রাজনৈতিক দলের মধ্যে সন্দেহ ও বিতর্কের মধ্যেই দেড়শ আসনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোটগ্রহণের আয়োজন চূড়ান্ত করছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এ লক্ষ্যে নতুন দুই লাখ ইভিএম কিনতে সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। চলতি সপ্তাহেই সরকারের অনুমোদনের জন্য তা পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হবে। সরকারের সায় মিললে প্রায় তিন লাখ টাকায় একেকটি আধুনিক ইভিএম কেনা হবে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালের অসুস্থতার মধ্যে গতকাল ইভিএম নিয়ে সভা করে ইসি। নির্বাচন ভবনে এ দিনের কমিশন সভায় চার নির্বাচন কমিশনার উপস্থিত ছিলেন। কোভিড আক্রান্ত সিইসি বাসা থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সভায় যুক্ত হন। তার সভাপতিত্বেই এ মুলতবি সভা হয়। গত বৈঠকে ইভিএমের বাজারদরসহ নানা বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য না পাওয়ায় সভাটি মুলতবি করা হয়। গতকালের সভায় সবকিছু পর্যালোচনা করে ‘নির্বাচনী ব্যবস্থায় ইভিএম এর ব্যবহার বৃদ্ধি এবং টেকসই ব্যবস্থাপনা’ শীর্ষক প্রকল্পের ডিপিপি অনুমোদন দেওয়া হয়।
সভা শেষে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে সর্বোচ্চ ১৫০ আসনে ইভিএমে ভোট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। বর্তমানে আমাদের কাছে যে ইভিএম আছে, তা দিয়ে সর্বোচ্চ ৭০ থেকে ৮০টি আসনে ভোট করা সম্ভব। তাই ১৫০টি আসনে নির্বাচন করতে হলে নতুন করে ইভিএম কিনতে হবে।
তিনি আরও বলেন, এ জন্য ইসি সচিবালয় নতুন একটি প্রকল্প প্রস্তাব কমিশন সভায় তুলেছিল। আমরা এটার অনুমোদন দিয়েছি। এখন পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হবে। তারা অনুমোদন করবে কি করবে না, তাদের বিষয়।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ইসি যে রোডম্যাপ প্রকাশ করেছে, তাতে মহানগর ও জেলা সদরের সর্বোচ্চ দেড়শ আসনে ইভিএমে ভোট করার পরিকল্পনা রাখা হয়েছে। বর্তমানে দেড় লাখ ইভিএম রয়েছে ইসির কাছে। ২০১৮ সালে একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে তৎকালীন সিইসি কে এম নূরুল হুদার কমিশন প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকায় ইভিএম কেনার প্রকল্প নেয়। দেড় লাখ ইভিএম দিয়ে ৭০ থেকে ৮০টি আসনে ভোট করা গেলেও মাত্র ৬টি আসনে ইভিএমে ভোটগ্রহণ হয়েছিল। ইভিএম সংক্রান্ত বর্তমান প্রকল্প ২০২৩ সালের জুনে শেষ হচ্ছে। ২০১৮ সালে নেওয়া ওই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩ হাজার ৮২৫ কোটি ৩৪ লাখ টাকা।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দুই লাখ ইভিএম কেনা এবং আগেরগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ৭১১ কোটি ৪৪ লাখ টাকার নতুন প্রকল্প চূড়ান্ত করেছে নির্বাচন কমিশন।
নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ জানান, এই প্রকল্পের আওতায় দুই লাখ ইভিএম কেনা হবে। এ ছাড়া ইভিএম রক্ষণাবেক্ষণ, জনবল তৈরি ও প্রশিক্ষণের জন্যও ব্যয় রাখা হয়েছে এখানে। আমরা এক সপ্তাহের মধ্যেই এ প্রকল্প প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠাব।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বছর খানেক আগেই নতুন ইভিএম সংগ্রহের কাজ শেষ করতে প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পটি সরকারের সায় পেলে ভোটের আগে সব কেনাকাটা, প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য কাজ সম্ভব বলে কর্মকর্তারা মনে করছেন।
জানা গেছে, প্রতিটি নতুন ইভিএমের সম্ভাব্য মূল্য ধরা হয়েছে ২ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। এ ক্ষেত্রে ২ লাখ ইভিএম মেশিন কিনতে ৫ হাজার ৪৮০ কোটি টাকা প্রয়োজন হবে। বাকি টাকা ইভিএম রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রকল্পের সার্বিক কার্যক্রম পরিচালনায় ব্যয় হবে।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির কাছ থেকে ইভিএম কেনা হয়েছিল। সে সময় প্রতিটি ইভিএমের দাম পড়েছিল ২ লাখ টাকা। সেগুলো মধ্যে বেশকিছু ইভিএম রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নষ্ট ও চুরি হয়েছে।
গত আগস্টে ইসির সংলাপে ইভিএম ব্যবহারের পক্ষে আওয়ামী লীগসহ এক ডজনেরও বেশি দল সমর্থন জানায়। জাতীয় পার্টিসহ অর্ধেকের বেশি দল (সংলাপে বিরত থাকা দলগুলো ইভিএমের বিরোধিতা করে আসছে প্রকাশ্যে) বিপক্ষে রয়েছে। যদিও ইসি প্রকাশিত রোডম্যাপে বলা হয়েছে, সংলাপে অংশগ্রহণকারী ২৯টি দলের মধ্যে ইভিএমের পক্ষে মত দিয়েছে ১৭টি রাজনৈতিক দল। বিপক্ষে মত দিয়েছে ১২টি দল।
ইভিএমের বিপক্ষে বললেও কিছু দলকে রোডম্যাপে পক্ষে দেখানো হয়েছে বলে অভিযোগের বিষয়ে মো. আলমগীর বলেন, ইসির রোডম্যাপে প্রকাশিত তথ্যই ‘সঠিক’।
জানা গেছে, নিবন্ধিত ৩৯টি দলের মধ্যে ইভিএম নিয়ে সংলাপে বিএনপিসহ ১০টি দল অংশ নেয়নি। এই দলগুলো ইভিএমের বিরোধিতা করে আসছে। এ ছাড়া নির্বাচন বিষয়ে উন্মুক্ত সংলাপে অংশ নেয়নি ৯টি দল।
এদিকে রাজনৈতিক ‘ঐকমত্য ছাড়া’ জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্তকে ‘অযৌক্তিক’ দাবি করে নির্বাচন কমিশনকে তা থেকে সরে আসার আহ্বান জানিয়েছেন ৩৯ জন নাগরিক। গত ৬ সেপ্টেম্বর যৌথ বিবৃতিতে তারা বলেন, রাজনৈতিক ঐকমত্য ছাড়াই নির্বাচন কমিশন আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমরা মনে করি, কমিশনের এ সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক। এটি রাজনৈতিক বিতর্ক আরও উসকে দেবে এবং কমিশনের বর্তমান আস্থার সংকটকে আরও প্রকট করে তুলবে। আমরা আবার একটি ব্যর্থ নির্বাচনের কবলে পড়ব, যা জাতি হিসেবে আমাদের চরম সংকটের দিকে ধাবিত করবে।
২০২৩ সালের নভেম্বরে তফসিল ঘোষণা করে ডিসেম্বরের শেষে কিংবা ২০২৪ সালের জানুয়ারির মধ্যে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হবে।