নূরে আলম জিকু
গতকাল দুপুরে রাজধানীর কাওরান বাজারে দোকান থেকে দোকানে ছুটতে দেখা গেছে তাকে। নিত্যপণ্যের দাম নিয়ে রীতিমতো শঙ্কিত তিনি। মানবজমিনকে বলেন, এখন বাজারে সমস্ত পণ্যের দাম আগের তুলনায় ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ বেড়ে গেছে। আমরা চাকরি করি। বেতন তো এক টাকাও বাড়েনি। চাকরিজীবীদের জন্য আসলেই খুব কষ্টের ব্যাপার। যারা ব্যবসায়ী তারা ইচ্ছামতো দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। কিন্তু যারা কিনছে তাদের আয়ের বাড়তি উৎস নেই। এটা আমাদের জন্য খুব কষ্টের। বেতনের অর্ধেক চলে যায় বাসা ভাড়ায়। বাকি টাকায় সংসার খরচ ও সন্তানদের শিক্ষার পেছনে ব্যয় হচ্ছে। মাস শেষে পকেটে কোনো টাকা থাকে না।
রামপুরা এলাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন জুলহাস মিয়া। বেতন পান ২০ হাজার টাকার মতো। বাসা ভাড়া, গ্যাস বিল, বিদ্যুৎ বিল মিলিয়ে গুনতে হয় ১৩ হাজার টাকা। ৪ জনের সংসার। এর মধ্যে বাজার-সদাই, অফিসে যাতায়াতসহ বেতনের পুরো টাকাই খরচ হয়ে যায়। তিনি বলেন, আমার ছোট একটা সংসার ২০ হাজার টাকায় চলছে না। আগে যেভাবে চলতাম, এখন সেসব কল্পনাও করতে পারছি না। সব কিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় কষ্ট করে চলতে হচ্ছে। আগের একদিনের বাজার এখন ২/৩ দিন চালাতে হয়। অন্য সময় ছেলেমেয়েদের জন্য যেসব খাবার কিনতাম তাও বন্ধ করে দিয়েছি। কোনো সঞ্চয় নেই। করোনায় অনেকে চাকরি হারিয়েছে। বেতনও বাড়ছে না। চাকরি হারানোর ভয়ে আমরা মুখ বুঝে সব সহ্য করে যাচ্ছি। আর পারছি না। সামনে রমজান।
নির্মাণ শ্রমিক আবুল মিয়া। রাজধানীর মগবাজার এলাকায় ছোট একটি ভাড়া কক্ষে স্ত্রী- সন্তান নিয়ে থাকেন। দৈনিক ভিত্তিতে কাজ করেন। কখনো ৫০০ টাকা। আবার কখনো একটু বেশি। তবে প্রতিদিন কাজ নেই তার। মাসে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা আয়। এই টাকায় সংসার চালাতে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয় তাকে। কথা হলে তিনি বলেন, খাবারের দাম বাড়ে। শ্রমিকের দাম তো বাড়ছে না। আগের চেয়ে আয় কমেছে, ব্যয় বেড়েছে। পরিবার নিয়ে ঢাকায় বসবাস করতে কষ্ট হচ্ছে। সব কিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় বাড়িতে অসুস্থ বাবা-মায়ের ওষুধ কেনার টাকা পাঠাতে পারছি না। বাজারে যেতে এখন ভয় করে। এমন পরিস্থিতির শিকার শুধু দিনমজুর কিংবা বেসরকারি চাকরিজীবীরাই নন। সরকারি চাকরিজীবীরাও দ্রব্যমূল্যের যাঁতাকলে পিষ্ট। অনেকের ব্যয়ের সঙ্গে আয়ের সংগতি নেই। ফলে স্বাভাবিক জীবন চক্রে ব্যাঘাত অব্যাহত রয়েছে। বাংলাদেশ রেলওয়েতে চাকরি করেন আয়নুল হক। তিনি বলেন, মাসিক বেতন প্রায় ২২ হাজার টাকা। ঋণ বাবদ ব্যাংক টাকা কেটে নেয়। মাসের শেষে ১৫ হাজার টাকা হাতে পাই। বাসাভাড়া ১১ হাজার টাকা। আমার ছেলে নেই, ৩ মেয়েসহ ৫ জনের সংসার। ৪ হাজার টাকা দিয়ে কীভাবে যে সংসার চালাই তা আমি আর আমার আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। গত মাসেও সংসার চালাতে ৫ হাজার টাকা ধার নিয়েছি। কি করবো। নিত্যপণ্যের দাম বেশি। চাল কিনলে, তেল কিনতে পারছি না। মাছ-মাংস তো আমাদের কাছে কেবলই স্বপ্ন। মেয়েরা মাছের জন্য বায়না করলেও বাবা হিসেবে তাদের মাছ খাওয়াতে পারছি না। এমন দুঃসময় আগে আর আসেনি। জালাল উদ্দিন আহমেদ আরেকজন সরকারি কর্মকর্তা। তিনি বলেন, বেতন তো আগের মতোই পাই। সবকিছুর দাম বেড়েছে, বেতন তো বাড়েনি। দিন দিন ব্যয়ের গতি বাড়ছে। কোনো উপায় না পেয়ে খাবারের পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছি। আগে যেখানে ২ কেজি কিনতাম, এখন ১ কেজি কিনছি। কম খেয়ে কম বাজার করে সমন্বয় করছি। মাস শেষে কোনো সঞ্চয় নেই। বিপদে পড়লে যে খরচ করবো, সেই সুযোগও নেই। বিদ্যুৎ অফিসে চাকরি করেন কুষ্টিয়ার নুর ইসলাম। ধানমণ্ডি এলাকার বাসিন্দা তিনি। আগে কখনো কাওরান বাজারে বাজার করতে আসেননি। ধানমণ্ডি থেকেই বাজার সদাই করতেন তিনি। বর্তমানে নিত্যপণ্যের দামের অস্থিরতায় পড়ে বাধ্য হয়েই কাওরান বাজারে কেনাকাটা করতে আসেন। কথা হলে বলেন, মাসে ৪০ হাজার টাকা আয় করলেও এখন সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। আগের সেই লাইফস্টাইল এখন কাটানো সম্ভব হচ্ছে না।