সাবিহা ইয়াসমিন ইসলাম
৩/৪ দিন আগের কথা, কোর্ট থেকে ফিরছিলাম। ফেরার পথে দুটি দৃশ্য মনকে আবেগাচ্ছন্ন করে ফেলল –
একটি রিক্সাতে মা-বাবা দুজনের কোলে দুটি শিশু সন্তান । একজনের বয়স সম্ভবত ৭/৮ বছর আর একজনের বয়স ৪/৫ বছর। শিশু দুইটির চোখে মুখে আনন্দ উত্তেজনার ছাপ । বোঝা যাচ্ছে তারা বাবা-মায়ের সাথে ঈদের কেনা কাটা করতে যাচ্ছে !
আর একটি দৃশ্য – মটরসাইকেল চালাচ্ছেন বাবা। সামনে বসে বাবার পাশাপাশি মোটর সাইকেলের হ্যান্ডেল ধরে গর্বিত সাহসীভঙ্গিতে শক্ত হয়ে বসে আছে ৭/৮ বছরের একটি ছেলে। পেছনে বাবা-মায়ের মাঝখানে বাবার কোমর পেছিয়ে ধরে বসে আছে আদরের মেয়ে। বাচ্চা দুটির চোখে চক চকে আনন্দ । বোঝা যাচ্ছে ঈদের বাজার করতে যাচ্ছে তারা বাবা, মায়ের সাথে । এর পরের দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য হবে না তবু হয়তো আনুমান করতে পারি অভিজ্ঞতা থেকে।
আকাশ ছোঁয়া মূল্য সব পছন্দের জিনিসগুলোর । সাধ আর সাধ্যের বিশাল তফাত । অবশেষে সাধকে গলা টিপে সাধ্যকে প্রাধান্য দিয়ে বিষণ্ণ মুখে বাড়ি ফেরা…!
এমন দু-একটি ঘটনা এখনো মনে দাগ কেটে আছে –
কোন এক ঈদের বাজারে একটি বাচ্চা তার পছন্দের দামি একটি খেলনার কাছ থেকে একপা’ও সরছে না । মা-বাবা অনেক হিসাব করেও ‘বাজেট’ মেলাতে পারছেননা । বুদ্ধি করে তাঁরা ছেলেটিকে সেখান থেকে সরিয়ে নেবার অক্লান্ত ব্যর্থ চেষ্টা করে যাচ্ছেন । অত্যন্ত বুদ্ধিমান ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন ৫/৬ বছরের ছেলে শিশুটিও তার বুদ্ধির শেষ আস্ত্রটি ব্যবহার করে খেলনাটি পাবার আশাতে ! বাচ্চাটি তার চোখের পানি লুকিয়ে ভেজা কণ্ঠে মা’র কোমর জড়িয়ে ধরে বলে “ মা তুমি যদি আমাকে এটা কিনে দাও আমি বাসা যেয়ে আমার সব ‘হোম ওয়ার্ক’ এক্ষুণি শেষ করে ফেলবো, তুমি দেখো…” ।
আর একটি দৃশ্য আরও দর্শনীয় আর স্মরণীয় আমার কাছে এখনো কারণ দৃশ্যটির সাথে আমার জীবনের একটি অপূর্ব ঘটনার সাথে মিল খুঁজে পেয়েছিলাম –
সবার কেনা কাটা শেষ করে একজন মা নিজের জন্য একটি শাড়ির দোকানে এসেছেন। পছন্দের যে শাড়িই হাত দিচ্ছিলেন দাম শুনে সেটাই রেখে দেন । পাশে দাঁড়িয়ে থাকা তাঁর মায়াবতী ৭/৮ বছরের মেয়েটি সব খেয়াল করছিল । একসময় হয়তো মায়ের জন্য তার মায়ার বাঁধ ভেঙে যায় । মায়ের পছন্দের একটি শাড়ি বুকের কাছে আঁকড়ে ধরে কান্না ভেজা দৃঢ় কণ্ঠে দাবি জানায়, ‘এই শাড়িটি আমি তোমার জন্য কিনতে চাই মা’।
আমার ঘটনাটি ছিল এরকম –
আমার মেয়ে তখন খুব ছোট। সম্ভবত ১৯৮৯/৯৯ সালের কথা । ৯ টা ৫ টা অফিস করি তখন, ২টি ছোট বাচ্চা নিয়ে আমি তখন একা ঢাকা থাকি । অফিস থেকে ফিরে বাচ্চাদের সামলে দম ফেলার সময় থাকেনা আর। প্রতি বছর ঈদের আগে যতটুকু ছুটি পেতাম তাতে অন্য সবার জন্য প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করে নিজের জন্য পছন্দ করে কেনার সময় পেতাম না, কারণ ছুটি পেলেই আমাকে ঢাকার বাইরে আমার স্বামীর কর্মস্থলে ছুটতে হতো বাচ্চাদের নিয়ে ।
আমার ৭/৮ বছর বয়সের মায়াবতী মেয়েটি খেয়াল করে দেখেছে তার স্কুলের বান্ধবীদের সাথে সে কোনোদিন ও শেয়ার করতে পারেনা তার মা এবার ঈদে কি শাড়ি কিনেছেন । সে বুঝতে পারে না বিষয়টা কেন সে শেয়ার করতে পারে না ! মা কেন ঈদের শাড়ি কেনে না ! হয়তো সে ধারণা করে বসে সবার জন্য কেনা কাটা করে মায়ের টাকা শেষ হয়ে যায়। তাই মা কিনতে পারেনা !
একদিন আমার মেয়ে কেঁদে কেটে বায়না ধরে তাকে একটি শাড়ির দোকানে নিয়ে যেতে, সে শাড়ি দেখতে চায় । তার কান্না থামাতে আমি তাকে বাধ্য হয়ে বাসার পাসের একটি শপিং কমপ্লেক্স এ নিয়ে যাই । আমার মেয়ে জন্ম থেকেই তার বাবার মত মেধাবী । সে আমাকে আমাদের দেশিয় একটি শাড়ির দোকানে ঢুকতে বাধ্য করেছিলো । আমি চেয়ে চেয়ে দেখছিলাম আমার মেয়েটি প্রতিটি শাড়ি হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে কিছু একটা দেখছে । আমি চুপ চাপ দাঁড়িয়ে মেয়ের ছোটাছুটি উপভোগ করছিলাম । একটি শাড়ি আমার মেয়ে খুব মন দিয়ে দেখছিল । আমি অবাক হয়ে খেয়াল করলাম আমার মেয়ে শাড়ির দাম দেখছে উল্টে পাল্টে। এক সময় দৌড়ে এসে আমার কোমর জড়িয়ে ধরে আমার শরীরের সাথে তার মুখ চেপে ধরে ফুপিয়ে কেঁদে তার ইচ্ছে জানায় ‘মা আমি ঐ শাড়িটা তোমার জন্য কিনতে চাই’। ( শাড়িটির দাম ১০০০ টাকা। অসম্ভব সুন্দর হাল্কা বেগুনি জমিনে গাঁঢ় বেগুনি পাড়ের দেশি তাঁতের শাড়ি ) । মেয়ের সেই সাহসী ইচ্ছে উপেক্ষা করার সাহস আমার হল না। আমি শাড়িটি প্যাকেট করতে বলে দাম দিতে টাকা বের করছিলাম কিন্তু আমার সেই ছোট মেয়ে আমাকে আরও অবাক করে দিয়ে তার পিঠে ঝুলিয়ে রাখা ব্যাগ সামনে এনে তার থেকে এক বান্ডিল টাকা বের করে আমার হাতে দিয়ে বলে ‘মা গুনে দেখ তো ১০০০ টাকা আছে কিনা?।’ আমার পরম বিস্ময় গোপন করে টাকাগুলো হাতে নিয়ে দেখি সব ১০ টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ১০০ টাকার কয়েকটি নোট। সব মিলিয়ে ১০০০ টাকাই ছিল। আমি টাকা পরিশোধ করে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে বাসাতে ফিরি । পথে মেয়ে বার বার মুখ তুলে আমার খুশি পরিমাপ করার চেষ্টা করছিলো । যতবার সে মুখ তুলে আমাকে দেখছিল ততবারই আমি তাকে একটি করে কপালে চুমু দিয়ে তার আবেগ/আনুভূতির মর্যাদা দেবার চেষ্টা করছিলাম…।
সময়ের সাথে সাথে সব হয়তো বদলে যায় অথবা অনুভুতি বদলে যায় বলে সব বদলে গেছে বলে মনে হয়। আমার কাছে ঈদের খুশির ধরণ এখন বদলে গেছে বলে মনে হয় । কেন জানিনা মনে হয় ঈদের খুশি এখন কেনা কাটার মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। সাধ আর সাধ্যের পার্থক্যের জন্য আনন্দের চেয়ে হতাশা প্রাধান্য পাচ্ছে ! আনন্দবোধ কেনাকাটার সাধ্যের মধ্যে স্থান করে নিয়েছে ! মানবিক সুখের অনুভূতি গুলো চাওয়া পাওয়ার সাধ্যের মধ্যে হারিয়ে যেতে বসেছে !
আমাদের ছোট বেলায় ঈদ মানে ছিল আন্যরকম আনুভুতি । ঈদ মানে খোলা মাঠে সবাই একসাথে মিলে ঈদের চাঁদ দেখা । একজন দেখতে পেলে বাকি সবাইকে একে আনের মাথার কাছে মাথা টেনে নিয়ে চাঁদের দিকে আঙ্গুল তুলে চাঁদ দেখানোর চেষ্টা করা । চাঁদ দেখতে পেলে একছুটে বাসাতে ফিরে দাদি , মা, আব্বাকে সালাম করা । ঈদের সালামি নেয়া । ঈদের ৩/৪ দিন আগে থেকে শুরু হতো ঘর সাজানোর আয়োজন । বড় বোনেরা ঘর সাজাত । আমরা ছোটরা তাঁদের পাশে পাশে ঘুরে ঘুরে সব দেখতাম, উপভোগ করতাম সেই আনন্দ। রাজ্যের ফুল দিয়ে সাজানো হতো বাসা । নতুন টেবিল ক্লথ, নতুন বিছানার চাদর অথবা একদম পাটভাঙা ইস্ত্রিকরা সব ‘কভার’ দিয়ে ঢেকে সাজানো হতো টেবিল, বিছানা গুলো। নতুন জামা বানিয়ে ঈদের দিন পর্যন্ত লুকিয়ে রাখতাম যেন কেউ দেখে না ফেলে । ঈদের দুদিন আগে থেকে আত্মীয়দের বাসাতে ইফতারি পাঠানো হতো । এসব ছিল ঈদের আনন্দের অংশ । মার আর দাদির জন্য সবার আগে ঈদের কেনাকাটা করা হতো । শাড়ির বোঝা বাসায়ে নিয়ে আসা হতো । সেখান থেকে আমরা বোনেরা মিলে দাদি আর মার জন্য শাড়ি পছন্দ করতাম।
২৭ রোজাতে আমাদের বাসাতে হতো মেহেদী উৎসব । পাড়ার সব মেয়েরা আমাদের বাসাতে এক হয়ে মেহেদী দিতো । আমার বড় বোনেরা খুব সুন্দর করে মেহেদী পরাতে পারতো । এ সব কিছুই ছিল তখন ঈদের আনন্দের অংশ ।
বিয়ের পর ঈদের আনন্দর ধারনা হয়তো বদলে যেতে বাধ্য হয়েছে তবুও আমি আমার মত করে চেষ্টা করেছি ধরে রাখার । সরকারি কর্মকর্তা হিসাবে আমার স্বামীর বিভিন্ন জেলা শহর গুলোতে পোস্টিং যখন ছিল তখন ঈদের চাঁদ দেখতে একদম গ্রামের দিকে ফাঁকা জায়েগাতে চলে গিয়েছি সবাই মিলে । চাঁদ দেখা উৎসব করেছি । ঈদের দিন সময় করে শহর ছেড়ে কোন কোন গ্রামে বাড়িতে বাড়িতে ঘুরে সাধারণ মানুষের সাথে ঈদের আনন্দ কিছুক্ষণ উপভোগ করার চেষ্টা করেছি।
১৯৯৪ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ সময় ধরে জেলা প্রশাসক হিসাবে আমার স্বামীর কর্মস্থলে ঈদকে সার্বজনীনভাবে উপভোগ করেছি । সব বিভাগের সর্বস্তরের সবাই মিলে আমাদের বাসভবনে এক চাঁদোয়ার নিচে ঈদের আনন্দ উৎসব করেছি ।
ঈদের আনন্দ অনুভূতি মানে আত্মীয়-অনাত্মীয়, চেনা-অচেনা, আশে পাশের সবাই মিলে ঈদের আনন্দ উপভোগ করুক । ঈদ সবার জন্য শুভ হোক । আনন্দময় হোক। সবার জন্য শুভ কামনা ।
লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট