করোনার অবস্থা যদি ভালো হয়, তাহলে স্কুল খোলা হবে, না হলে খোলা হবে না বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিদ্যালয়গুলো না খোলা পর্যন্ত অনলাইন শিক্ষা কর্মসূচি অব্যাহত রাখার পাশাপাশি সকলকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। গতকাল গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ভার্চ্যুয়ালি এক অনুষ্ঠানে ২০২১ শিক্ষাবর্ষের প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক স্তর, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন স্তরের শিক্ষার্থীদের মাঝে বিনামূল্যের পাঠ্যপুস্তক বিতরণ কার্যক্রম উদ্বোধনকালে তিনি এ আহ্বান জানান। স্বাস্থ্যবিধি মেনে রাজধানীর শেরে বাংলানগরস্থ বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র মিলনায়তনে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন কয়েকজন প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা বিভাগের শিক্ষার্থীর হাতে নতুন পাঠ্যপুস্তক তুলে দেন। আজ থেকে সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় বই বিতরণ শুরু হবে। এরপর পর্যায়ক্রমে তিনদিন করে মোট ১২ দিন ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের নতুন বই বিতরণ করা হবে। করোনাভাইরাসের কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় পয়লা জানুয়ারি বই উৎসব না হলেও বছরের শুরুতেই শিক্ষার্থীরা বিনামূল্যে বই পাচ্ছে। এবার ছাপা হচ্ছে প্রায় ৩৫ কোটি বই।
শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন। শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীও অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের সচিব মো. আমিনুল ইসলাম খান এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব গোলাম মো. হাসিবুল আলম নিজ নিজ মন্ত্রীকে বই বিতরণে সহযোগিতা করেন। গণভবন প্রান্তে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন। সেখানে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামসহ ঊর্ধ্বতম কর্মকর্তাবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আমি মনে করি, বিভিন্ন ডিজিটাল পদ্ধতিতে শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনলাইনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম (জুম, ম্যাসেঞ্জার, ফেসবুক গ্রুপ, ইউটিউব) ব্যবহারের মাধ্যমে ক্লাস রেকর্ডিং করে কিশোর বাতায়ন, শিক্ষক বাতায়ন এবং ইউটিউবে ভিডিও আপলোড করে শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনা করছে। কাজেই ঘরে বসে আমাদের শিক্ষার্থীরা শিক্ষা গ্রহণ করতে পারছে। সরকার যখনই স্কুলগুলো খোলার বিষয়ে চিন্তা শুরু করলো তখনই করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ধাক্কা আসার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কাজেই আমরা আমাদের ছেলে-মেয়েদের কথা চিন্তা করেই স্কুল না খুলে এখন ১৫ই জানুয়ারি পর্যন্ত সময় দিয়েছি। এরমধ্যে যদি অবস্থা ভালো হয়, তাহলে স্কুল খোলা হবে, না হলে আমরা খুলবো না। করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও যথাসময়ে প্রায় সাড়ে ৪ কোটি শিক্ষার্থীর হাতে বিনামূল্যে নতুন বই তুলে দিচ্ছে সরকার। ২০২১ শিক্ষাবর্ষে সর্বমোট ৩৪ কোটি ৩৬ লাখ ৬২ হাজার ৪১২ খানা পাঠ্যপুস্তক বিনামূল্যে বিতরণ করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে শিক্ষার্থীদের মানসিক শিক্ষা বিকাশের ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, আমি আমাদের সকল শিক্ষার্থীদের অনুরোধ করবো-যদিও ঘরে বসে সময় কাটানোটা অত্যন্ত কষ্টকর তারপরেও শুধু পাঠ্যপুস্তক নয় অন্য আরো অনেক বই আছে যেগুলো পড়া যায় তা পড়ার জন্য আমি অনুরোধ করবো। সেইসঙ্গে একটু খেলাধুলাও করতে হবে। তিনি বলেন, যারা অভিভাবক বা বাবা-মা রয়েছেন তাদেরকে আমি অনুরোধ করবো আপনারা বাচ্চাদের সময় দেবেন। কারণ, করোনাভাইরাস যেমন আমাদের কষ্ট দিচ্ছে তারপরেও হাজার কাজের চাপের মধ্যেও ছেলেমেয়েদের নিয়ে সময় কাটানোর সুযোগ পাচ্ছেন, এই সুযোগটা আপনারা সদ্ব্যবহার করবেন। শেখ হাসিনা বলেন, ছেলেমেয়েদের নিয়ে একটু সময় কাটাবেন এবং তাদের শরীর চর্চাটা যেন হয়, সেজন্য একটু খেলাধুলা যাতে করতে পারে সেই ব্যবস্থাটা নিতে হবে। এতে করে ছেলেমেয়েদের মানসিক এবং শারীরিক স্বাস্থ্যটা ভালো থাকবে। সেদিকে বিশেষভাবে দৃষ্টি দেয়ার জন্য আমি অনুরোধ জানাচ্ছি। তিনি বলেন, করোনার কারণে দীর্ঘ সময় ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীগণের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা বা অভিঘাত মোকাবিলায় করণীয় বিষয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধান এবং একজন ফোকাল পয়েন্ট শিক্ষককে প্রশিক্ষণ প্রদানের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এ লক্ষ্যে ইতিমধ্যেই দেশের শীর্ষস্থানীয় সাইকোলজিস্টগণের সহায়তায় একটি কাউন্সেলিং ম্যানুয়াল প্রণীত হয়েছে। করোনাকালীন বিশেষ ব্যবস্থায় ১ হাজার ৬৪৬টি স্কুল-কলেজকে এমপিওভুক্তকরণের মাধ্যমে ২ হাজার ৫৫ জন শিক্ষক-কর্মচারীর বেতন-ভাতা ও অবসর সুবিধা নিশ্চিত করাসহ এই সময়ে সরকার প্রদত্ত অন্যান্য সুবিধাদির কথাও উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, সাধারণ শিক্ষা ধারার ৬৪০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বৃত্তিমূলক কোর্স চালু করে ইতিমধ্যে ৬৭৬ জন ট্রেড ইন্সট্রাক্টর নিয়োগ দেয়া হয়েছে এবং বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ৫ হাজার ৩৫১ জন শিক্ষক-কর্মচারীকে ৫১৭ কোটি ৩৩ লাখ ১২ হাজার টাকা অবসর সুবিধা প্রদান করা হয়েছে। পাশাপাশি, ৫ হাজার ৪৪৬ জন শিক্ষক-কর্মচারীর কল্যাণ ভাতার আবেদন নিষ্পত্তি করে ২১৮ কোটি ৬৩ লাখ ৮ হাজার ১৩৫ টাকা প্রদান করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, সকল ধরনের বৃত্তির অর্থ ‘জিটুপি’ পদ্ধতিতে ১ লাখ ৫৯ হাজার ৫২৬ জন বৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীকে অনলাইনে ‘ইএফটি’ এর মাধ্যমে ‘ব্যাংক অ্যাকাউন্টে’ প্রেরণ করা হয়েছে। তিনি ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত প্রায় ৪০ লাখ দরিদ্র শিক্ষার্থীদের মাঝে উপবৃত্তির টাকা মোবাইল ব্যাংকিং-এর মাধ্যমে অনলাইনে করোনাকালীন প্রেরণ করার তথ্য উল্লেখ করেন। শেখ হাসিনা করোনার স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, ‘সবাইকে আমি অনুরোধ করবো যেখানে জনসমাগম বেশি বা লোকজন বেশি সেখানে মুখে মাস্ক পরিধান করতে হবে এবং কিছুক্ষণ পর পর হাত সাবান বা স্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। কারণ, এটাই করোনার ক্ষেত্রে আমাদের সুরক্ষা দেয়। তিনি এই শীতকালে লেবু ও কমলালেবুসহ বিভিন্ন ভিটামিন যুক্ত খাবার খাওয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, ‘সকলে যেন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলেন, সেজন্য আমি আমাদের অভিভাবক শিক্ষক, শিক্ষার্থীসহ সকলের প্রতি অনুরোধ জানাবো। আর সবসময় ঘরে বসে না থেকে যেকোনো সময়ে একটু রোদে বা খোলা বাতাসে থাকতে হবে। এটি আমাদের করোনাভাইরাস থেকে মুক্তি দিতে পারে। তিনি করোনাকালেও যথাযথ সময়ে বই মুদ্রণ করে স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দিতে পারায় শিক্ষা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সকলকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানান। শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের আজকের শিশুরাই আগামী দিনের কর্ণধার। এদের মধ্য থেকেই আগামীতে কেউ ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী, মন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রী হবে। কাজেই, সেইভাবে তাদের শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই করোনাভাইরাসের মধ্যেও আমরা সকলের হাতে নতুন বই তুলে দিতে পারলাম। কাজেই, ছোট্ট সোনামনিরা, তোমরা মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করবে। মানুষের মতো মানুষ হবে এবং দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। তিনি এ সময় দেশবাসীকে ইংরেজি নববর্ষের আগাম শুভেচ্ছাও জানান।