লালমনিরহাটের পাটগ্রাম সরকারি জসিমুদ্দিন কাজী আব্দুল গণি কলেজের সহকারী অধ্যাপক মুসলিম সরদার মিশু তার স্ত্রী কুলসুমা বেগমের ওপর বর্বরোচিত নির্যাতন চালিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। মিশু ও তার পরিবারের কয়েকজন মিলে দফায় দফায় নির্যাতন চালিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন চাঁদপুর জেলা জজ আদালতের আইনজীবী কুলসুমার স্বজনরা। শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত ও কামড়ের চিহ্ন নিয়ে তিনি এখন হাসপাতালে ভর্তি। এদিকে অভিযোগের ভিত্তিতে শনিবার দিনগত রাত দেড়টার দিকে মুসলিম সরদার মিশুকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করা হয়েছে।
কুলসুমার (৪০) স্বজনরা জানান, শুক্রবার (১৬ জুন) সন্ধ্যায় প্রথমে কুলসুমার ওপর নির্যাতন চালানো হয় চাঁদপুর শহরের বিটি রোড়ের ভাড়া বাসায়। পরে অচেতন অবস্থায় সেখান থেকে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে তার ওপর আরও কয়েকজন মিলে দ্বিতীয় দফায় নির্যাতন চালায়। সেখান থেকে উদ্ধার করা হয় কুলসুমাকে। বর্তমানে তিনি চাঁদপুর সদর হাসপাতালের তৃতীয় তলার ৬ নম্বর কেবিনে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
কুলসুমার স্বজনরা আরও জানান, ৮ বছর আগে কুলসুমার বিয়ে হয় মতলব দক্ষিণ উপজেলার নলুয়া গ্রামের মুসলিম সরদার মিশুর সঙ্গে। বিয়ের পর থেকেই বিভিন্ন সময় যৌতুক হিসেবে নগদ টাকা দেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি শুরু করে মিশু। পরে তাকে ৫ লাখ টাকা দেওয়া হয়। কিন্তু এরপরও সে থামেনি। পরবর্তীতে আবারও টাকা চাইলে দিতে না পারায় শুরু হয় নির্যাতন।
ছয় মাস আগেও একবার শারীরিক নির্যাতন চালানো হয় এক সন্তানের মা কুলসুমার ওপর। ওই ঘটনার পর এক বছরের কন্যা সন্তানকে নিয়ে আলাদা থাকতে শুরু করেন কুলসুমা। এর মধ্যেই প্রায় তিন মাস আগে চাঁদপুর সরকারি কলেজে কর্তব্যরত অবস্থায় তিন ছাত্রীকে নেশাযুক্ত দ্রব্য খাইয়ে শ্লিলতাহানির অভিযোগ ওঠে মিশুর বিরুদ্ধে। নির্যাতিত ছাত্রীদের অভিযোগের পর তাকে শাস্তিমূলক বদলি হিসেবে লালমনিরহাটের পাটগ্রাম সরকারি কলেজে পাঠানো হয়। কিন্তু সেখানে যোগদান করলেও নিয়মিত থাকতেন না তিনি। সর্বশেষ গত এক-দেড়মাস ধরে মিশু ওই কলেজেও অনুপস্থিত ছিলেন বলে জানান তারা।
চিকিৎসাধীন অ্যাড. কুলসুমা বলেন, “লালমনিরহাট থেকে বদলি হয়ে আবার চাঁদপুর আসার জন্য আমার কাছে আবারও ৫ লাখ টাকা দাবি করে মিশু। কিন্তু আমি তা দিতে অপারগতা প্রকাশ করি। হঠাৎ শুক্রবার বিকালে আমাকে ফোন করে বলে, ‘আমি লালমনিরহাটে যাচ্ছি। যাওয়ার আগে আমার মেয়েকে একটু দেখতে চাই’। তখন আমি তাকে বাসায় আসতে বলি। পরে সন্ধ্যার দিকে ভাই আব্দুল হকসহ মিশু আমার বাসায় আসে। এ সময় সে ঘরের ভেতর ঢুকেই আমাকে মারধর শুরু করে। একপর্যায়ে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেরি।’
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, অচেতন অবস্থায় কুলসুমাকে সিএনজিতে উঠায় মিশু এবং তার ভাই। সেখান থেকে নিয়ে যাওয়া হয় মতলবের বারঠালিয়া গ্রামের বাড়িতে।
নির্যাতিত কুলসুমা ও তার নিকটাত্মীয় চাঁদপুর সদর উপজেলা যুবলীগের আহ্বায়ক হুমায়ুন কবির সুমন বলেন, ‘মিশু তার বাড়িতে নিয়ে তার ভাতিজা ও পরিবারের আরও কয়েকজন মিলে প্রায় এক ঘন্টার মতো মারধর করে কুলসুমাকে। রুটি বানানোর বেলন দিয়ে আঘাতের পর আঘাত করে। পরনের বেল্ট দিয়েও বেদম আঘাত করে। সেই সঙ্গে তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে রয়েছে কামড়ের চিহ্নও। নির্যাতনের পর সেখানেও তিনি অচেতন হয়ে পড়ে থাকেন। পরবর্তীতে বিটি রোড এলাকার লোকজনের কাছে খবর পেয়ে কুলসুমার ভাই আরিফসহ কয়েকজন গিয়ে তাকে উদ্ধার করে চাঁদপুর সদর হাসপাতালে ভর্তি করায়।’
এদিকে শনিবার দিনগত রাত রাত ১টার দিকে চাঁদপুর শহরের তালতলা এলাকা থেকে মিশুকে আটক করে চাঁদপুর সদর হাসপাতালে নেন কুলসুমার স্বজনরা। সেখানে তাকে পুলিশে সোপর্দ করা হয়।
কুলসুমার বড় ভাই হানিফ খন্দকার বলেন, ‘কোনও মানুষ কোনও মানুষকে এভাবে নির্যাতন করতে পারে না দেখলে চিন্তাই করা যায় না। আমরা এর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।’ তিনি জানান, মামলা করার প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে।
উল্লেখ্য প্রায় ৪ মাস আগে চাঁদপুর সরকারি কলেজের রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক মুসলিম সরদার মিশু মাদকাসক্ত অবস্থায় তার বিভাগের তিন ছাত্রীকে বাসায় নিয়ে নেশাজাতীয় দ্রব্য খাইয়ে শ্লিলতাহানি ও ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করেন বলে অভিযোগ ওঠে। পরে গত ১১ ফেব্রুয়ারি ওই ছাত্রীরা কলেজ অধ্যক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগ দিলে তদন্তের পর তাকে বদলি করা হয় লালমনিরহাটের পাটগ্রাম কলেজে।
এ বিষয়ে মিশুর পরিবারের কেউ কথা বলেননি। মিশুর সাবেক সহকর্মী চাঁদপুর সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ অশিত বরন বলেন, ‘এটা তার পারিবারিক বিষয়। তাই তাদের ইন্টারনাল বিষয়ে কখনও জানতাম না, জানতে চেষ্টাও করিনি। আমি আজ সকালে বিষয়টি শুনেছি।’
চাঁদপুর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওয়ালি উল্যাহ জানান, ‘পাবলিক আটক করে মিশুকে আমাদের কাছে সোপর্দ করে। বর্তমানে সে আমাদের হেফাজতেই রয়েছে। এ বিষয়ে আমাদের কাছে এখনও কোনও অভিযোগ দেওয়া হয়নি। অভিযোগ পেলে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’