সাবিহা ইয়াসমিন ইসলাম
ঢাকা ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪ এ প্রকাশিত একটি মরমান্তিক খবর আমাকে তাড়িত করেছে নীচের লেখাটি প্রচার করার জন্য। লিখাটি আনেকদিন ধরে তৈরি হয়ে ছিল আমার ল্যাপটপে । ইংলিশে লিখাটি আমার ফেসবুক স্ট্যাটাসে এখন ও দেয়া আছে।
যুগান্তরের প্রথম পাতাতে ৭ম কলামে উল্লিখিত একটি খবর এর হেড লাইন “ উত্তরায় ভাই বোনের ঝুলন্ত লাশ ”। ভেতরের খবর “ মা তুমি আমাদের জন্য অনেক কষ্ট করেছো ।মানুষের মত মানুষ করার চেষ্টা করেছো । কিন্তু আমরা তা হতে পারিনি । জীবনে বাবার আদর কখনো পাইনি । তবে তুমি সে অভাব কখনো বুঝতে দাওনি । তুমিই ছিলে আমাদের বাবা মা । বাবা আমাদের সঙ্গে কেন এরকম করলো? অনেক ভেবেছি তবু এ প্রশ্নের উত্তর পাইনি ——-”
খবরের বিস্লেশনে আমি যেতে চাইনা । পত্রিকাতে ছাপানো ছোট একটি খবরের পেছনে আনেক খবর থাকে যা আমাদের প্রায়ই অজানা থেকে যায় । আমি শুধু এই দুইটি বাচ্চার মর্মান্তিক পরিণতির বিশ্লেষণ করে শিশু মনঃস্তত্ব ও পারিবারিক বা পারিপার্শ্বিক পরিবেশের উপর আমার জানা কিছু তথ্য এখানে তুলে ধরতে চেষ্টা করেছি-
অনেক সময় দেখা যায়ে যে আমাদের কে আমাদের পেশা’র বাইরে এসেও কিছু কিছু বিষয়ে সাহায্য , সহযোগিতা বা পরামরশের হাত বাড়িয়ে দিতে হয় ।এমন কি অনেক সময় অনেকে গোপনীয়তা রক্ষা করতে মানসিক সমস্যা গুলোও আমাদের সাথে শেয়ার করতে চায় । আমি খুব মনোযোগ দিয়ে অন্যের কথা শুনতে এবং শুনে বুঝতে পছন্দ করি এবং প্রয়জনে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞের সহায়তা নিতে পরামর্শ দেই । এজনই হয়ত আমার সাথে শেয়ার করতে আরাম বোধ করে । শুধু মানুষের উপকারের কথা চিন্তা করে আমি কয়েক বছর ধরে মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা উপর যেখানে যখন যে লেখা পাই মন দিয়ে পড়ি , বোঝার চেষ্টা করি —–। আনেক কিছু শুনে , জেনে , বুঝে বেক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে এটা নিশ্চিত জেনেছি যে সুস্থ স্বাভাবিক ভাবে একটি শিশু বেড়ে ওঠার জন্য প্রয়োজন সুস্থ সাভাবিক আনন্দময় পারিবারিক পরিবেশ । সুস্থ পারিবারিক পরিবেশ মানে সুস্থ , সাভাবিক ভাবে বেড়ে ওঠা শিশু আমাদের নিশ্চিত নিরাপদ আগামী —-।
আমাদের যার যার নিজেদের ধর্মীয় অনুশাসনের মধ্যে সত্য ও সঠিক পথে পর্যাপ্ত ভালবাসা ও সহনশীলতা নিজেদের মধ্যে ধারন করে শিশু কিশোর মনস্তত্ত্ব উপর প্রয়োজনীয় প্রাথমিক জ্ঞান নিয়ে আমাদের শিশু কিশোরদের নিশ্চিত , নিরাপদ ভবিস্যাত তৈরি করার বিষয়ের প্রতি আনেক বেশী যত্নশীল হতে হবে ।
আমাদের এ যুগের বেশির ভাগ শিশু কিশোররা একধরনের অনিশ্চিত অস্থিরতা নিয়ে সময় পার করছে । গোলহীন অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ এর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে । তারা জানেনা কি উদ্দেশ্য নিয়ে কি গোল অর্জন করতে তারা সামনে চলছে ! কিন্তু আমরা কি ভেবে দেখি এই অনিশ্চয়তা, অস্থিরতার জন্য পরিবার , সমাজ নাকি জাতি দায়ী ? অথবা কে বা কারা দায়ী ? আসলে তো সবার আগে পরিবার , এরপর সমাজ তারপর জাতি । সুতরাং প্রতিটি পরিবার ভিন্ন ভিন্ন ভাবে দায়ী এসব পরিস্থিতির জন্য ।
একদম ছোট বেলা থেকে আমাদের শিশুদের মনে স্বপ্ন তৈরি করতে হবে । এ স্বপ্ন হবে ভবিস্যাতে একজন পরিপূর্ণ ভাবে মানুষ হবার স্বপ্ন । এ স্বপ্ন হবে সঠিক পথে থেকে সঠিক কাজ করার স্বপ্ন । এ স্বপ্ন হবে দেশ কে ভাল বাসার স্বপ্ন । এ স্বপ্ন হবে মানুষকে ভালবাসার স্বপ্ন । এই পৃথিবীর সমস্ত সৃষ্টিকে ভালবাসার স্বপ্ন , এ স্বপ্ন হবে অসহায়দের পাশে দাঁড়াবার সপ্ন । এ স্বপ্ন হবে বাবা মা’র প্রতি সম্মান ও কর্তব্য পালনের সপ্ন , এ স্বপ্ন হবে ছোটদের প্রতি দায়িত্ব পালনের স্বপ্ন । স্বপ্ন দেখা এসব শিশুদেরকে আমাদের সাহায্য করতে হবে এই স্বপ্ন আর আশার পথ ধরে সামনে চলার জন্য ।
আমাদের শিশুদের সুনিয়ন্ত্রিত ভাবে সীমাবদ্ধতার মধ্যে চলতে শেখাতে হবে । নিয়ন্ত্রনহীন , লাগামহীন জীবন পদ্ধতি কোন আশা বা স্বপ্ন তৈরি করতে পারেনা বরং সেটা শিশুদের সুন্দর ও স্বাভাবিক মানসিক বিকাশের জন্য বাঁধা হয়ে দাড়ায় । সীমাহিন ভোগ , আকাঙ্ক্ষা , লোভ লালসা ছোট বয়স থেকেই একজন কিশোররকে আপরাধ জগতের আন্ধকারে প্রবেশ করতে সাহায্য করে ।
দুর্বল পারিবারিক বন্ধন শিশুদেরকে তাদের প্রাপ্য স্নেহ , ভালবাসা এবং সুনিয়ন্ত্রন থেকে বঞ্চিত করে । পারিবারিক অথবা পিতা মাতার ঝগড়া , কলহ , উৎপীড়ন / আক্রমণ , হিংস্রতা , ক্রোধ , ক্রুদ্ধতা , আচরনের তীক্ষ্ণতা , তীব্রতা যে কোন শিশু কিশোরের সুস্থ ও সাভাবিক বিকাশে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় । বরঞ্চ হয়ত তারা অনেক সময় hypochondria বা স্নায়বিক রোগ , বিসন্নতা বা চিত্তন্মাদ রোগে আক্রান্ত হয় ।
ঠিক তেমনি লেখা পড়া বা অন্য যে কোন বিষয়ে মেধা বিকাশের ক্ষেত্র গুলির প্রতি অতি সচেতন বাবা মা’র মাত্রাতিরিক্ত চাপ শিশু কিশোরদের স্নায়ু এবং মনের উপর চাপ সৃষ্টি করে আনেক সময় তাদের বিষণ্ণ করে তোলে এবং যার অনিবার্য ফলাফল অনেকসময় মানসিক অসুস্থতাতে আক্রান্ত হয় । মানসিক অসুস্থতাতে আক্রান্ত এসব শিশুরা তখন আর তাদের নিজেদের পারিবারিক পরিবেশ আর নিজেদের জন্য নিশ্চিত নিরাপদ মনে করে না ।
আমাদের শিশুদের পরিপূর্ণ ভাবে বেড়ে ওঠার জন্য প্রয়োজন শান্তিপূর্ণ আনন্দদায়ক সুস্থ পারিবারিক পরিবেশ যেখানে তারা দেখবে পারস্পারিক স্নেহ , ভালবাসা , সহমর্মিতা ও স্রদ্ধা বোধ ।আমাদের প্রত্যেকের আমাদের শিশু কিশোরদের প্রতি অনেক বেশি ধৈর্যশীল ও সুসচেতন হয়া উচিত যাতে করে ফেরেস্তাসম আমাদের শিশুরা বিপথ গামী হয়ে অকালে তাদের ধ্বংস করে ফেলতে না পারে ।
পারিবারিক উৎপীড়ন ( domestic violence) শিশু কিশোরদের মনের উপর ভয়ঙ্কর বিরুপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করে । এই পরিবেশের সাথে শিশুরা নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে পারেনা ফলে নিজেদের মধ্যে নিজেরা বিদ্রোহ করে মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে অথবা যে নিষ্ঠুরতা বা ভয়ঙ্করটা যা তাদের দৃষ্টি পথে পতিত হয়া সে অভিজ্ঞতা তাদের উপর বিকৃত প্রভাব ফেলে সারাজীবন তাদের অন্তরে ক্ষত হয়ে রয়ে যায় ।
বিভিন্ন সময় বিভিন্ন গবেষণা হতে জানা যায় যে এসব মানসিক আসুস্থতার উপসর্গ গুলি হল শিশুদের হিংস্র একগুঁয়ে আচরণ , সমাজ বিমুখটা বা অসামাজিক আচরন , বিষণ্ণতা , ভয় , আতঙ্ক , উদ্বিগ্নতা , মৃত্যু ভয় , ঘুমের ব্যাঘাত , পড়াশুনার ব্যাঘাত , অপরাধ বোধ ।
যেসব শিশুরা traumatic events যেমন domestic violence অথবা পারিবারিক হিংস্রতা নিজেদের চোখে দেখে সেসব শিশুরা নিজেদেরকে অসহায় মনে করে , এদের চোখে সমস্ত পৃথিবী হয়ে পড়ে অনিশ্চিত , বিরূপ , ভীতিকর , নিরাপত্তাহীন।
‘অন লাইন’ থেকে পাওয়া একটি তথ্যে দেখা যায়ে যে , একটি ‘স্টাডি গ্রুপ’ কিছু শিশুদের উপর গবেষণা করতে যেয়ে তাদেরকে যখন জিজ্ঞাসা করে যে “কিভাবে তারা বুঝবে যে কোন নারী পুরুষ জুটি বিবাহিত ?” এর মধ্যে একজনের উত্তর ছিল “ যখন তারা পরস্পরের সাথে কথা কাটা কাটি করবে , ঝগড়া করবে তখন বুঝতে হবে যে তারা বিবাহিত ।” যদি এটা কোন বয়স্ক মানুষের উত্তর হোতো তাহলে এরকম উত্তরকে কৌতুক মনে হতো কিন্তু উত্তরটি এসেছে একটি শিশুর কাছ থেকে যে উত্তরের গুরুত্ব কৌতুক থেকে আনেক বেশী কিছু ! অনেক গুরুত্বপূর্ণ এবং তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় ।উত্তরটি আনেক বেশি এলো মেলো অনিশ্চিত করে দেয় আমাদের চিন্তা চেতনাকে অথবা অনেক বেশি ভাবিয়ে তোলে আমাদেরকে জীবন চলার পথে !
আমাদের কাছে হয়তো এটা শুনতে ভাল লাগবেনা যে আমাদের শিশুরা সারাক্ষন আমাদেরকে তাদের নজরদারীর মধ্যে রেখেছে । শিশুরা এক টুকরা স্পঞ্জের মত । তারা তাদের আশেপাশের জগতে যা কিছু দেখে সব কিছু তারা প্রায় চুসে নেয় । বিশেষ করে তাদের আশেপাশের ইমোশনাল/ আবেগপ্রবন পরিবেশ তাদেরকে বেশী প্রভাবিত করে ।
বাবা মায়ের মধ্যেকার সম্পর্কের ক্ষেত্রে তাদের কোন কিছহুই চোখের দৃষ্টি এড়িয়ে যেতে পারেনা । এমনকি বাবা মা’র মধ্যেকার বিরিক্তিকর চোখের দৃষ্টির ওঠা নামাও শিশুরা পলকে বুঝে ফেলতে পারে । অথবা উভয়ের মধ্যে খুব আস্তে বা ফিস ফিস শব্দের সমালোচনা গুলো ও শিশুরা শুনতে বা বুঝতে ভুল করেনা । সেখানে আমরা যতই বিষয়গুলি গোপন করার চেষ্টা করিনা কেন শিশুরা খুব বেশি সংবেদনশীল বাবা মা’র মধ্যেকার দুশ্চিন্তা বা মানসিক চাপ এর বিষয়ে এবং সরাসরি প্রভাবিত হয় বাবা মা’র পারস্পারিক কার্যকলাপ দ্বারা ।
যখন শিশুরা বুঝতে পারে যে তাদের বাবা মা’র মধ্যে কোন রকম ভুল বোঝা বুঝি চলছে এটা আনেক সময় তাদের মধ্যকার উৎকণ্ঠা বাড়িয়ে দেয় এবং তাদের অন্তরে উদ্বেগ , উৎকণ্ঠা স্থায়ি আসন করে নেয় আনেক ক্ষেত্রে ।
তারা তাদের আবেগ বা emotions কে নিয়ন্ত্রন করার জন্য নিজেরাই নিজেদের মধ্যে কিছু কাজ করতে উদ্বুদ্ধ হয় যেমন- যদি তারা ভিত হয় , দুঃখিত হয় এবং নিরাপত্তা হীনতায় ভোগে তারা তাদের আবেগ বা emotions এবং কষ্ট ভুলতে কিছু বেতিক্রমি আচরন শুরু করে যেমন – প্রয়জনের অতিরিক্ত খাবার গ্রহন , সারাক্ষন ভিডিও গেম খেলা , তাদের ইচ্ছে না হলে তারা তাদের বাবা মায়ের সাথে কথা বলা বন্ধ করা , সারাক্ষন দরজা বন্ধ করে নিঃসঙ্গ সময় কাটানো । অথবা বাবা মা’কে ঘিরে তাদের ভয়ংকর রাগ এবং অনেক সময় বাবা মাকে আঘাত দেবার মত কাজ তারা করে থাকে । এনেক ক্ষেত্রে তাদের প্রিয় খেলনাগুলিতে ভয়ংকর কিছু দিয়ে আঘাত দিয়ে তাদের রাগ প্রকাশ করবে অথবা সারাক্ষন বাবা মা’র বিরুদ্ধে লেগে থাকবে , স্কুলে যাওয়াতে অনীহা প্রকাশ করবে অথবা স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিবে , অন্য শিশুদের সাথে গোলমাল বা মারামারি করবে ।
যদিও বয়সে শিশুরা তাদের বাবা মায়ের চেয়ে কম পরিনত তবুও কখনো কখনো তারা অনুভব করে যে অন্যের বা প্রত্যেকের অনুভুতির প্রয়োজন গুলির ( emotional needs ) প্রতি তাদেরও যত্নশীল হয়া একান্ত কর্তব্য । এধরনের ইমোশনাল বা আবেগময় চিন্তার প্রেসার/ চাপ তাদেরকে বিষণ্ণ করে তোলে , অসুখি করে তোলে ।
কখনো কখনো দেখা যায় যে অজ্ঞ বাবা মায়েরা এমনকি তাদের নিজেদের মধ্যেকার সমস্যা / dispute এর ক্ষেত্রে তাদের শিশুদেরকে তাদের কোন একজনের পক্ষ নিতে কল অন / উদবুদ্ধ্য করে । এভাবে তাদের বিভ্রান্তকর আচরনে শিশুদের টেনে আনা হয় তাদের বিরোধের মাঝখানে এবং জোর করা হয় শিশুদেরকে তাদের এই বিরিধে আংশ নিয়ে পক্ষ নেবার জন্য।
অথচ আমরা কত জন খেয়াল করি যে যখন বাবা মা সুখি থাকে , নিজেদের মধ্যে নিজেরা পরিপূর্ণ থাকে এবং তাদের মধ্যে স্বাভাবিক সুখকর সুসম্পর্ক বজায় থাকে এবং বাবা মায়ের মধ্যেকার অনুভুতির চাহিদা পরিপূর্ণ থাকে তখন বাবা মা তাদের মধ্যেকার সম্পর্কের বিষয়গুলিতে বাচ্চাদেরকে উপস্থিতি কম পছন্দ করেন ।এবং যখন বাবা মা নিজেরা নিজেদের ইমোশনাল/ আবেগময় প্রয়োজন গুলি মিটিয়ে নিজেরা সুখি থাকেন তখন তারা নিজেরাই তাদের শিশুদের কে নিজেদের অজান্তেই বুঝিয়ে দেন যে পৃথিবীকে জানার জন্য , জীবনকে বোঝার জন্য চারিত্রিক দৃঢ়টা কাকে বলে ! জীবনে স্থিরতা কি, জীবনে সঠিক কি ! এবং জীবন চলার পথে দুনিয়াতে নিরাপত্তা কোথায়ে , কার কাছে !
বাবা মা’র সুখী , আনন্দময় জীবন ধারা শিশুদেরকে আনন্দময় জীবন উপভোগ করতে শেখায় । আনন্দময় পরিবেশে শিশুরা সুখি বাবা , মার উপর আস্থা রেখে বিসস্ততার সাথে নির্ভর করে তাদের ইমসনাল/ আবেগময় প্রয়োজন গুলি বাবা মা’র সাথে মন খুলে বলতে পারে , পরামর্শ ‘ করতে পারে । সুখি বাবা মা’র হাত ধরে শিশুরা এগিয়ে চলে নির্মল , সুন্দর , আনন্দময় আনাগত আগামির পথে ।
লেখক: এডভোকেট , বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট ।