জীবনের কোন কিছু খুব কঠিন বা অসম্ভব আমি কখনই চিন্তা করতে পারি না । জীবনমানে একটি সরল অংক ! মাথা ঠিক রেখে গুরুত্ব বুঝে একটির পর একটি অংকের সমাধান করতে পারলেই পুরা সরল অংকের সহজ সমাধান মিলে যায়। আমাদের ইতিহাসের সরল অংক তেমনি মিলে গেছে । যুগ যুগ অপেক্ষা করে এই সরল অংক মেলানো হয়েছে !
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভয়ংকর নির্মম নিষ্ঠুরতার শিকার হয়ে সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রাণ হারান। বিদেশে থাকায় বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা আমাদের বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা ।
মুক্তিযুদ্ধের নয়টি মাস কখনো গ্রামে পালিয়ে কখনো খাটের নিচে লুকিয়ে, কখনো বা মাটির গর্তে লুকিয়ে চোখ বন্ধ করে একটি আশার স্বপ্ন শুধু দেখেছি, যে স্বপ্ন জীবন বাঁচিয়ে রাখার সাহস জুগিয়েছে । সে স্বপ্ন ছিল স্বাধীনতা দেখার স্বপ্ন, যে স্বপ্ন ছিল লাল সবুজ পতাকা উড়ানোর স্বপ্ন ।
সেখানে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার খবর কিশোরী অনুভূতিকে স্তব্ধ করে দিয়েছিলো। কী অর্জনের জন্য জগত জোড়া খ্যাত এতো বড় কীর্তিমানের নির্মম ধ্বংস বুঝে উঠতে পারছিলাম না! স্তব্ধ বিস্ময়ে দেখছিলাম অদ্ভুত সব অঘটন! নয়মাসের পবিত্র রক্তভেজা মাটি তখনো ভাল করে শুকাতে পারেনি। সেই পবিত্র রক্তভেজা মাটিতে আদ্ভুত, অচেনা মানুষদের ছন্দহীন সশব্দ সহিংস্র পদচারণা। কী করবো ! কাকে কী জিজ্ঞাসা করবো ! আমরা কোথায়ে চলছি কিছু বুঝে পাচ্ছিনা! বাংলাদেশ রেডিও খুললেই আদ্ভুত এক কণ্ঠে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার কৃতিত্বের ঘোষণা । দেশের নিয়ন্ত্রণ নেবার ঘোষণা! এর ফাঁকে ফাঁকে পাকিস্তানের কণ্ঠশিল্পী আহমেদ রুশদি, আইরীন পারভীন, নুরজাহানের গাওয়া সব উর্দু গানের আসর । আবাক করা কাণ্ড ! কোথা থেকে কোথা যাচ্ছি আমরা ?
এতো বড় বিভ্রান্তি থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখার জন্য আমি একটি উপায় খুঁজে বের করে নিলাম। আমি আমার দেখা বঙ্গবন্ধুকে, তাঁর পরিবারের আপনজনদের কিছু সুখকর স্মৃতি বার বার আমার চোখের সামনে টেনে এনে এই মর্মান্তিক বিভ্রান্তি থেকে আমার কিশোরী মনকে দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম !
কয়েকদিন আগে আমার শুভাকাঙ্ক্ষী বিশিষ্ট এক পাঠক আমাকে পরামর্শ দিয়েছেন আমি যেন সবসময় ইতিবাচক বিষয় নিয়ে লিখি । আগস্ট মাসে কিছু লিখতে গেলে ইতিবাচক কীভাবে লিখবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না । অনেক চিন্তা করে উপায় খুঁজে নেই । আমি বঙ্গবন্ধু আর তাঁর পরিবারকে ঘিরে যা কিছু স্মৃতি আমার মনে আছে সেগুলো ঘেঁটে কিছু স্মৃতি তুলে ধরার চেষ্টা করেছি এখানে – আমি নিজেকে ভীষণ ভাবে গর্বিত মনে করি কারণ আমি বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার শুনানিতে প্রতিদিন উপস্থিত থাকতে পেরেছি । অদ্ভুত এক অনুভুতি নিয়ে উপস্থিত থেকে ঐতিহাসিক রায় শুনেছি। প্রশান্তিকর অনুভূতি নিয়ে রায় শেষে বাইরে এসে যখন দাঁড়িয়েছি অনেক টিভি চ্যানেলের মধ্যে কোন এক বিশেষটি ভি-চ্যানেল উপস্থিতভাবে আমার অনুভুতি জানতে চাইছিল। আমি কী কী বলেছিলাম ঠিক মনে নেই, শুধু এততুকু মনে আছে বলেছিলাম “…রায় শুনে আমরা সন্তুষ্ট তবে কষ্ট পাচ্ছি এই কারণে যে এই শুভক্ষণের জন্য আমাদের এত বছর কেন অপেক্ষা করতে হয়েছে…।”
রায় ঘোষণার পর পর আনুষ্ঠানিকভাবে অনুভুতি ব্যক্ত করে মাননীয় সংসদ সদস্য ফজলে নূর তাপস জানিয়েছিলেন যে, রায় ঘোষণার এই বিশেষ দিনটি মাননীয় সংসদ সদস্য ফজলে নূর তাপসের জন্মদিন, যিনি এই রায়কে তাঁর জন্মদিনের অন্যতম সেরা ও বিশেষ উপহার বলে মনে করছিলেন । বঙ্গবন্ধুর সাথে তাঁর পিতা ‘শেখ ফজলুল হক মণিকে’ নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছিল…।
১৯৭৫ সালের খুব সম্ভব ( ভুল হতেও পারে ) ১৪ জুলাই শেখ কামালের সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী এবং নাম করা অ্যাথলেট সুলতানার ( খুকি ) বিয়ে হয়ে ছিল এবং পরবর্তীতে যিনি পরিচিত হয়েছিলেন ‘সুলতানা কামাল খুকি’ হিসাবে । বিয়ে থেকে মৃত্যু পর্যন্ত ওই সময়টাতে আমি রাজারবাগ পুলিশ লাইনের ঠিক উল্টা দিকে গোপীবাগে আমার সেঝো (৩য় বোন ) বোনের বাসায় ছিলাম । তখন ঢাকার বেশিরভাগ বাসাগুলো ছিল চতুর্দিকে উঁচু ওয়াল ঘেরা ঘন সবুজ ঘাসে ঢাকা বিশাল লনের উপর একতালা বাড়ি। বিকালে হিলারা/ মেয়েরা সেই লনে চেয়ার পেতে বসে চা নাস্তা খেতে খেতে গল্প করতো। আমার বোনের বাসা ঘেঁষে ছিল আর একটি বাসা । সেই বাসাতে ৩/৪ টি মেয়ে ছিল । এদের মধ্যে সম্ভবত দুইজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী ছিলেন এবং আমার বোনের সাথে তাদের সখ্যতা ছিল বান্ধবীর মত । তাদের নাম যতটুকু মনে আছে, ‘ফ্যান্সি’, ‘ন্যান্সি’, ‘পজি (posy)’…। এদের মধ্যে একজন ছিলেন সুলতানা কামালর এর বান্ধবী । তখন শেখ কামালের সাথে সুলতানা কামালের বিয়ের আয়োজন চলছে । সুলতানা কামালের বান্ধবী হিসাবে সেই মেয়েরা মেয়েপক্ষের প্রতিটি অনুষ্ঠানে প্রতিদিন উপস্থিত থাকতেন । আমার বোন অল্প বয়সে বিয়ে হওয়ায়ে তিনি দুইপুত্র সন্তানের মা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী ছিলেন তখন । সেই মেয়েরা সুযোগ পেলেই লনে বসে চা খেতে খেতে বিয়ের সব গল্প করতো আমার বোনের সাথে । আমি বোনের পাশে বসে সেই গল্প শুনতাম। কন্যা দেখা, গায়ে হলুদ, মেহেদী পরা থেকে শুরু করে কন্যা বিদায়, প্রায় প্রতিদিন সব কিছুর নিখুঁত বর্ণনা দিতো তারা । আমার বোন আর আমি মন দিয়ে শুনতাম সেই গল্প । শুধু কন্যা বিদায়ের গল্প যেদিন তারা করছিল সেদিন আমার যতটুকু মনে আছে তাঁরা বলেছিলেন ‘শেখ কামাল একটি কাল ‘Mercedes Benz’ গাড়ি সাজিয়ে এসেছিলেন বিয়েতে কনে তুলে নিতে…’ এখনো আমার স্পষ্ট মনে আছে ঠিক তখন আমার বোন দুশ্চিন্তা নিয়ে কপাল কুঁচকে গম্ভীর হয়ে একটি মন্তব্য করেছিলেন ‘বিয়েতে কেন কাল গাড়ি ব্যবহার করেছেন? বিয়েতে কাল মানে অশুভ… ।
সম্ভবত আমি কোন পরীক্ষা শেষ করে বোনের বাসাতে বেড়াতে এসেছিলাম এবং সম্ভবত এক মাসের বেশি সময় আমি ছিলাম বোনের বাসাতে। ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট ছিল আমার বোনের বড় ছেলের ২য় জন্মদিন । মেহমান চলে যেতে প্রায় রাত ১২ টা বেজে গিয়েছিল। অনেক রাতে সবাই ঘুমাতে গিয়েছি । কতক্ষণ ঘুমাতে পেরেছিলাম মনে নেই । শুধু মনে আছে গভীর রাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইন থেকে ভেসে আসছে ভয়ঙ্কর গোলাগুলির শব্দ। যুদ্ধের আতঙ্ক তখনো কারো মন থেকে মুছে যায়নি তাই ভয়ে আতঙ্ক বিছানা আঁকরে ধরে বসে আছি । কিছু বুঝে উঠতে পারছিলাম না কেন আবার যুদ্ধ? কে কার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে? কী উদ্দেশ্যে করছে? আমি ততক্ষণে মার জন্য কান্না শুরু করেছি। যুদ্ধে আব্বাকে হারিয়েছি, এবার কী হতে যাচ্ছে বুঝতে পারছিলাম না, শুধু মনে হচ্ছিলো আমি কিছুতেই মাকে হারাতে চাইনা । গোলাগুলির ভয়ঙ্কর শব্দে আমরা সবাই ভয়ে জড় সড় হয়ে এক খাটে বসে ছিলাম । পরদিন ১৫ আগস্ট খুব ভোরে, সম্ভবত ফজরের আজানের পর দুলাভাই বাসা থেকে বের হয়ে যান । কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি ফিরে আসেন । বাসায় ফিরে উনি দুই হাতে মাথা চেপে বসে থাকলেন কিছুক্ষণ এরপর ভেজা ভারি কণ্ঠে জানালেন ‘বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলা হয়েছে…।’ তখন সাদা কালো টিভি চ্যানেল একটি শুধু ‘বিটিভি’, যার কার্যক্রম চলতো সম্ভবত সন্ধ্যা থেকে রাত ১২ টা পর্যন্ত । দুলাভাই অনেক খোঁজাখুঁজি করে একটি পুরানো রেডিও খুঁজে পেলেন। রেডিও অন করতেই শোনা গেল অদ্ভুত এককণ্ঠ! অদ্ভুত সব কথা আর ঘোষণা! বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার কৃতিত্বসহ পুরো দেশের নিয়ন্ত্রণ নেবার কৃতিত্ব সেই অদ্ভুত অচেনা কণ্ঠে…।
যা হতে যাচ্ছিলো সবকিছু থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে আমার সেই কিশোরী মন নিজেকে শুধু একটি কণ্ঠ স্মৃতি আর একটি স্পর্শ স্মৃতিতে গেঁথে নিলো । যে কণ্ঠ নিনাদ যুগ যুগ ধরে বিভ্রান্তি ভুলিয়ে আমাদের জাগিয়ে তোলে । যে স্পর্শ স্মৃতি আমার মনে উজ্জ্বল হয়ে আছে , অমর হয়ে আছে এতদিনেও । আমি বারবার ফিরে যাই ফেলে আসা সেই ১৯৭০ সালের একটি শুভক্ষণে ।
গোপালগঞ্জ শহরের ঠিক মাঝখানে বঙ্গবন্ধুর পৈত্রিক বাসা। আর তার ঠিক দুইটি বাসা আগেই আমাদের বাসা ।আব্বা, মা’র কাছে শুনেছি এই বাসাতে থেকেই বঙ্গবন্ধু গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে পড়াশোনা করেছেন।
১৯৭০ সালের একটি বিশেষ দিন । পুতুল নিয়ে খেলি তখন তবুও বিশেষ কিছু মুহূর্ত আমি খুব স্পষ্টভাবে এখনও মনে করতে পারি। সবার মুখে মুখে শুনছিলাম একটি কথা ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রাহমান গোপালগঞ্জ আসছেন। সবাই উত্তেজিত হয়ে অপেক্ষা করছেন তাঁকে দেখার জন্য । আমাদের পরিবারের সবাই একটু বেশি আগ্রহ আর উত্তেজনা নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন সেই মহামুল্যবান মুহূর্তের জন্য । এর অবশ্য অনেক কারণ ছিল – আমাদের বাসার সামনেই ছিল বিশাল খোলা সরকারি ‘টাউন মাঠ’ । পুরো সামাজিক কার্যক্রম / অনুষ্ঠান, প্রদর্শনী, মেলা, ডকুমেন্টারি ফিল্ম শো, মিটিং, সামাজিক মিলন মেলা, জাতীয় দিবস উদযাপন, ক্রিকেট খেলা, ফুটবল খেলা, ব্যাডমিন্টন খেলা এসব কিছুর আয়োজন হতো সেই মাঠে । আমরা আমাদের বাসার ড্রইং রুমের দরজা জানালা খুলে রেখে সোফাতে বসেই সব আয়োজন উপভোগ করতে পারতাম । আমাদের বাসা থেকে প্রয়োজনে বিশেষ যেকোনো ধরনের সুবিধা নেবার জন্য যেকোনো অনুষ্ঠানের মঞ্চগুলো ঠিক আমাদের বাসার সামনেই তৈরি করা হতো। সম্ভ্রান্ত, পর্দানশীল মহিলারা মাঠে না যেয়ে আমাদের বাসাতে বসেই সব অনুষ্ঠান উপভোগ করতে পারতেন। আমাদের ড্রইংরুমের সামনেই ছিল সবুজ ঘাসে ঘেরা ছোট একটি লন ( এক টুকরা খোলা জায়গা ) যে কোন অনুস্থানে উৎসাহ নিয়ে সেই জায়গা টুকুও চেয়ার আর সোফা দিয়ে সাজিয়ে মেহমানদের বসার ব্যবস্থা করতাম আমরা ।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান গোপালগঞ্জ আসছেন সুতরাং আমাদের আনন্দ, উত্তেজনা ছিল সীমাহীন। আমার বড় দুই বোন পুরো বাড়ি ভেততে বাইরে সাজাতে গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন ।
আমি বিশেষ উৎসাহ আর কৌতূহল নিয়ে সব খেয়াল করছিলাম কী হতে যাচ্ছে ! বিশাল একটি মঞ্চ তৈরি করা হচ্ছিলো ঠিক আমাদের বাসার সামনেই । প্রতিদিন আনেক রাজনৈতিক নেতারা আমাদের বাসার সামনে জড় হয়ে মঞ্চ তৈরির তদারকি করতেন । কখনো কখনো তাঁরা সবাই তদারকির ফাঁকে ফাঁকে আমাদের বাসাতে বসে চা খেতেন । ঠিক এই মুহূর্তে কয়েকজনের নাম মনে করতে পারছি তারা হলেন – বাচ্চু ভাই, ফরিদ ভাই, লুলু ভাই, খসরু ভাই, মিলু ভাই, মাহবুব ভাই (যিনি মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন )। তারা সবাই তখন বিশিষ্ট রাজনীতিক ও ছাত্র নেতা।
কাঠমিস্ত্রীরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছিলেন বঙ্গবন্ধুর জন্য সুন্দর আর মজবুত একটি মঞ্চ তৈরি করতে । তাঁরা সবাই আমার চেনা ছিল। আমি সেসব মিস্ত্রীদের কাকু আথবা দাদা বলে সম্বোদন করতাম । আমি এবং আমার ঠিক এক বছরের ছোট একমাত্র ভাই ‘মাসুম’ প্রতিদিন মঞ্চে উঠে দেখতাম কিভাবে মঞ্চ তৈরি হচ্ছে । মাঝে মাঝে আমি মিস্ত্রী কাকু/ দাদাকে জোর করতাম আমার হাতে হাতুড়ি দেবার জন্য । আমি হাতুড়ী হাতে নিয়ে মঞ্চের কাঠের উপর পেরেক ঠুকতাম মনের আনন্দে। পেরেকে হাতুড়ি ঠুকতে ঠুকতে আমি মনে মনে সানন্দ গর্ব বোধ করতাম এই ভেবে যে আমি বঙ্গবন্ধুর জন্য মঞ্চ তৈরি করছি যাকে দেখার জন্য সব গোপালগঞ্জ শহর অধীর আগ্রহে বসে আছে !
এখন পর্যন্ত আমি মনে করতে পারি যে আমি সানন্দ গর্বিত দৃঢ় পদক্ষেপে মঞ্চের ডাইনে থেকে বায়ে, সামনে থেকে পেছনে হেঁটেহেঁটে অনুভব করার চেষ্টা করতাম বঙ্গবন্ধু এই মঞ্চের ঠিক এখান দিয়ে হাঁটবেন যেখান দিয়ে আমি এখন হেঁটে বেড়াতে পারছি…!
আমাদের গ্রামের বাড়ি টুঙ্গিপাড়া যেটা আমাদের জাতীর পিতা বঙ্গবন্ধুর গ্রামের বাড়ি । বঙ্গবন্ধু এবং আমার আব্বা দুজনেই গোপালগঞ্জ মিশন স্কুল এর ছাত্র ছিলেন এবং পরবর্তীতে দুইজনই কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন ।
আমি স্পষ্ট মনে করতে পারি সেই দিনের কথা যেদিন বঙ্গবন্ধু গোপালগঞ্জ এসেছিলেন । মানুষে ঠাঁসাঠাসি সমস্ত শহর । যেদিকে চোখ যায় শুধু মানুষ আর মানুষ । আমি এর আগে কোনদিন এতো মানুষ দেখিনি একসাথে । আমাদের বাসা ও ভর্তি হয়ে গিয়েছিল মহিলাদের ভিড়ে। এদের মধ্যে অনেকেই দূর-দূরান্ত থেকে এসেছিলেন বঙ্গবন্ধুকে কাছ থেকে একবার দেখার জন্য । পুরো পরিবেশ ছিল আমার কাছে অকল্পনীয়!
যাদেরকে আমি দাদা বা ভাই সম্বোধন করতাম সেসব ছাত্রনেতাদের কারো মাধ্যমে আমি মঞ্চের ঠিক সামনে ঘাসের উপর বসে একদম কাছ থেকে বঙ্গবন্ধুকে দেখার বিশেষ সুবিধা পেয়েছিলাম।
আমি আশ্চর্য হয়েছিলাম, হতবাক হয়েছি্লাম, অভিভূত হয়েছিলাম এমন একজন বিশাল মানুষকে একদম কাছ থেকে দেখে । কী আদ্ভূত তিনি দেখতে! সবাইকে, সবকিছুকে ছাড়িয়ে তার সেই উচ্চতা। তাকে কি বাঘের চেয়েও সাহসী মনে হচ্ছিল ! পর্বতের চেয়েও বিশাল মনে হচ্ছিল! নাকি তিনি সাগরের চেয়ে বিস্তৃত! অথবা আকাশের মত সীমাহীন!
মনে হচ্ছিল আমি অন্যকোন গ্রহ থেকে আসা এক আশ্চর্য জাদুকরকে দেখছিলাম । আমি এক আশ্চর্য জাদুকরী কণ্ঠ শুনছিলাম যা মুহূর্তে চারিদিকের সবকিছুকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। শুধুমাত্র একটি উচ্চকণ্ঠ নিনাদ আকাশে বাতাসে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল ! একটি জাদুকরী কণ্ঠ আমাকে মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছিলো যতক্ষণ তিনি মঞ্চে ছিলেন ।
আমি বিস্ময়াভিভূত হয়েছিলাম, গর্বিত বোধ করছিলাম এই ভেবে যে আমি সেই জায়গাতে জন্ম গ্রহণ করেছি যেখানে এই বিশাল মানুষের জন্মস্থান । আমি সেই বাতাস থেকে আমার শ্বাস নিতে পারছি যেখানে তিনি শ্বাস নিয়েছেন প্রাণ ভরে । আমি সেই সূর্যালোক বা চন্দ্রালোক প্রতিদিন উপভোগ করছি যে আলোকে তিনি অবগাহন করেছেন । এপাড় থেকে ওপাড় যাবার আমাদের একটিই নদী। নাম ‘মধুমতী ’।
আমি তাঁকে অবাক বিস্ময়ে দেখছিলাম… কতক্ষণ ! কত সময় ধরে আমি জানিনা! আমি মনে করতে পারিনা, শুধু মনে আছে একটি শুভক্ষণ !!! কেউ একজন আমার হাত ধরে ভিড় ঠেলে মঞ্চের দিকে দ্রুত টেনে নিয়ে যাচ্ছিলেন এবং আমাকে বঙ্গবন্ধুর কাছাকাছি পৌঁছে দিতে পেরেছিলেন। এক মুহূর্তের জন্য আমি সেই আশ্চর্য মানুষের জাদুকরী স্পর্শ অনুভব করেছিলাম আমার হাতের উপর যা আমাকে মোহাচ্ছন্ন আর আপ্লুত করেছিল ।
লেখক: এডভোকেট, সুপ্রিম কোর্ট ।