মাধ্যমিক স্তরে মাত্র ২ বছরে ঝরে পড়েছে ৫ লাখ ৮১ হাজার শিক্ষার্থী। এবার এসএসসি, দাখিল ও এসএসসি সমমান পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে ২০ লাখ ৭২ হাজার ১৬৩ ছাত্রছাত্রী। তাদের মধ্যে নিয়মিত পরীক্ষার্থী ১৮ লাখ ৫৮ হাজার ৭৫৮ জন।
অন্যদিকে নবম শ্রেণিতে তাদের সঙ্গে নিবন্ধন করেছিল ২৪ লাখ ৩৯ হাজার ৭৪৬ জন। বাকি শিক্ষার্থীরাই ঝরে পড়েছে। এটা নিবন্ধিত শিক্ষার্থীর তুলনায় প্রায় ২৪ শতাংশ। ৩০ এপ্রিল সারা দেশে একযোগে এই পরীক্ষা শুরু হবে।
শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এমনিতেই মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষা ব্যয় অনেক বেশি। স্কুল-মাদ্রাসার খরচের পাশাপাশি অপরিহার্য ব্যয় হচ্ছে কোচিং-প্রাইভেট আর নোট-গাইড। এছাড়া খাতা-কলম ও আনুষঙ্গিক ব্যয় আছে। করোনা মহামারির কারণে মানুষের মধ্যে বিশেষ করে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আয় কমেছে। বেকারত্বের হারও বেড়েছে উদ্বেগজনকভাবে। উদ্ভ‚ত পরিস্থিতিতে কেউ সন্তানকে অর্থ উপার্জনে ভিড়িয়ে দিয়েছেন। আবার কেউ কন্যা সন্তানকে বিয়ে দিয়েছেন। ফলে কমেছে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সাবেক আহ্বায়ক এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, গত বছরের তুলনায় এবার পরীক্ষার্থী বেড়েছে সবমিলে অর্ধলাখের বেশি। তাদের মধ্যে ছাত্রী সাড়ে ৩৮ লাখ।
এই হিসাবে বলা যায়, বাল্যবিয়ে অন্য বাস্তবতা তেমন প্রভাব ফেলেনি। তবে এটা সত্যি, করোনার অভিঘাত লেখাপড়ায় পড়েছে। করোনাকালে ভার্চুয়াল মাধমে লেখাপড়া অব্যাহত রাখার পরও সবার লেখাপড়ার ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব হয়নি। তাই যাদের আÍবিশ্বাসের ঘাটতি আছে তারা নিবন্ধিত হওয়ার পরও পরীক্ষায় বসছে না। এছাড়া বাংলাদেশে দারিদ্র্য ও সামাজিক প্রতিক‚ল অবস্থাসহ সব সময় ঝরে পড়ার ওপর প্রভাব ফেলে। আগামীতে হয়তো পরীক্ষায় বিরত থাকা শিক্ষার্থীরা লেখাপড়ায় ফিরে আসবে। তখন পরীক্ষার্থী বেশি পাওয়া যেতে পারে।
পরীক্ষা সামনে রেখে মঙ্গলবার দুপুরে শিক্ষা মন্ত্রণালয় আইনশৃঙ্খলাসংক্রান্ত বৈঠক করেছে। পরে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি সংবাদ সম্মেলন করেন। রাজধানীর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে ওই অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া সম্পর্কে অবশ্য কোনোকিছু বলেননি শিক্ষামন্ত্রী। তবে তিনি জানান, পরীক্ষা সুষ্ঠু ও নকলমুক্তভাবে অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে সার্বিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। প্রশ্নফাঁসসহ অন্যান্য বিষয়ে ১৬ দফা পদক্ষেপের কথা উলেখ করে তিনি বলেন, ২৬ এপ্রিল থেকে ২৩ মে পর্যন্ত দেশের সব ধরনের কোচিং সেন্টার বন্ধ থাকবে। প্রশ্নফাঁস রোধের পদক্ষেপের অংশ হিসাবে এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হবে।
অভিভাবকদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, প্রশ্নফাঁসের কোনো সুযোগ নেই। অভিভাবকদের অনুরোধ জানাচ্ছি, গুজবে কান দেবেন না। কেউ গুজব সৃষ্টি করার চেষ্টা করবেন না। গুজব সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। শিক্ষামন্ত্রী আরও জানান, মধ্য আগস্টে এবারের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা নেওয়া হবে।
জানা গেছে, যে ৫ লাখ ৮১ হাজার শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে তাদের মধ্যে ঢাকা বোর্ডেই আছে ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৭ জন। এই বোর্ডে ৪ লাখ ৮৮ হাজার ৬৭৯ জন নিবন্ধন করে। কিন্তু পরীক্ষা দিচ্ছে ৩ লাখ ৮৭ হাজার ৩২২ জন। অবশ্য অনিয়মিত এবং গত বছরের ফেল করা শিক্ষার্থী নিয়ে এই বোর্ডে মোট পরীক্ষার্থী ৪ লাখ ১৯ হাজার ৬৪৩ জন। রাজশাহী বোর্ডে ৩৮ হাজার ৫৬৫ জন ঝরে পড়েছে। এই বোর্ডে ২ লাখ ১৯ হাজার ৩৯৫ জন নিবন্ধন করে। পরীক্ষা দিচ্ছে ১ লাখ ৮০ হাজার ৮৩০ জন। তবে অনিয়মিত এবং গত বছরের ফেল করা শিক্ষার্থী নিয়ে এই বোর্ডে মোট পরীক্ষার্থী ২ লাখ ৫ হাজার ৮০২ জন। এভাবে কুমিলা বোর্ডে ৫৭ হাজার ১৫৪ জন, যশোরে ৪৫ হাজার ২৪৭ জন, চট্টগ্রাম বোর্ডে ৩৩ হাজার ৫১৬ জন, বরিশালে ২০ হাজার ১১৪ জন, সিলেটে ২৪ হাজার ১২০ জন, দিনাজপুরে ৪৩ হাজার ৩৫৩ জন, ময়মনসিংহ বোর্ডে ২০ হাজার ৮৭৬ জন, মাদ্রাসা বোর্ডে ১ লাখ ৩৩ হাজার ৫৫১ জন এবং কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে ৬৩ হাজার ৩৭ জন ঝরে পড়েছে। নিবন্ধিত শিক্ষার্থীর তুলনায় ঝরে পড়ার হার সবচেয়ে বেশি মাদ্রাসা বোর্ডে, প্রায় ৩৫ শতাংশ।
সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী আরও বলেন, ২০২৩ সালের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় যেসব পরীক্ষার্থী অংশ নিচ্ছে তাদের মধ্যে ছাত্র ১০ লাখ ২১ হাজার ১৯৭ এবং ছাত্রী ১০ লাখ ৫০ হাজার ৯৬৬ জন। ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ১৬ লাখ ৪৯ হাজার ২৭৫ জন। এর মধ্যে ছাত্র ৭ লাখ ৭৯ হাজার ৮৭০ জন এবং ছাত্রী ৮ লাখ ৬৯ হাজার ৪০৫ জন। মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে ২ লাখ ৯৫ হাজার ১২১ জন পরীক্ষার্থী অংশ নেবে। এর মধ্যে ছাত্র ১ লাখ ৪৩ হাজার ৯৯৩ জন এবং ছাত্রী ১ লাখ ৫১ হাজার ১২৮ জন। আর কারিগরি বোর্ডে ছাত্র ৯৭ হাজার ৩৩৪ ও ছাত্রী ৩০ হাজার ৪৩৩ জন পরীক্ষা দেবে।
শিক্ষামন্ত্রী জানান, ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে পরীক্ষার্থী বৃদ্ধি পেয়েছে ৫০ হাজার ২৯৫ জন। এর মধ্যে ছাত্রী বেড়েছে ৩৮ হাজার ৬০৯ জন। এ ছাড়া মোট প্রতিষ্ঠান বেড়েছে ২০৭টি এবং কেন্দ্র বেড়েছে ২০টি। এ বছর বিজ্ঞান বিভাগের পরীক্ষার্থী ৫ লাখ ৪৪ হাজার ৫৭৪ জন। যা গত বছর ছিল ৫ লাখ ৭ হাজার ২৫৪ জন। এবার বিজ্ঞান বিভাগে ৩৭ হাজার ৩২০ জন পরীক্ষার্থী বেড়েছে। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব মো কামাল হোসেন, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব সোলেমান খান প্রমুখ।
সংশোধিত সিলেবাস : এবারও সংশোধিত ও পুনর্বিন্যাসকৃত সিলেবাসে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। আংশিক নয় পূর্ণ বা ১০০ নম্বরেই পরীক্ষা হবে। পরীক্ষার সময় ৩ ঘণ্টা। সাধারণ শিক্ষা বোর্ডে তত্ত্বীয় পরীক্ষা ৩০ এপ্রিল হতে ২৩ মে এবং ব্যবহারিক পরীক্ষা ২৪ মে শুরু হয়ে ৩০ মে শেষ হবে। আর মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডে তত্ত্বীয় পরীক্ষা ৩০ এপ্রিল হতে ২৫ মে এবং ব্যবহারিক পরীক্ষা ২৭ মে শুরু হয়ে ৩ জুন শেষ হবে। অপরদিকে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে তত্ত্বীয় পরীক্ষা ৩০ এপ্রিল থেকে ২৩ মে এবং ব্যবহারিক পরীক্ষা ২৫ মে শুরু হয়ে ৪ জুন শেষ হবে।
প্রশ্নফাঁস রোধে ব্যবস্থা : ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার জানান, মোট ১৬ ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এগুলোর সবই দাপ্তরিক। এছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও বিটিআরসিকে সর্বোচ্চ সতর্ক রাখা হয়েছে। পরীক্ষা চলাকালে ফেসবুকে প্রশ্নফাঁস নিয়ে গুজব এবং মোবাইল ব্যাংকিংয়ে সন্দেহজনক লেনদেন নজরদারি রাখা হবে। পাশাপাশি যেসব গ্র“প বা ব্যক্তি ফেসবুকে প্রশ্নফাঁসের গুজব ছড়াবে তাদের আইডি শনাক্ত করে পুলিশের বিশেষ শাখা এবং গোয়েন্দা সংস্থাকে দেওয়া হবে। প্রশ্ন ছাপানোর সঙ্গে সম্পৃক্ত বিজি প্রেসের সব কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে গোয়েন্দা নজরদারিতে রাখা হবে। এমনকি প্রশ্ন সর্টিং ও বহনে জড়িত শিক্ষক ও কর্মকর্তারাও নজরদারিতে থাকবেন।
গৃহীত ১৬ ধরনের ব্যবস্থার মধ্যে আছে-পরীক্ষা শুরুর কমপক্ষে ৩০ মিনিট পূর্বে পরীক্ষার্থীদের অবশ্যই পরীক্ষার হলে প্রবেশ করতে হবে। অনিবার্য কারণে কোনো পরীক্ষার্থী বিলম্বে^ কেন্দ্রে উপস্থিত হলে, তার নাম, রোল নম্বর, প্রবেশের সময়, বিলম্ব^ হওয়ার কারণ ইত্যাদি একটি রেজিস্টারে লিখে রাখা হবে। কেন্দ্র সচিব ছবি তোলা ও ইন্টারনেট ব্যবহারের সুবিধাবিহীন একটি সাধারণ (ফিচার) ফোন ব্যবহার করতে পারবেন। কেন্দ্র সচিব ব্যতীত পরীক্ষা কেন্দ্রে অন্য কেউ মোবাইল ফোন বা অননুমোদিত ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করতে পারবেন না। ট্রেজারি-থানা হতে প্রশ্নপত্র গ্রহণ ও পরিবহণ কাজে নিয়োজিত কর্মকর্তা, শিক্ষক, কর্মচারীগণ কোনো ফোন ব্যবহার করতে পারবেন না এবং প্রশ্নপত্র বহন কাজে কালো কাচ যুক্ত মাইক্রোবাস বা এরূপ কোনো যানবাহন ব্যবহার করা যাবে না।
এছাড়া প্রতিটি কেন্দ্রের জন্য একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও একজন ট্যাগ অফিসার নিয়োগ প্রদান করা হবে। ট্যাগ অফিসার ট্রেজারি, থানা হেফাজত হতে কেন্দ্র সচিবসহ প্রশ্নপত্র বের করে পুলিশ প্রহরায় সব সেটের প্রশ্ন কেন্দ্রে নিয়ে যাবেন।পরীক্ষা শুরু হওয়ার ২৫ মিনিট পূর্বে প্রশ্নের সেট কোড ঘোষণা করা হবে। সে অনুযায়ী কেন্দ্র সচিব, ট্যাগ অফিসার ও পুলিশ কর্মকর্তার স্বাক্ষরে প্রশ্নপত্রের প্যাকেট বিধি অনুযায়ী খুলবেন। জেলার ক্ষেত্রে ট্রেজারি এবং উপজেলার ক্ষেত্রে থানায় প্রশ্নপত্রের ট্রাংক সংরক্ষণ করতে হবে। ট্রেজারিতে রক্ষিত প্রশ্নপত্র পরীক্ষা শুরুর তিন দিন আগে দিন ভিত্তিক ও সেটভিত্তিক সর্টিং করে সিকিউরিটি খামে সংরক্ষণ করতে হবে।