১৯৭১-এর মাঝামাঝি একটা সময়। মুক্তিযুদ্ধের তখন উত্তুঙ্গ পর্যায়। প্রতিদিন শয়ে শয়ে মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং শেষ করে জন্মভূমিতে ফিরে যাচ্ছেন মাকে মুক্ত করার প্রতিজ্ঞাপূরণে। কলকাতার বুকে শরণার্থীদের একজন অরুন নন্দী সিদ্ধান্ত নিলেন দেশের জন্য অন্যরকম কিছু করার। বন্দুক হাতে যুদ্ধ করার সামর্থ্য তার আছে। তবে তারচেয়েও বড় এক প্রতিভা দিয়েছেন তাকে ঈশ্বর। সাঁতার। অবিরাম সাঁতরে যাওয়ার বিরল ক্ষমতা। চাঁদপুরের ছেলে তিনি। পদ্মা-মেঘনার সঙ্গমেই সাঁতার কেটে মানুষ।
পরিকল্পনা নিয়ে দেখা করলেন দূরপাল্লার সাঁতারের কিংবদন্তী এবং গুরু ব্রজেন দাসের সঙ্গে। বিক্রমপুরের কৃতি সাঁতারু ব্রজেন দাস প্রথম এশিয়ান হিসেবে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়েছিলেন। এবং একাধিকবার। পাশাপাশি ১৯৫৬ সালের মেলবোর্ন অলিম্পিকে পাকিস্তান সাঁতার দলের সদস্যও ছিলেন তিনি। অরুনের বুকের মধ্যেকার আগুনটা টের পেলেন ব্রজেন দাস। রাজী হলেন তাকে সাহায্য করতে। ব্রজেন দাসের তত্বাবধানেই বৌবাজার জিমনেসিয়ামে কঠোর ট্রেনিংয়ে নামলেন অরুন।
এখানে পরিকল্পনাটা খোলাসা করা দরকার। দূরপাল্লার সাতারু হলেও সেরকম কোনো ইভেন্ট সেসময় তার হাতের কাছে ছিলো না। এবং তাতে অংশ নেওয়াও তার জন্য সহজসাধ্য হতো না। আর ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিতে হলেও চাই যথেষ্ট সময় এবং পর্যাপ্ত অনুশীলন। তাই অরুন নন্দী ঠিক করলেন সাধ্যের মধ্যে থাকা পরীক্ষাটায় উৎরানোর, সেটা একটানা সাতার। যাকে বলে এনডিউরেন্স সুইমিং। এ ক্ষেত্রে তখন বিশ্বরেকর্ড ছিলো বি.সি মোরের। ৮৮ ঘণ্টা ৫৬ মিনিট একটানা সাঁতরে এই বিশ্বরেকর্ড গড়েছিলেন মার্কিন সাঁতারু মোর। অরুন সিদ্ধান্ত নিলেন তার রেকর্ডটাই ভাঙার।
১৯৭১ সালের ৮ অক্টোবর সকাল সাড়ে আটটায় কলকাতা কলেজ স্কোয়ারের পুকুরে নামলেন অরুন। কলকাতার চাঁদপুর সম্মিলনী এবং বৌ-বাজার ব্যায়াম সমিতির এই যৌথ আয়োজনের উদ্বোধন করলেন কলকাতায় বাংলাদেশের হাই কমিশনার হোসেন আলী। ম্যানেজার হিসেবে ব্রজেন দাস আছেন। কোনো দূর্ঘটনা ঘটলে অরুনকে উদ্ধারের জন্য তৈরি ভারতের তিন কৃতি সাতারু পিকে সরকার, দিলীপ দে ও পরেশ দত্ত। আটটা পয়ত্রিশ মিনিটে শুরু করলেন। সাঁতরে চললেন অরুন বিরামহীন। সুর্যোদয় ও সুর্যাস্তের মাঝে, গভীর সুনসান রাতে পানিতে ডানা ঝাপটান এক জলাশ্রয়ী মুক্তিযোদ্ধা।