চাঁদপুর নিউজ রিপোর্ট
মাত্র দুটি রাত পোহালেই ঈদ। অথচ ঘাতকরা তিনটি পরিবারের ঈদের আনন্দ নিমিষেই শেষ করে দিলো। ঈদের একদিন আগে চাঁদপুরের তিন উপজেলায় তিনটি খুনের ঘটনা ঘটলো। এই খুনের ঘটনার সংবাদে ভুক্তভোগী পরিবারের মতো পুরো জেলাবাসীকেই শোকাহত করে তুলেছে।
শুক্রবার দুপুরে জুমার নামাজের পর ফরিদগঞ্জ উপজেলার ভাটেরহদ গ্রামে জমি সংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে প্রতিপক্ষের হামলায় গুরুতর আহত মোস্তফা কামাল (৩২) নামে একজন শুক্রবার গভীর রাতে নিহত হন। এ ঘটনায় পুলিশ তিনজনকে আটক করে। একই দিন দিবাগত গভীর রাতে মতলব উত্তর উপজেলার ছেঙ্গারচর পৌরসভাধীন বালুচর গ্রামে যৌতুকের জন্য এক সন্তানের জননী তাছলিমা (২৩) নামে এক গৃহবধূকে খুন করা হয়। এছাড়া গতকাল শনিবার সকালে মতলব দক্ষিণ উপজেলার বাইশপুর গ্রামে রিপন (৩০) নামে এক যুবক ছুরিকাঘাতে নিহত হন।
, ফরিদগঞ্জে জমি সংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে প্রতিপক্ষের সন্ত্রাসী হামলায় আহত ৫ জনের মধ্যে মোস্তফা কামাল (৩২) নামে একজন ঢাকা মেডিকেল কলেজে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শুক্রবার গভীর রাতে মারা গেছেন। মোস্তফা কামাল ফরিদগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (ল্যাব)। হামলায় গুরুতর আহত অন্তত আরো ৫জন চাঁদপুর ও ফরিদগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এদিকে মোস্তফা কামালের মৃত্যুর সংবাদে বিক্ষুব্ধ লোকজন শনিবার সকালে প্রতিপক্ষ আবুল খায়েরের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। উপজেলার ভাটেরহদ গ্রামে শুক্রবার দুপুরে ও শনিবার সকালে এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় শুক্রবার ফরিদগঞ্জ থানায় লিখিত অভিযোগ দায়েরের পর গতকাল শনিবার সকালে হত্যা মামলা দায়ের করা হয়। মামলা নং-৩, তাং-৪/১০/১৪ খ্রিঃ। পুলিশ গতকাল চাঁদপুর সদর হাসপাতাল থেকে তিনজনকে আটক করেছে। এরা হচ্ছে : ভাটেরহদ গ্রামের লুৎফুর রহমানের ছেলে আবু তাহের (৪০) ও আবুল কাশেম (৩০) এবং একই গ্রামের জামালের ছেলে হারুনুর রশিদ (২৫)। এরা সবাই মামলার এজাহারভুক্ত আসামী।
জানা গেছে, ভাটেরহদ গ্রামের নূরুল ইসলাম গংয়ের সাথে একই বাড়ির আবুল খায়ের গংয়ের জমি সংক্রান্ত বিরোধ রয়েছে। আদালত নালিশি ভূমিতে ১৪৫ ধারা জারি করলেও আদালতের নির্দেশ অমান্য করে আবুল খায়ের গং বারবার উক্ত ভূমিতে নির্মাণ কাজ করছিলো। সর্বশেষ শুক্রবার সকালে তারা পুনরায় নির্মাণ কাজ শুরু করলে থানা পুলিশ গিয়ে নির্মাণ কাজ বন্ধ রাখতে নির্দেশনা দিয়ে আসে। এরই সূত্র ধরে ওইদিন দুপুরে জুমার নামাজ আদায়ের উদ্দেশ্যে সিরাজুল ইসলাম ও তার ছেলে মোস্তফা কামাল বাড়ি থেকে বের হলে আবুল খায়ের গং তাদের উপর দেশীয় অস্ত্র নিয়ে হামলা চালায়। তাদের হামলায় মোস্তফা কামাল, সাইফুল ইসলাম, সিরাজুল ইসলাম, ছকিনা বেগম, ছালেহা বেগমসহ অন্তত ৬-৭জন আহত হন। এর মধ্যে আশঙ্কাজনক অবস্থায় মোস্তফা কামালকে প্রথমে ফরিদগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পরে চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতাল এবং সর্বশেষ অবস্থার অবনতি হলে ঢাকা মেডিকেল কলেজে নেয়া হলে সেখানেই তার মৃত্যু হয়। এদিতে মোস্তফা কামালের মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে বিক্ষুব্ধরা আবুল খায়েরের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। নিহত মোস্তফা কামাল ফরিদগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (ল্যাব) পদে কর্মরত ছিলেন।
উপজেলা কমিউনিটি পুলিশের সভাপতি এবং একই এলাকার অধিবাসী ওমর ফারুক ফারুকী জানান, মোস্তফার মৃত্যুর ঘটনাটি দুঃখজনক। এর বিচার হওয়া উচিত। ফরিদগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ নাজমুল হক জানান, ঘটনার ব্যাপারে মামলা হয়েছে। পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়েছে। পরিস্থিতি এখন শান্ত রয়েছে। এজাহারভুক্ত ৩জন আসামী আটক হয়েছে।
সরজমিনে ঘটনাস্থলে গিয়ে লোকজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, গত এক বছরের বেশি সময় ধরে ওয়ারিশি সম্পত্তি নিয়ে দু পক্ষের মধ্যে বিরোধ চলে আসছে। প্রথমে উভয় পক্ষ স্থানীয় রূপসা উত্তর ইউনিয়ন পরিষদে অভিযোগ দায়ের করার পর ইউপি চেয়ারম্যান ও স্থানীয় সালিসদাররা বারবার বসে উভয় পক্ষকে মীমাংসায় নিয়ে আসার চেষ্টা করেন। এক পর্যায়ে একটি এজমালি পুকুর লিজ দিয়ে পুরো সম্পত্তির মাপজোপ করে প্রায় শেষ পর্যায়ে নিয়ে এলেও বিষয়টি মীমাংসা না হওয়ায় সালিসরা আশা ছেড়ে দেন। পরে উভয় পক্ষ আদালতে একে অপরের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। এরই মধ্যে কয়েক মাস পূর্বে বিরোধীয় একটি ভূমিতে আবুল খায়ের গং জোরপূর্বক পাকা ভবন উঠাতে গেলে অপর পক্ষ আদালতের মাধ্যমে ১৪৫ ধারা জারি করে নির্মাণ কাজ বন্ধ রাখে। এভাবে বেশ কয়েকবার পুলিশ সেখানে উপস্থিত হয়ে আদালতের নির্দেশ অমান্য না করতে নির্দেশনা দিয়ে আসে। এরই এক পর্যায়ে শুক্রবার সকালে প্রতিপক্ষ আবুল খায়ের গং আবারো আদালতের নির্দেশ অমান্য করে নির্মাণ কাজ শুরু করায় থানার এএসআই আঃ মজিদ পুনরায় সেখানে উপস্থিত হয়ে নির্মাণ কাজ বন্ধ করতে নির্দেশনা দিয়ে আসেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে প্রতিপক্ষরা এ হামলার ঘটনা ঘটায়।
এ ব্যাপারে স্থানীয় সালিসদার খোরশেদ আলম ও ইউপি চেয়ারম্যান বিল্লাল হোসেন ভূঁইয়া জানান, হামলায় নিহতের ঘটনা এবং সর্বশেষ বসতঘরে আগুন দেয়ার মতো কোনো ঘটনাই ঘটতো না যদি বিষয়টি মীমাংসা করা যেতো। ইউপি চেয়ারম্যান জানান, তিনি উভয় পক্ষের কাছে হাতজোড় করে মীমাংসা হওয়ার জন্য বললেও তারা কেউই কথা শুনে নি। তিনি নিহত মোস্তফা কামালের ব্যাপারে জানান, এলাকার কোনো লোকের কাছে তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি। ফলে তার মৃত্যুতে পুরো এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে। এ মৃত্যুকে কেউই মেনে নিতে পারবে না।
মতলব উত্তর উপজেলার ছেংগারচর পৌরসভার বালুচর গ্রামে যৌতুকের জন্য গৃহবধূ তাছলিমা (২৩)কে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে। শুক্রবার দিবাগত রাতের কোনো এক সময় এ ঘটনা ঘটে।
জানা যায়, উপজেলার ছেংগারচর পৌরসভার বালুচর গ্রামের অটোচালক জাকির হোসেন দালাল দীর্ঘদিন ধরে স্ত্রী তাছলিমার বাবার কাছে যৌতুকের টাকা দাবি করে আসছিলো। তাছলিমা কয়েকবার বাবার বাড়ি থেকে টাকা এনে স্বামীকে দিয়েছে। তাছলিমা ও জাকিরের সংসারে ৩ বছরের তৌহিদ নামে এক ছেলে সন্তান রয়েছে। গত শুক্রবার দিবাগত রাতে তাছলিমা ও জাকিরের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়েছে বলে জানায় প্রতিবেশীরা। এরপর গতকাল শনিবার দুপুরে মতলব উত্তর থানা পুলিশ নিহত তাছলিমার লাশ নিজ বসতঘরের চৌকির উপর থেকে উদ্ধার করে। তাছলিমার স্বামী ও তার পরিবারের লোকজন ঘরে লাশ রেখে পালিয়ে যায়।
ধারণা করা হচ্ছে রাতে যে কোনো সময় তাছলিমাকে শ্বাসরোধ করে জামাইকে হত্যা করা হয়েছে। সুযোগ বুঝে পরিবারের লোকজন পালিয়ে যায়। তাছলিমার বাবার বাড়ি পার্শ্ববর্তী পালালোকদি গ্রামে। তার বাবার নাম তোফাজ্জল হোসেন।
নিহত তাছলিমার বাবা তোফাজ্জল হোসেন জানান, মেয়ের সুখের কথা চিন্তা করে জামাইকে কয়েক দফা টাকা দিয়েছি। তারপরও বিভিন্ন সময় টাকা দাবি করতো, না দিলে আমার মেয়েকে মারধর করতো। এ নিয়ে কয়েকবার সালিস হয়েছে। ৩ বছরের নাতির দিকে চেয়ে কিছু করিনি।
মতলব উত্তর থানার উপ-পরিদর্শক জাহাঙ্গীর আলম জানান, নিহত তাছলিমার লাশ উদ্ধার করে সুরতহাল তৈরি করে ময়না তদন্তের জন্য চাঁদপুর মর্গে প্রেরণ করা হয়েছে। মতলব উত্তর থানার অফিসার ইনচার্জ সৈয়দ মাহবুবুর রহমান জানান, অপরাধীদের আটক করে আইনের আওতায় আনা হবে।
মতলব দক্ষিণ , বোনের পাওনা ২শ’ টাকা চাইতে গিয়ে রিক্সা চালক রহিমের ছুরিকাঘাতে খুন হলো রিপন (৩০) নামে এক যুবক। স্থানীয় এলাকাবাসীর সহযোগিতায় ঘাতককে আটক করে পুলিশের হাতে সোপর্দ করা হয়েছে। গতকাল শনিবার সকাল আনুমানিক সাড়ে ১০টায় মতলব দক্ষিণ উপজেলার দক্ষিণ বাইশপুর ফোরকানিয়া মাদ্রাসার কাছে এ ঘটনাটি ঘটে। নিহত রিপন দক্ষিণ বাইশপুর গ্রামের মৃত রহিম উদ্দিনের ছেলে। ঘাতক রহিম নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ উপজেলার নবীগঞ্জ গ্রামের জসিম উদ্দিনের ছেলে। সে ছোট বেলা থেকেই বাইশপুর এলাকার একটি বাড়িতে থেকে মতলব বাজারে রিক্সা চালাতো।
পুলিশ ও এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায়, রিপনের বোন নুরজাহান ঐ রিক্সা চালক রহিমের নিকট থেকে খাবার বাবদ ২শ’ টাকা পাওনা ছিলো। ঐ টাকা দেই দিচ্ছি বলে রহিম দীর্ঘদিন যাবৎ টালবাহানা করে আসছিলো। গতকাল সকালে নুরজাহান তার পাওনা টাকা আদায়ের জন্য ভাই রিপনকে রহিমের কাছে পাঠায়। ঐ টাকা চাওয়াকে কেন্দ্র করে তাদের মধ্যে তর্কবিতর্কের এক পর্যায়ে মারামারির ঘটনা ঘটে। তখন রহিম ক্ষিপ্ত হয়ে ঘর থেকে একটি ধারালো ছুরি এনে রিপনের শরীরে উপর্যুপরি আঘাত করে। এতে সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। এ সময় এলাকাবাসী ঘাতক রহিমকে আটক করে থানা পুলিশের হাতে সোপর্দ করে। এ সময় তার সাথে থাকা রক্তামাখা ধারালো ছুরিটি উদ্ধার করা হয়। স্থানীয় লোকজন রক্তাক্ত জখম অবস্থায় রিপনকে মতলব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে আসলে কর্মরত চিকিৎসক তার অবস্থা বেগতিক দেখে চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালে প্রেরণ করেন। সেখানেও তার অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় তাকে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পর বিকেল সাড়ে ৪টায় কর্মরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এ ব্যাপারে মতলব দক্ষিণ থানায় হত্যা মামলার প্রস্তুতি চলছে বলে রিপনের পারিবারিক সূত্রে জানা যায়।