মিজান লিটন
বাংলাদেশের মানচিত্রে চাঁদপুর জেলা ইলিশের রাজধানী বলেই পরিচিত। অতিত ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায় বছরের এ সময়গুলোতে পদ্মা-মেঘনা-মোহনায় ঝাঁকে ঝাঁকে রূপালী ইলিশ ধরা পরলেও, এ বছর ভরপুর মৌসুমেও জেলেরা দেখা পাচ্ছে না ইলিশ। ইলিশ সম্পদ হুমকির মুখে ভেবে রপ্তানিকারক ও জেলেরা হতাশায় দিন কাটাচ্ছে। চাঁদপুর শহরের ডাকাতিয়ার তীর বড় স্টেশন মাছঘাট দেশের অন্যতম ইলিশ বাণিজ্য কেন্দ্র। প্রতিদিন পদ্মা-মেঘনা-মোহনা থেকে জেলেদের ধরা ঝাঁকে ঝাঁকে রূপালী ইলিশ এখান থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে ও বিদেশে রপ্তানি হয়।
চাঁদপুর মাছ ঘাট থেকে রংপুর, বগুড়া, পাবনা, দিনাজপুর, ঈশ্বরদী, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ জেলাসহ বেনাপোল দিয়ে ভারতেও চাঁদপুরের ইলিশ রপ্তানি হয়। এছাড়াও কুমিল্লা থেকে সিলেট-চট্টগ্রাম পর্যন্ত চাঁদপুরের ইলিশ পৌঁছানো হয়। বড় স্টেশন মাছঘাটে এখন আর অতিতের মতো জমজমাট অবস্থা নেই বললেই চলে। এই স্থানে প্রায় একশ’টি আড়ৎ ঘর রয়েছে। আড়ৎগুলোতে প্রায় আড়াই হাজার শ্রমিক প্রতিদিন মাছ উঠানামার কাজে ব্যস্ত থাকে। গত দু’ বছর পূর্বেও এখানে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে শ’শ’ ট্রলার বোঝাই মাছ উঠানামা করছে। অথচ এখন মাত্র ৪/৫টি ট্রলার হাতিয়া-সন্দীপ থেকে আসতে দেখা যায়। চাঁদপুর সদর উপজেলার হাইমচর, নীলকমল, ঈশানবালা, আলুর বাজার, চেয়ারম্যান বাজার, রাজরাজেশ্বর, জালালপুর, কোদালপুর, মাওয়াঘাটসহ প্রায় ৩০টি স্থানের জেলেরা এখানে মাছ বিক্রয় করতে আসে। রপ্তানিকারকদের সাথে জেলেদের সারা বছরই মাছ সংক্রান্ত কার্যক্রম লেগেই থাকে। বৈশাখ থেকে আশ্বিন পর্যন্ত ইলিশের ভরা মৌসুম। এখন শ্রাবন মাস চলছে এ সময় এ সময় নদী থেকে প্রচুর পরিমাণ ইলিশ ধরা পরার কথা থাকলেও পর্যাপ্ত পরিমাণ ইলিশ জেলেদের জালে ধরা পড়ছে না। ভরা মৌসুমে ইলিশ পর্যাপ্ত পরিমাণ না পাওয়ায় জেলেদের বেশিরভাগ সময় অবসরে কাটাতে হয়। এ ব্যাপারে জেলেদের অনেকের সাথে আলাপকালে তারা জানায়, নদীতে অনেক স্থানে চর পরে গেছে। ফলে মা ইলিশ ডিম পাড়ার জন্য এ নদীগুলোতে কম আসে।
এছাড়াও জেলেদেরকে অভয়াশ্রম থাকা কালে সরকার কর্তৃক কারেন্ট জাল নিষিদ্ধ ঘোষনা করা হলেও অবাধে পাওয়া যায়। কারেন্ট জালে নির্বিচারে জাটকা নিধনে এ সময় ইলিশের আকাল দেখা দিয়েছে। এছাড়া অভয়াশ্রমের সময় যে পরিমাণ সাহায্য বরাদ্দ থাকে অধিকাংশ জেলেরা তা ঠিকমতো পায় না। ফলে আইন অমান্য করে প্রতিদিন হাজার হাজার মণ জাটকা ইলিশ ধরে ফেলাতে নদীতে ইলিশের সঙ্কট দেখা দিয়েছে। সরকার কর্তৃক মৎস্য সম্পদ রক্ষার জন্য মার্চ থেকে মে পর্যন্ত এ দু’ মাস চাঁদপুরের ষাটনল থেকে লক্ষ্মীপুর জেলার চরআলেকজান্ডার পর্যন্ত পদ্মা-মেঘনা ৬০ কিঃ মিঃ পর্যন্ত অভয়াশ্রাম ঘোষণা করা হয়। এ সময় জেলেদের জন্য নদীতে জাল ফেলা নিষিদ্ধ থাকে। কিন্তু কোস্টগার্ড, নৌ-ফাঁড়ি অভিযান পরিচালনা সত্ত্বেও প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে অভয়াশ্রম চলাকালে জাটকা নিধনের মহা উৎসব চলতে থাকে।
চাঁদপুর মৎস্য বণিক সমবায় সমিতির সভাপতি আলহাজ্ব মিজানুর রহমান কালু ভূঁইয়ার সাথে আলাপকালে তিনি জানান, বছরের আষাঢ়ের শুরু থেকেই প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত ইলিশ মাছ ধরা হচ্ছেনা। চাঁদপুর বড় স্টেশন মাছের আড়ৎগুলো রয়েছে ইলিশ শূণ্য। সরকার জাটকা নিধনের জন্য তেমন কার্যক্রম হাতে নিয়েছে তা সফলভাবে করছে। কিন্তু অসাধু কর্মকর্তাদের কারণে সরকারের সেই কার্যক্রম ভেস্তে যায়। জাটকা নিধন কার্যক্রম সফল হলে নদীতে প্রচুর পরিমান ইলিশ পাওয়া যেতো। অনেক অসাধু জেলে কার্ড পেয়েও নদীতে অবাধে জাটকা নিধন করে। নদীতে কীটনাশক ব্যবহারের কারণে নদীর পানি বিষাক্ত হয়ে অনেক ইলিশসহ দেশীয় প্রজাতীর মাছ ধংস হয়ে যাচ্ছে। তাই নদীর পানি দোষণমুক্ত করলে হয়তো ইলিশের পূর্বের রূপ ফিরে পাবে। গত দু’ বছর পূর্বেও এ স্থান থেকে প্রতিদিন প্রায় আড়াই থেকে তিন হাজার মণ মাছ দেশের বিভিন্ন স্থানে রপ্তানি করা হতো। কিন্তু বর্তমানে মাত্র ৫০ থেকে ১শ’ মণ মাছ রপ্তানি করতে কষ্ট হচ্ছে। তবুও আমরা আশায় বুক বেঁধে আছি। পদ্মার ইলিশের স্বাদ সারা বিশ্বে সমাধৃত। বাংলাদেশ থেকে এক সময় আভ্যন্তরিণ সকল চাহিদা পূরণের পর বর্হিবিশ্বে চাঁদপুরের ইলিশ রপ্তানি করা হতো। এখন বর্হিবিশ্বে রপ্তানি হলেও দেশের আভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটছে না। ভরপুর এই মৌসুমে প্রধান বিক্রয় কেন্দ্রে ৭০০/৮০০ গ্রাম ইলিশের মণ ২৯ হাজার টাকা। ৫০০ থেকে ৬০০ গ্রাম ইলিশের মণ ১৮-১৯ হাজার টাকা । প্রতি কেজি ইলিশের দাম ৭০০-১০০০ টাকা। জাতীয় সম্পদ ইলিশ রক্ষায় অচিরেই প্রশাসন থেকে কঠোর আইন প্রয়োগ করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। এভাবে চলতে থাকলে চাঁদপুরে ইলিশ সম্পদ এক সময় বিলুপ্তির পথে চলে যাবে। তাই চাঁদপুরের ইলিশ সম্পদকে পূর্বের ন্যায় ফিরিয়ে আনতে মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রী মন্ত্রাণালয় যদি নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে চাঁদপুরের নদী সীমাকে ড্রেজিং করে পদ্মা মেঘনার নাব্যতার বৃদ্ধি করে তাহলে ডিমওয়ালা ইলিশ ডিম ছাড়ার জন্য চাঁদপুরের নদীতে আসবে আর তখনই ইলিশ মাছের ব্যাপক বিচরণ ঘটবে পদ্মা মেঘনায়। জেলেরা সেই ইলিশ ধরে বড়স্টেশন মাছ ঘাটের পূর্বের ন্যায় প্রাণ ফিরে আনতে পাবে। আর মাছ ঘাট থেকে ইলিশ রপ্তানী করে দেশের শত শত কোটি টাকা রাজস্ব আয় হবে।
শিরোনাম:
শুক্রবার , ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ , ২৫ মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।