প্রতিনিধি=
২৬ লাখ চাঁদপুরবাসীর একমাত্র প্রধান চিকিৎসাসেবা কেন্দ্র চাঁদপুর জেলা শহরে অবস্থিত ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট চাঁদপুর জেনারেল হাসপাতাল। যার সংক্ষিপ্ত নাম চাঁদপুর সদর হাসপাতাল। এটি শুধু চাঁদপুর জেলাবাসী নয়, পার্শ্ববর্তী জেলার লক্ষ্মীপুর, শরীয়তপুর, মুন্সীগঞ্জ সহ আশেপাশের জেলা ও উপজেলার জনগণও এ হাসপাতালে থেকে চিকিৎসা সেবা নিতে আসে। এমনিতেই দেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নিয়ম ও নির্দেশনা অনুযায়ী ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালের জন্য প্রয়োজনীয় ডাক্তার, নার্স, চিকিৎসা সরঞ্জামসহ উপকরণ ও জনবল সঙ্কট রয়েছে। এ সঙ্কটের অজুহাতে চিকিৎসা সেবা থেকে প্রতিনিয়তই সাধারণ জনগণ বঞ্চিত হওয়ার অভিযোগ রয়েছে। ২৫০ শয্যা চাঁদপুর জেনারেল হাসপাতালে এমনিতে চিকিৎসা সেবা নিতে এসে মানুষজন কিছুটা হলেও ভোগান্তিতে পড়লেও ওই সময়ে চেম্বারগুলোর ভেতরে এবং বাহিরে ঔষধ কোম্পানীর প্রতিনিধির দৌরাত্ম থেমে নেই। দেশের ঔষধ কোম্পানিগুলোর প্রতিনিধি (রিপ্রেজেন্টিটিভদের) দৌরাত্ম আর নিয়ম-কানুন না মানার কারণে সেবা নিতে আসা সাধারণ মানুষ তাদের দ্বারাই ভোগান্তির শিকার হচ্ছে।
গত ১৫ ডিসেম্বর ও ১৮ ডিসেম্বর সকাল ৯টা থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত সরজমিনে হাসপাতালে উপস্থিত হয়ে দেখা যায়, ঔষধ কোম্পানিগুলোর প্রতিনিধিদের উৎপাত আর দৌরাত্ম দেখে প্রত্যন্ত অঞ্চলের অসহায়, দরিদ্র মানুষগুলো চিকিৎসা সেবা নিতে এসেও তা সঠিকভাবে পাচ্ছে না। গত দু’দিনে হাসপাতালে কর্মরত ডাক্তারদের চেম্বারগুলোর ঘুরে দেখা যায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দেশের ঔষধ কোম্পানিগুলোর প্রতিনিধি বা রিপ্রেজেন্টিটিভদের সাথে ডাক্তারদের ভিজিট করার যে নিয়ম বেঁধে দিয়েছেন তা যেনো কাগজে কলমে সীমাবদ্ধ। এদের কর্মকাণ্ড দেখে মনে হয় যেনো জনস্বার্থে নিয়ম প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন শুধু কোম্পানিগুলোর ঔষধ বিক্রি করার। এছাড়াও পেশাজীবী সংগঠন অর্থাৎ চিকিৎসকদের সংগঠন বিএমএ’র পক্ষ থেকেও এ ব্যাপারে ঔষধ কোম্পানিগুলোর প্রতিনিধিদের জন্য নিয়ম-নীতি পালন করে কাজ করার আহ্বান জানালেও সেগুলো কোনো কর্ণপাতই করছে না তারা। অথচ দেশে প্রতিষ্ঠিত প্রায় ৩ শতাধিক ঔষধ কোম্পানিগুলোতে সারাদেশে প্রায় ৫ লক্ষাধিক তরুণ ও যুবকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে। আর এসব কোম্পানিগুলোতে চাকুরি যারা করেন তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা কোম্পানির নিয়ম মতে সর্বনিম্ন ডিগ্রি পাস (গ্র্যাজুয়েশন) সর্বোচ্চ মাস্টার্স পাস করা।
এ সকল উচ্চ শিক্ষিত লোকজন দেশের সকল নিয়ম-আইন কানুন সবকিছুই তাদের জানা। তারা আমাদের দেশের সচেতন ব্যক্তিদের অন্যতম। অথচ কোম্পানিগুলোতে চাকুরি করার সুবাদে এরা অন্ধ হয়ে নিয়ম-নীতিকে তোয়াক্কা করছে না। সকল কিছুর ঊর্ধ্বেই এরা মনে করে ঔষধ কোম্পানির টার্গেট পূরণই তাদের মূল লক্ষ্য। কে বাঁচলো আর কে মারা গেল এটি দেখার বিষয় নয়।
সরজমিনে আরো দেখা যায়, হাসপাতালে দায়িত্বরত ডাক্তারদের সরকারি নিয়ম অনুযায়ী যে সময় কর্মস্থলে স্থানে আসার কথা তার কিছু আগেপরে তারা এসে হাসপাতালে ঢুকে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থতলায় সাধারণ বেড থেকে শুরু করে কেবিন ও পেয়িং বেডে চিকিৎসাধীন রোগীদের দেখে পরবর্তী চিকিৎসার নির্দেশ দিয়ে আসেন। এরপর তাদের নির্ধারিত রুমে অপেক্ষমান চিকিৎসা সেবা নেওয়ার জন্য তৃণমূল পর্যায় থেকে আসা জনগণকে সেবা দেওয়া শুরু করেন। এ হাসপাতালে চিকিৎসক সঙ্কটের কারণে একজন কর্তব্যরত ডাক্তার কোনো কোনো দিন শতাধিকের ওপরেও রোগী দেখতে হয়। একজন চিকিৎসক রোগী দেখা শুরু করলে রোগীর সাথে তার রোগের লক্ষ্মণ, শারীরিক বর্তমান অবস্থা, এক কথায় পূর্ব ও বর্তমান সবকিছু জেনেশুনে চিকিৎসাপত্র লেখেন। এজন্য অবশ্যই তিনি মনোযোগ দিয়েই রোগীর কথাটি শোনেন। কিন্তু এ ঔষধ কোম্পানিগুলোর প্রতিনিধিদের ডাক্তার রুমে ঢোকার পর থেকে বের হওয়া পর্যন্ত চলতেই থাকে গুনগুন। ঔষধের স্যাম্পল, ঔষধগুলোর নতুন নতুন নামের তালিকা, বিভিন্ন উপহার ইত্যাদি দিতে দিতে আর কথা বলতে বলতে ডাক্তারদের মনোযোগ অন্যদিকে নিয়ে যান। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যায়, ডাক্তার এক কানে রোগীর কথা অন্য কানে ঔষধ কোম্পানির প্রতিনিধির কথা শুনছেন। এতে রোগীর কতটুকু ওই চিকিৎসা সেবা উপকারে আসলো সেটা কারো দেখার বিষয় নয়। আবার ডাক্তার রোগী দেখে তাকে প্রয়োজনীয় ঔষধ কিনে খাওয়ার জন্য যে স্লিপটি লিখে হাতে দেন। রোগী ডাক্তারের রুম থেকে বের হলেই অপেক্ষমান ঔষধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা এক ঝিলিকে টান দিয়ে স্লিপটি নিয়ে একজনের পর একজন দেখেন কোন কোম্পানির কোন ঔষধ লিখেছেন। আর অসহায়ের মতো দুচোখ দিয়ে রোগী বা রোগীর লোকজন তাকিয়েই থাকেন। এ যেনো বলার কিছু নেই। এভাবেই চাঁদপুর সদর হাসপাতালে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি চলছে তো চলছেই। অথচ এদের নিয়ন্ত্রণহীন এ কার্যক্রমে নিয়ন্ত্রণ করার মতো যেনো কারো কোনো দায়িত্ব নেই। বর্তমানে দেশের সহিংস রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জনগণ ঘর থেকে এমনিতেই বের হতে চায় না তারপরও বের হলেও আতঙ্কের মধ্য দিয়ে বের হতে হয়। রাজনৈতিক কর্মসূচি না থাকলে হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা বেড়ে যায়। আবার প্রয়োজনের তুলনায় চিকিৎসক সঙ্কটের কারণে রোগীগণ সংশ্লিষ্ট চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হয়। কোনো রকমে অন্তত একটু চিকিৎসা পেয়ে যখন হাঁফছাড়ার সময় তখন এ সকল ঔষধ কোম্পানিগুলোর রিপ্রেজেন্টিভদের অনাকাক্সিক্ষত কর্মকাণ্ড দেখে মনে হয় যেনো এ দেশে আইন বা নিয়ম বলে কিছুই নেই।
এ বিষয়ে ঔষধ কোম্পানিগুলোর প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত ফারিয়া নামক সংগঠনের সভাপতির দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও বিএমএ’র পক্ষ থেকে ঔষধ কোম্পানিগুলোর প্রতিনিধিদের যে নিয়মের কথা উল্লেখ করে চিঠি দেয়া হয়েছে, সেই বিষয়ে আমি আমার সহকর্মীদেরকে বলে দিয়েছি। তারপরও এদের মধ্যে কেউ কেউ এ নিয়ম না মেনে চলছে। তবে বিষয়টি নিয়ে কথা হবে।
চাঁদপুর জেলা বিএমএ’ নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক ও উক্ত হাসপাতালে কর্মরত ডাক্তার মাহমুদুন নবী মাসুমের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, বিএমএ’র পক্ষ থেকে আমরা একটি নিয়ম মোতাবেক কাজ কর্ম করার জন্য তাদের সংগঠনের বরাবরে চিঠি দেয়া হয়েছে। তারপরও কিছু কিছু বিষয় আমার চোখে পড়েছে। আমি আমার কর্তৃপক্ষের সাথে আলাপ-আলোচনা করে বিষয়টি ফয়সালা করবো।
২৫০ শয্যা বিশিষ্ট চাঁদপুর জেনারেল হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্বে নিয়োজিত ডা. মো. সিরাজুল ইসলামের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, স্যার অসুস্থ। আমি ভারপ্রাপ্ত দায়িত্বে রয়েছি। স্যার আসুক, বিষয়টি নিয়ে আমি কথা বলবো।
শিরোনাম:
রবিবার , ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ , ২৪ ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।