হাসানুজ্জামান ,
ভিখারিনী নুরজাহান (৫৫) এখনও স্বামীর স্বীকৃতি পাননি। পাননি তার গর্ভের সন্মানের স্বীকৃতিও। দীর্ঘ ২৭ বছর স্বামী ও সন্তানের স্বীকৃতি পেতে তিনি মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন। দেননি কেউ সাড়া। পাননি তিনি সামাজিক স্বীকৃতি আর সুষ্ঠু বিচার। প্রতিক্ষার শেষ প্রহরে তিনি আইনের আশ্রয় গ্রহন করেছেন। এমন ঘটনাটি চাঁদপুরের শাহরাস্তি উপজেলার সূচীপাড়া উত্তর ইউনিয়নের সূচীপাড়া গ্রামে ঘটে। এব্যাপারে নুরজাহান বাদী হয়ে জেলা বিজ্ঞ আদালতে একটি মামলা দায়ের করেছেন। যার নং-২২৫/১৯।
জানা যায়, ২৭/২৮ বছর আগে ওই গ্রামের করের বাড়ির মৃত রুহুল আমিনের কন্যা নুরজাহানকে একই বাড়ির মৃত আবদুল মুনাফের ছেলে সিরাজুল ইসলাম (৬৫) ইসলামি শরা-শরীয়ত মতে স্থানিয় মৌলভীর মাধ্যমে বিয়ে করেন। ঘটনাটি দীর্ঘ বছর চাপা থাকার পর হঠাৎ চাউর হয় এলাকা জুড়ে। এনিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে চলছে নানা গুঞ্জন। মামলার নথি সূত্রে জানা যায়, জেঠাত ভাই সিরাজ ১৯৯২ সালের ৮ জুন সোমবার রাতে ২ লক্ষ টাকা দেন মোহরে স্থানিয় এক মৌলভীর মাধ্যমে নুরজাহানকে বিয়ে করেন। পূর্বে স্ত্রী থাকার কারনে ঘটনাটি গোপন রাখতে নুরজাহানের পিতার ঘরেই উঠেন তারা। সেখানেই মাঝে মধ্যে তারা স্বামী-স্ত্রীর গোপন সম্পর্ক বজায়ে রাখতেন। কাবিনের শর্ত পুরণের জন্য নুরজাহান যতই চাপ দিতেন সিরাজ ততই দিচ্ছি দিবো বলে কাল ক্ষেপন করেন। এক পর্যায়ে সিরাজের ঔরসে নুরজাহান গর্ভবতী হন। তখনই বেরিয়ে আসে সিরাজের মুল চেহারা। সিরাজ ব্যবসার জন্য ২ লক্ষ টাকা দাবী করেন। নুরজাহানে বাবা অন্ধ ছিলেন। তিনি ভিক্ষা ভিত্তি বাপ-মেয়ের আহারের ব্যবস্থা করতেন। ২ লক্ষ টাকা দেয়া অসম্ভব বলে জানায় নুরজাহান। সিরাজ ক্ষিপ্ত হয় নুরজাহানের উপর। এক পর্যায়ে পিতার জায়গা বিক্রি করে টাকা দেয়ার জন্য নুরজাহানের উপর চাপ প্রয়োগ করে সিরাজ। শুরু হয় অশান্তি আর এভাবেই বাড়ির লোকজন জানতে শুরু করে তাদের সম্পর্কের কথা। সিরাজ হুমকি দেয়, টাকা না দিলে তোকে এবং তোর গর্ভের সন্তানকে অস্বীকার করবো। এরই মধ্যে নুরজাহান একটি পুত্র সন্তান জন্ম দিলেন। নাম রাখা হলো মোঃ হানিফ মিয়া। আজ তার বয়স ২২ বছর। এবিষয়ে নুরজাহান বেগম বলেন, আমি আমার নিজ বাড়িতে খেলে ধূলে বড় হয়েছি। আমার পিতা অনেক গরীব ও অন্ধ ছিলেন। সিরাজ আমাকে বিভিন্ন ভাবে তার প্রেমের ফাঁদে ফেলে। একদিন রাতে সিরাজ আমাকে এক মৌলভীর কাছে নিয়ে যায়। সেখানে আমাকে বিয়ে করে। বিয়ের ৫ মাস পর আমার গর্ভে সন্তান আসে। আমি তাকে সন্তান আসার বার্তা জানালে সে আমার কাছে ২ লক্ষ টাকা যৌতুক দাবী করে। না দিলে সে আমার গর্ভের সন্তানকে স্বীকার করবে না। আমার গর্ভে জারজ সন্তান বলে সমাজে অপবাদ তুলবে বলে হুমকি দেয়। আমি অসহায় বলে এই সিরাজ তার লোকজন নিয়ে আমার বিরুদ্ধে গ্রাম সালিশ ডাকে। সেখানে সিরাজ অনুপস্থিত থাকে এবং সালিশদারগন সিরাজের লোকজনের কথা শুনে আমাকে নষ্টা নারী বলে আখ্যায়িত করে। সে দিন আমার পক্ষে কেউ ছিলো না। আমাকে ওই সালিশে অপবাদ ও অপরাধী স্বাব্যস্থ করে বেদম প্রহার করেছে সালিশদারগন। আজ আল্লাহ আমার দিকে মুখ তুলে তাকিয়েছেন। সত্য এবার সবার সামনে আসবে। আমি সেদিন নিরপরাধী ছিলাম। আমার না ছিলো কেউ আর না ছিলো টাকা। আজ আমার আল্লার আছে। আমি আর এখন ভয় পাইনা। আমার পুত্র হানিফের জন্মের পর আমি মুখ বুঁজে সব অপবাদ সহ্য করেছি। কারন সিরাজ হুমকি দিয়েছিলো আমার সন্তানকে তুলে নিয়ে গুম করে ফেলবে। আমি সেই ভয়ে এতো বছর চুপ করে ছিলাম। আমার সুখ আর জীবন যৌবন সবই এই সিরাজ নষ্ট করেছে। সে আজ এই সমাজে সাধু-সুদ্ধী সাজতে চায়। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, পুরো সমাজ ও সমাজবাসী এক হয়ে যদি সিরাজের পক্ষে বলে তবুও আমি বলবো হানিফ সিরাজের ছেলে। আমি তা বিজ্ঞ আদালতে প্রমান করে দেবো। সিরাজ আমার স্বামী আর হানিফ তার ছেলে-এই স্বীকৃতি পেতেই সত্যের জন্ম দিবে আদালত। মোঃ হানিফ মিয়া বলেন, আমি জানিনা আমার পিতা কে। আমার মা আমাকে বলেছেন এই সিরাজই আমার বাবা। মা আমাকে সেই শিশু বয়স থেকেই বুঝিয়েছেন বাবার কাছে না যাওয়ার জন্য। আমাকে মেরে ফেলবে। তাই আমি আর ভয়ে কোনো দিন সিরাজের সাথে সন্তানের পরিচয় নিয়ে কথা বলিনি। ২১ বছর পর স্থানিয় মসজিদে আজান দিতে নিষেধ করেন মসজিদের ইমাম। আমি নাকি জারজ সন্তান। আমি আজান দিলে নামাজ হবেনা। বিষয়টি মুসল্লি থেকে শুরু করে স্থানিয় গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গ অবহিত হন। আমাকে লোক লজ্জায় মুখ লুকিয়ে চলতে হয়। আমি আমার মায়ের সাথে পিতার অধিকার চাই। দীঘির পাড় জামেবমসজিদের ইমাম হাফেজ মোঃ নাজির আহমেদ বলেন, হানিফকে আমি চিনি এবং জানি। সে এই মসজিদের মক্তবে ছোটদের কোরআন শিক্ষা দিতো। ওয়াক্ত মত আজান দিতো। একদিন মসজিদের মুসল্লি স্থানিয় সুরুজ মিয়া আমাকে জানায়-হানিফ জারজ সন্তান। সে আজান দিলে মুসল্লিদের নামাজ হবেনা। সুরুজ মিয়া এভাবে সবাইকে বলার এক পর্যায়ে আমি হানিফকে আজান না দেয়ার নির্দেশ দেই। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, হানিফ জারজ সন্তান কি না তা আমার জানা নেই। তবে সে যদি জারজ হয় এবং এই মসজিদে আজান বা নামাজ না পড়ে তাহলে ইসমামি আইন অবমাননা করা হবে। কারন সে এই সমাজেরই সন্তান আর জারজ সন্তানের পিতা হয়তো এই মসজিদেই নামাজ আদায় করেন। এবিষয়ে সিরাজুল ইসলামের সাথে আলাপ করতে গেলে তিনি বাড়িতে নেই বলে পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা জানান। এলাকাবাসী বলেন, ঘটনাটি দীর্ঘদিনের। বর্তমান প্রজন্ম এমনটি মেনে নিতে চায় না। যে কারনে এলাকা জুড়ে রয়েছে এবিষয়ে নানা গুঞ্জন। সিরাজ হানিফের বাবা এমন কথাটি এলাকার অনেকেই জানেন। কিন্তু তাদের ভয়ে কেউ মুখ খুলছেন না। সত্যকে সত্য হিসেবে মেনে নিয়ে নুরজাহান ও তার ছেলে হানিফকে স্বীকৃতি দেয়া উচিৎ সিরাজুল ইসলামের। এমন বিবাদমান সমস্যাটি সিরাজুল ইসলাম নিজ দায়িত্বতে শেষ করে আগামী প্রজন্ম ও সমাজকে কলঙ্কমুক্ত করার উদ্বাত্ত আহবান জানান তারা।