলেজসমূহের রোগি সংশ্লিষ্ট কোন হাতে কলমে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই। বিগত দিনে হোমিও বোর্ডও এ ব্যাপারে দৃশ্যমান জোড়ালো কোন উদ্দ্যোগ গ্রহণ করেনি। বিগত শতাব্দীর শেষ কয়েক দশক থেকে রোগের জটিলতা বাড়ছে, জীবন-যাত্রার জটিলতাও বাড়ছে সমানভাবে। অর্থনীতি, তথ্যপ্রযুক্তি, শিক্ষাখাত, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও কৃষিতে যে পরিমাণ উন্নতি হয়েছে সে তুলনায় পিছিয়ে আছে দেশের সামগ্রিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। একটি সুস্থ্য জাতি গঠনে রাষ্ট্রের চিকিৎসা ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা ও সমস্যা যতই বৃদ্ধি পাবে, আমরা পিছিয়ে পড়বো ততই। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে রোগির চিকিৎসার জন্য এমন এক পদ্ধতির প্রয়োজন যা সহজে, স্বল্পতম ব্যয়ে জটিল-কঠিন-দীর্ঘস্থায়ী রোগের চিকিৎসা হয়। আমাদর দেশ বিদ্যায়-বিত্তে দরিদ্র, অধিকাংশজন অজ্ঞ-অনক্ষর-অসহায়-নিঃস্ব, নিরন্ন। যাঁদেরকে দু’মুটো ভাতের চিন্তা দিন রাত মগ্ন থাকতে হয়। এক্ষেত্রে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা ব্যবস্থাকে জনগণকেন্দ্রীক করতে পারলে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় কল্যাণমুখী চেতনার উন্মেষ হতো।
প্রথমেই হোমিও শিক্ষা কাঠামো পরিবর্তন প্রয়োজন। বর্তমানে প্রচলিত ডিএইচএমএস শিক্ষা কোর্স সমন্বিতভাবে পরিচালনাসহ হোমিওপ্যাথিতে ডিপ্লোমা নার্সিং, মেডিকেল এ্যাসিস্ট্যান্ট ও হোমিও ফার্মাসিস্ট তৈরির জন্য আরও তিনটি নতুন কোর্স প্রবর্তন অতীব জরুরি। তাছাড়া হোমিও রিসার্চ সেন্টার স্থাপনের কার্যক্রম হাতে নেয়া গুরুত্বের প্রতীক। গবেষণাকাণ্ড এ শাস্ত্রের উন্নয়নের পাশাপাশি দেশের চিকিৎসা সুবিধা বঞ্চিত জনগণের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে মহান ভূমিকা পালন করবে। কেবল দিবস পালন নয়, প্রয়োজন সমন্বিত শিক্ষা গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা। হোমিও শিক্ষাকে একটি আদর্শনীতিতে আনয়নের মাধ্যমে এই শিক্ষাকে জনপ্রিয় করতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা পরিচালনা ছাড়া এর যথাযথ মূল্যায়ন ও স্বীকৃতি সম্ভব নয়। আসুন স্বল্পমূল্যের সহজলব্য হোমিও চিকিৎসা শিক্ষাকে গণমুখী করার নিরন্তর প্রয়াসে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই।
শিরোনাম:
বুধবার , ১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দ , ১৯ মাঘ, ১৪২৯ বঙ্গাব্দ
এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।