নারী শিক্ষার প্রসার ঘটানোর লক্ষ্যে ফরিদগঞ্জের ১নং বালিথুবার লোহাগড় গ্রামের বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন ও চান্দ্রা ছামাদিয়া ফাজিল মাদ্রাসার সাবেক অধ্যক্ষ মরহুম মাওলনা তাজুল ইসলাম ১৯৮৪ সালে তাঁর নিজ বাড়ির সামনে নিজ সম্পত্তির উপর গড়ে তোলেন মুক্তিযুদ্ধের শহীদ খন্দকার আতাউর রহমানের নামে একটি মহিলা দাখিল মাদ্রাসা। তার মূল ইচ্ছা ছিলো ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলবেন এ এলাকার অবহেলিত নারীদের। তিনি অনেকটা সফল হতেও চলেছিলেন। কিন্তু অর্থলোভী কিছু শিক্ষক ও এলাকার কিছু কুচক্রী মহলের কারণে এ বালিকা মাদ্রাসাটি তার মৃত্যুর আগে সঠিক স্থানে নিতে ব্যর্থ হন। বর্তমানে বাংলাদেশে বড় বড় দুর্নীতির সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিও হয়ে পড়েছে অনিয়ম আর দুর্নীতির আখড়া । গত ক’মাস যাবৎ মাদ্রাসা এলাকায় কিছু ছাত্রী, অভিভাবক, এলাকাবাসী এবং সুশীল সমাজের অনুরোধের প্রেক্ষিতে মাদ্রাসায় গিয়ে হুবহু তার সব অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া যায়।
লোহাগড় রাস্তা দিয়ে অসময়ে যাওয়া অত্র মাদ্রাসার ক’জন ছাত্রীর সাথে কথা হলে তারা জানান, আমাদের ক্লাসে শিক্ষক নাই, তিনি কোথায় জানি গেছেন, তাই আমরাও বাড়ি থেকে ঘুরে আসি। আরো কিছু কথা জানতে চাইলে এ ছাত্রীরা জানায়, স্যারে মাদ্রাসায়তো পড়াতে আসে না, হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করতে আসেন। এ ছাত্রীরা শিক্ষকদের বিষয়ে বিভিন্ন রকম ব্যঙ্গ করে কথা বলতে দেখা গেছে। কেন ছাত্রীরা শিক্ষকদের ব্যাপারে ব্যঙ্গ করে কথা বলছে এ বিষয়ে মাদ্রাসা এলাকার কিছু দোকানে আড্ডারত ক’জনের সাথে জানতে চাইলে তারা জানান, শিক্ষকরা যেমন তাদের ছাত্রীরাও তেমন। শিক্ষকদের মাদ্রাসা ফাঁকি দেয়া, দু এক ঘণ্টা করে চলে যাওয়া, ক্লাস না করে ঘুরে ফিরে বাড়িতে চলে যাওয়া যেনো এ মাদ্রাসার নিয়ম। এলাকার অসংখ্য অভিভাবক ও সুশীল সমাজের অভিযোগের ভিত্তিতে জানা যায়, গত রমজান মাসে এক বিত্তবান ব্যক্তি গরিব ছাত্রীদের ১০ হাজার টাকা দিয়েছিল ঈদের পোশাক কিনতে এবং ঐ লোক ছাত্রীদের হাতে হাতে এ টাকা বন্টন করে দেন। কিন্তু তিনি মাদ্রাসা ত্যাগ করার পর পরই গনি মাস্টার ও মান্নান মাস্টারসহ ক’জন মিলে সে টাকা আবার তুলে নিয়ে যায়। এ ছাড়া টিআর-এর ২ টন চাল আসলে মাদ্রাসার সভাপতি সরকারি বিভিন্ন অফিসের খরচ দেখিয়ে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষকে মাত্র ৫ হাজার টাকা দেন এবং এলজিএসপি প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ৫০ হাজার টাকা আসলেও মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষকে দিয়েছেন মাত্র ২০ হাজার টাকা। অন্যদিকে এলাকার কিছু বিত্তবান ব্যক্তি মাদ্রাসা উন্নয়নের জন্যে কয়েক লাখ টাকা দিলেও তার কোনো হদিস নেই। এছাড়া মাদ্রাসা মেরামতের জন্যে কাঠের প্রয়োজন হলে এলজিএসপি হতে পাওয়া ২০ হাজার টাকা দিয়ে মাদ্রাসা মাঠের গাছ ১৮ হাজার টাকায় ক্রয় দেখিয়ে সে টাকা নিজেরা হজম করে ফেলে। অত্র মাদ্রাসার ছাত্রীদের উপবৃত্তির টাকা নিয়ে প্রতিনিয়ত চলছে আরেক ছিনিমিনি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ক’জন ছাত্রী ও অভিভাবক জানান, মেয়েরা উপবৃত্তির টাকা পেলে গণি মাস্টারসহ ক’জন শিক্ষক বিভিন্ন ওজর আপত্তি দেখিয়ে উপ-বৃত্তির টাকার কিছু অংশ কেটে রেখে দেন। এছাড়া কোচিং ও প্রাইভেট পড়ানোর নামে চলে অতিরিক্ত টাকা আদায়ের প্রতিযোগিতা।
নতুন করে মাদ্রাসা শিক্ষক নিয়োগের নামে উঠে এসেছে সবচেয়ে বড় দুর্নীতির কথা। এলাকার অসংখ্য মানুষের মুখে শোনা গেছে, শিক্ষক নিয়োগে ৩ জনের কাছ থেকে ঘুষ হিসেবে নেয়া হয়েছে সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা। যার মধ্যে দুজনের কাছ থেকে দু লাখ করে চার লাখ আর একজনের কাছে দেড় লাখ টাকা নেয়া হয়। অন্য আরেকজন শিক্ষক নিয়োগে চলছে টালবাহানা। এ সব নিয়ে মাদ্রাসার সুপার মোঃ শাহ আলমের সাথে কথা হলে তিনি জানান, মাদ্রাসার সভাপতি কতো টাকার চাল বিক্রি করেছে তা জানি না, কিন্তু তিনি মাদ্রাসা তহবিলে ৫ হাজার টাকা দিয়েছেন। এল.জি.এস.পি.র ৫০ হাজার টাকা কাগজে কলমে থাকলেও আমি ২০ হাজার টাকা পেয়েছি। এছাড়া মাদ্রাসা মাঠের একটি গাছ কেনা দেখিয়েছেন সেটাও সত্যি। গরিবদের পোশাক কেনার জন্যে যে টাকা বন্টনের কথা বলা হয়েছে সেদিন আমি ছিলাম না, তাই বলতে পারবো না। অন্য বিষয়গুলোর ব্যাপারে তিনি স্বীকার না করলেও বলে গেছেন, যা কিছু করা হয়েছে তা মাদ্রাসার স্বার্থের জন্যে করা হয়েছে এবং মাদ্রাসা কমিটির সভাপতি এসব ব্যাপারে ভালো জানেন। এ প্রতিনিধি মাদ্রাসার এসব কার্যকলাপ নিয়ে পত্রিকায় প্রতিবেদন করবে শুনে সভাপতি মোঃ হারুন এ প্রতিনিধিকে ফোন করে জানান, মাদ্রাসায় যে দু টন চাল দেয়ার কথা বলা হয়েছে সে চাল বর্তমান এমপি সাহেব মাদ্রাসাকে দেন নি, আমি দলের জন্য কষ্ট করি, তাই আমাকে দিয়েছেন। আমি আমার ভাগ থেকে মাদ্রাসাকে ৫ হাজার টাকা দিয়েছি। অন্যদিকে এল.জি.এস.পি.’র ৫০ হাজার টাকার ব্যাপারে তিনি জানান, এ টাকার অনেক ভাগ বিভিন্ন অফিস নিয়ে গেছে, বাকি টাকার ২০ হাজার পেয়ে মাদ্রাসাকে দিয়েছি এবং বাকি টাকা পরে দেবেন বলে জানান। এ ছাড়া শিক্ষক নিয়োগের যে সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা ঘুষ নেয়া হয়েছে সে বিষয়ে তিনি জানান, মাদ্রাসার স্বার্থেই যা কিছু করার করা হয়েছে এবং নিয়োগ কমিটির মাধ্যমে সব কিছু করা হয়েছে। পরে তিনি অন্য পত্রিকার ক’জন সাংবাদিকের মাধ্যমে এ প্রতিনিধিকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে সংবাদটি বন্ধ রাখার জন্যে অনুরোধ করেন।
ফরিদগঞ্জের লোহাগড় আতাউর রহমান দাখিল মাদ্রাসাটিতে এতসব অনিয়মের কারণে নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। বছর বছর ছাত্রী কমতে কমতে এখন শুধু মাদ্রাসা ভবন ও শিক্ষক মণ্ডলী বাকি থাকার অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। এলাকাবাসীর বিশ্বাস, বর্তমান সভাপতি ও গণি মাস্টারকে সরিয়ে দিলেই মাদ্রাসাটি অতীতের ন্যায় আবার প্রাণ ফিরে পাবে।