কখন কোন আম খাবেন আমের রাজত্ব ২২ জেলায়
কোথায় নেই আম—বাগানে, হাটে, মাঠে বা সড়কের দুই পাশে। রাজশাহী থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ হয়ে নওগাঁর পথের দুই পাশে শুধু আমেরই রাজত্ব। শুধুই কি বরেন্দ্রর এই মাটি, তা কিন্তু নয়। চাঁপাইনবাবগঞ্জে অবস্থিত আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের হিসাবে, দেশের ২২টি জেলায় এখন বাণিজ্যিক ভিত্তিতে আমের চাষ হচ্ছে।
দেশের জাতীয় বৃক্ষ আমগাছ উত্তরের বরেন্দ্র এলাকা ছাড়িয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের লবণাক্ত এলাকা আর পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকা—সবখানেই আমের রাজত্ব বাড়ছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহীতে তো দেখা গেল রীতিমতো তারের বেড়া আর পাহারাদার বসানো হয়েছে আমবাগানে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, প্রতিবছর নতুন করে আট হাজার হেক্টর জমি আম চাষের আওতায় আসছে। আম উৎপাদন বাড়ছে ৫০ হাজার মেট্রিক টন করে। আর জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) বলছে, তিন বছর ধরে বাংলাদেশ বিশ্বের অষ্টম আম উৎপাদনকারী দেশের সম্মান ধরে রেখেছে। গত ১০ বছরে দেশে আমের উৎপাদন চার গুণ বেড়ে হয়েছে ১০ লাখ টন। ২০০৫ সালেও বাংলাদেশে মাত্র আড়াই লাখ টন আম উৎপাদন করে বিশ্বের ১৪তম উৎপাদনকারী দেশের তালিকায় ছিল। বছরে সাড়ে ১১ লাখ টন আম উৎপাদন করে সপ্তম স্থানে থাকা ব্রাজিলকে ছুঁই-ছুঁই করছে এখন বাংলাদেশ।
আম উৎপাদন ও ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দেশের পুষ্টিচাহিদা পূরণের পাশাপাশি আম হতে পারে দেশের অন্যতম প্রধান রপ্তানি পণ্য। গত বছর তো বাংলাদেশ বিশ্বখ্যাত খুচরা পণ্য বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান ওয়ালমার্টে আম বিক্রি করে বিশ্বের আম রপ্তানিকারক দেশের তালিকায় যোগ দিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রের বাজার মিলিয়ে গত বছর বাংলাদেশ থেকে ৮২১ টন আম রপ্তানি হয়েছে।
বাংলাদেশ আম উৎপাদনকারী ও ব্যবসায়ী সমিতি সভাপতি আবদুল ওয়াহেদ বলেন, তাঁরা এ বছর তিন হাজার টন আম রপ্তানির আশা করছেন। রপ্তানির এই নতুন সম্ভাবনা দেশের আম চাষের ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ করবে বলে মনে করেন তাঁরা।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের বেশির ভাগ বাগানে এখনো আম পাকেনি। তবে জেলার কানসাট, শিবগঞ্জ, ভোলাহাট ঘুরে দেখা গেল, সেখানে ইতিমধ্যে কাঁচা আমের বাণিজ্য শুরু হয়ে গেছে।
দেশের আম উৎপাদনকারী জেলাগুলোর মধ্যে এখনো শীর্ষে আছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ। এ জেলার প্রায় ২৫ হাজার হেক্টর জমিতে আম চাষ হয়। এরপরেই রয়েছে রাজশাহী। এখানে এ বছর ১৬ হাজার ৫১৯ হেক্টর জমিতে আম চাষ হয়েছে। এই দুই জেলাকে দেশের বাণিজ্যিক আম চাষের আদি ভূমি বলা হয়।
বাংলাদেশ আম উৎপাদনকারী ও ব্যবসায়ী সমিতির হিসাবে, দেশে বর্তমানে আমের অভ্যন্তরীণ বাজার দাঁড়িয়েছে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকায়। শুধু চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমকে কেন্দ্র করে বছরে দেড় থেকে দুই হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়।
তবে আশির দশক থেকে চুয়াডাঙ্গা, সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, নড়াইলেও বাণিজ্যিকভাবে আম চাষ ছড়িয়ে পড়েছে। পাঁচ-ছয় বছর ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামেও আম চাষ দ্রুত বাড়ছে। বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে এ বছর প্রায় ১০ হাজার হেক্টর জমিতে আম চাষ হয়েছে। এ ছাড়া পঞ্চগড়, নাটোর, নওগাঁ, ঠাকুরগাঁও, পাবনা, দিনাজপুর, রংপুর, যশোর, গোপালগঞ্জ, টাঙ্গাইল, জামালপুরেও বাণিজ্যিকভাবে আম চাষ হচ্ছে।
সরকারি হিসাবে মে থেকে আগস্ট পর্যন্ত—এই তিন মাসের আমের মৌসুমে দেশের মানুষ গড়ে তিন কেজি করে আম খাচ্ছে। অর্ধযুগ আগেও এর পরিমাণ ছিল দুই কেজিরও কম।
এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক হামিদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘পৃথিবীর আমের অন্যতম আদি ভূমি এই বাংলাদেশ। এখানকার নিজস্ব আদি প্রজাতি ছাড়াও বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত বেশ কিছু জাত এখন ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে কীভাবে আম চাষ করা যায়, সে জন্য আমরা কৃষকদের পরামর্শ দিচ্ছি। ফলে দ্রুত হারে আমের উৎপাদন বাড়ছে।’
চাঁপাইনবাবগঞ্জ আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের হিসাবে বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ৮০০ জাতের আম চাষের সন্ধান পাওয়া গেছে। এর বাইরে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা ১১টি ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা ২১টি আমের জাত উদ্ভাবন করেছেন। এর মধ্যে আম্রপালি সবচেয়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছে।