ঋণে জর্জরিত অর্থনীতি নিয়ে বৈদেশিক মুদ্রার সংকটের সঙ্গে লড়াই করছে শ্রীলঙ্কা। দেশটির মুদ্রার মান কমে যাওয়ায় খাদ্য, ওষুধ ও জ্বালানির মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি ব্যাহত হচ্ছে। বেকারত্ব ও খাদ্যের গভীর সংকট দেখা দিয়েছে। দেশটিতে প্রচণ্ড হারে বেড়েছে খাদ্য ও পানির দাম।
শ্রীলঙ্কার তামিলরা এখন ভারতে আসার চেষ্টা করছে।
দেশটি থেকে ভারতে যাওয়া শরণার্থীরা জানায়, সেখানে চাল প্রতি কেজিতে শ্রীলঙ্কার মুদ্রায় ৫০০ টাকা পর্যন্ত পৌঁছেছে। ৪০০ গ্রাম পাউডার দুধের দাম ৭৯০ টাকা। এক কেজি চিনির দাম ২৯০ টাকা। ১৯৮৯ সালে গৃহযুদ্ধের সময় যেভাবে মানুষ পালাত, এবারও সেই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশটিতে তেলের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে অসুস্থ হয়ে মারা যাচ্ছে মানুষ। সাধারণ মানুষের বিক্ষোভ ঠেকাতে তীব্র জ্বালানিসংকট মোকাবেলায় মঙ্গলবার সরকার পরিচালিত শত শত গ্যাসস্টেশনে সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। তারা জ্বালানি বিতরণে সহায়তা করবে বলে জানিয়েছেন দেশটির কর্মকর্তারা।
কাগজের অভাবে পরীক্ষা দিতে পারছে না স্কুল শিক্ষার্থীরা। বাড়ছে শিশুখাদ্যের দাম। কলম্বোর বাসিন্দা ৩৬ বছর বয়সী সীতা গুনাসেকেরা রয়টার্সকে বলেন, ‘সরকারকে এর সমাধান দিতে হবে। মানুষ কষ্ট ও দুর্ভোগে আছে। আমাকে অন্য কিছুর চেয়ে জ্বালানির লাইনে বেশি সময় ব্যয় করতে হচ্ছে। আমরা যা উপার্জন করি, তা দিয়ে জীবন চালাতে হিমশিম খাচ্ছি। ’
সরকারের মুখপাত্র রমেশ পাথিরানা বলেন, মজুদ এবং অকার্যকর বিতরণের অভিযোগের ভিত্তিতে সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। জনগণকে সাহায্য করতে সামরিক বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে, তাদের মানবাধিকার খর্ব করতে নয়।
এরই মধ্যে দেশটির পাশে দাঁড়ানোর আশ্বাস দিচ্ছে চীন। ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টের এক বিশ্লেষণে দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপ দেশটির এ পরিস্থিতির মধ্যে পড়ার কারণ খোঁজা হয়েছে।
২০১৯ সালে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর গোতাবায়া রাজাপক্ষে উত্তরাধিকার সূত্রে একটি বিপর্যস্ত অর্থনীতি পেয়েছিলেন। সন্ত্রাসী হামলা ও রাজনৈতিক সংকট দেশটির ওপর মারাত্মকভাবে আঘাত হয়ে এসেছিল। ২০০১ সালের পর থেকে দেশটির প্রবৃদ্ধি সর্বনিম্ন ছিল। এরপর করোনা মহামারির আঘাত। করোনাকালে দেশটির আয়ের অন্যতম উৎস পর্যটন খাতে বড় ধরনের ধাক্কা লাগে। প্রায় এক দশক ধরে দেশটির পর্যটন থেকে আয় বেড়েছে। কিন্তু করোনা মহামারিতে তা শতকরা ২০ ভাগে নেমে আসে।
দায়িত্ব নেওয়ার পর গোতাবায়ার সরকার বিভিন্ন খাতে করছাড় দেওয়ার পাশাপাশি বাজারে নগদ অর্থ ছাড়তে শুরু করে। এতে মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে যায়। কমে যায় কর আদায়। বাজেট ঘাটতি আরো বেড়ে যায়।
রাজাপক্ষের ক্ষেত্রে একটি বড় সুবিধা হলো, তাঁর ভাই প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী (মাহিন্দা, বাসিল) একই পরিবারের। তাঁদের আরেক ভাই চামালও মন্ত্রিসভার সদস্য। এই ভাইদের দুই ছেলেও (নামাল ও শশীন্দ্র রাজাপক্ষে) মন্ত্রিসভায় আছেন। শ্রীলঙ্কার মতো এক পরিবারের শাসনের নজির এ অঞ্চলের ইতিহাসে বেশ বিরল।
দেশটির রিজার্ভ মাত্র কয়েক মিলিয়ন ডলার। বৈদেশিক মুদ্রার প্রাপ্তি কমে যাওয়ায় আমদানি বিল বেড়ে যায়। এর পেছনে কারণ অবশ্যই বিশ্বব্যাপী পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি। সম্প্রতি ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবও পড়েছে শ্রীলঙ্কার ওপর। এরই মধ্যে মূল্যস্ফীতি চরমে পৌঁছেছে। দেশটির বিদ্যুৎ উৎপাদনের বেশির ভাগই গ্যাস ও তেলনির্ভর। কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী তেল-গ্যাস না পাওয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে গেছে। ফলে গত মাস থেকে লোডশেডিংয়ে ভুগছে দেশটির মানুষ। পরিস্থিতির অবনতি ঘটায় ফেব্রুয়ারি মাস থেকে প্রতিদিন সাড়ে সাত ঘণ্টা লোডশেডিং দেওয়া শুরু করে বিদ্যুৎ বিভাগ। বিদ্যুতের ঘাটতি, গ্যাসসংকট ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে ছোটখাটো ব্যবসায়।
ডলারের বিপরীতে রুপির অব্যাহত দরপতন ঠেকাতে আমদানি খরচ বাড়ানো হলে এর প্রভাব পড়বে সাধারণ শ্রীলঙ্কানদের ওপর। গত ফেব্রুয়ারিতে পণ্যের দাম ১৫ শতাংশের বেশি বেড়েছে, যা বিগত ১৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। অন্যদিকে খাদ্যদ্রব্যের দাম ২৫ শতাংশ বেড়েছে।
জ্বালানি তেলের সংকটের কারণে বিমান, রেল, বাস, এমনকি অটোরিকশার ভাড়াও বেড়ে গেছে। অন্যদিকে ভর্তুকি দেওয়া পণ্যের দামও বেড়েছে। এর মধ্যে প্যারাসিটামলের দাম বেড়েছে ২৯ শতাংশ। জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে উদ্বেগজনকভাবে। এ অবস্থায় ১২ মার্চ রাষ্ট্রীয় তেল-গ্যাস কম্পানি পেট্রলের দাম ৪৩.৫ শতাংশ বাড়িয়েছে, আর ডিজেলের দাম বাড়িয়েছে ৪৫.৫ শতাংশ।
শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির একটি উৎস পর্যটন। কিন্তু কভিড-১৯ মহামারির কারণে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধানতম এ খাত থেকে বলার মতো আয় হয়নি। প্রবাসী নাগরিকদের পাঠানো রেমিট্যান্সও কমে গেছে। সূত্র : রয়টার্স, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস।