চ্যানেল আইয়ের জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ‘কাফেলা’ ও ‘শান্তির পথে’র উপস্থাপক মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকীকে (৫৫) গলা কেটে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। বুধবার রাতে পুলিশ তার পূর্ব রাজাবাজারের বাসা থেকে লাশ উদ্ধার করে। ঘটনার পরপর তার ভক্ত ও অনুসারীরা তাৎক্ষণিক ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামে বিক্ষোভ মিছিল করে। এসব বিক্ষোভ মিছিলে হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করা হয়। ঘটনাস্থলে উপস্থিত শেরেবাংলা নগর থানার এসআই আহাদ আলী জানান, রাতে ৭ থেকে ৮ যুবক ডাকাতির উদ্দেশ্যে তার বাসায় যায়। এসময় অস্ত্রের মুখে বাসার লোকজনকে জিম্মি করলে মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকী এগিয়ে এসে বাধা দেন। এ সময় দুর্বৃত্তরা তাকে ছুরিকাঘাত ও গলা কেটে হত্যা করে। ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। ১৭৪ পূর্ব রাজাবাজার মুন্সীবাড়ির একটি চারতলা ভবনের দোতলায় পরিবার নিয়ে থাকতেন মাওলানা ফারুকী। তার ‘ফারুকী ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস প্রাইভেট লিমিটেড’ নামে একটি হজ এজেন্সি আছে। পারিবারিক সূত্র জানায়, গত রাত সাড়ে ৮টার দিকে হজে যাওয়ার কথা বলে দুজন তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসে। এর ১৫-২০ মিনিট পর আরও চারজন ভক্ত পরিচয় দিয়ে বাসায় আসে। কিছুক্ষণ পর এরা অস্ত্রের মুখে স্ত্রী-সন্তানদের হাত-পা বেঁধে একটি রুমে আটকে রাখে। মাওলানা ফারুকী এগিয়ে এলে তাকে ডাইনিং রুমে নিয়ে যায়। তারা মাওলানা ফারুকীর কাছে এক লাখ টাকা দাবি করে। এরপরই দুর্বৃত্তরা তাকে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করে। এক পর্যায়ে তাকে হত্যা করে বীরদর্পে হেঁটে বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। পারিবারিক সূত্র জানায়, তার কোনো শত্রু ছিল না। এদিকে, রাত সোয়া ১০টার দিকে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ঘটনাস্থলে যান। এসময় তার সঙ্গে র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান, শেরেবাংলা নগর থানার ওসি আবদুল মমিনসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে মন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, ঘটনাটি অনাকাক্সিক্ষত ও অনভিপ্রেত। এর রহস্য উদঘাটন করা হবে। কে বা কারা এটা ঘটিয়েছে তা খুঁজে বের করা হবে। এরকম হত্যাকান্ড নিরাপত্তার জন্য হুমকি কিনা- সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অবশ্যই হুমকি। এসব হত্যাকান্ডে মোটিভ থাকে। এখানে হত্যাকান্ডের পেছনে কী মোটিভ ছিল তা তদন্তের ফলাফলে জানা যাবে। এদিকে, ফারুকী খুনের খবর ছড়িয়ে পড়লে তার বাসার সামনে কয়েকশ’ অনুসারী ও ভক্ত জড়ো হন। পরে তারা খুনের বিচার চেয়ে বিভিন্ন স্লোগান দেন। এরপর তারা বাসার কাছেই বিক্ষোভ মিছিল করে হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করে। ফার্মগেটেও ভক্তরা বিক্ষোভ করায় ভয়াবহ যানজটের সৃষ্টি হয়। তেজগাঁও জোনের ডিসি বিপ্লব কুমার সরকার সাংবাদিকদের জানান, কে বা কারা মাওলানা নুরুল ইসলামকে হত্যা করেছে এ বিষয়ে এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না। এদিকে রাত ১১টা ২০ মিনিটে সিআইডির ৬ সদস্যের একটি দল ঘটনাস্থলে যায় এবং বাসার ভেতরে প্রবেশ করে। তারা বাসার লোকজনের কাছে ঘটনা সম্পর্কে খোঁজ নেয়। এদিকে র্যাব বলছে, এটা প্রতিপক্ষের পরিকল্পিত খুন হতে পারে। তবে মাওলানা ফারুকীর বড় ছেলে রাজ বলেছেন, বাধা দেয়ায় ডাকাতদের হাতে খুন হয়েছেন তার বাবা। তবে বাসার কী কী জিনিস খোয়া গেছে তা তিনি বলতে পারেননি। আরও জানা গেছে, মাওলানা ফারুকী হাইকোর্ট মসজিদের খতিব, ‘ইসলামী মিডিয়া জনকল্যাণ’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ছিলেন। পূর্ব রাজাবাজার জামে মসজিদের সেক্রেটারিও ছিলেন তিনি। এছাড়া মেঘনা ট্রাভেলস নামে একটি প্রতিষ্ঠানের তিনি ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি)। মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকী নিহত হওয়ার ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করেছেন ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশনের প্রেসিডেন্ট কাজী রফিকুল আলম। তিনি এই হত্যাকা-ের নিন্দা করেন। এদিকে, রাত সোয়া ১২টায় মাওলানা ফারুকীর বাসার সামনে হত্যার প্রতিবাদে রোববার ঢাকা মহানগরীতে হরতালের ঘোষণা দেন ইসলামী ছাত্রসেনার সেক্রেটারি ইমরান হোসেন তুষার। এর আগে বৃহস্পতিবার সারা দেশে বিক্ষোভের ঘোষণা দেন আহলে সুন্নত ওয়াল জামাত বাংলাদেশের নির্বাহী মহাসচিব মাওলানা মোহাম্মদ মাসুদ হোসাইন আল কাদেরি। তিনি জানান, বৃহস্পতিবার দুপুর ২টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে ঢাকার কর্মসূচি পালন করা হবে।
বাংলাদেশ ইসলামিক ফ্রন্টের প্রেসিডিয়াম সদস্য, আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের আন্তর্জাতিক বিষয়ক মুখপাত্র ও হাইকোর্ট মাজারের খতিব ছিলেন ফারুকী। তিনি চ্যানেল আইয়ের ধর্মবিষয়ক অনুষ্ঠান ‘কাফেলা’র উপস্থাপক ছিলেন।
মোহাম্মদপুর কাদেরিয়া তৈয়বা মাদরাসার প্রভাষক সৈয়দ মো. মঈন উদ্দীন জানান, হযরত মোহাম্মদ (স.) মিলাদের ওপর অসংখ্য বই লিখেছেন ফারুকী। কোরআন-হাদিসে যে নির্দশনা রয়েছে তা তিনি প্রচার করতেন।
তিনি দাবি করতেন মিলাদ, মাজার জেয়ারত বেদাদ নয়। এই মাসয়ালা নিয়ে আলেমদের মধ্যে দ্বিমত রয়েছে। ইতোপূর্বে কেউ কেউ তার অবস্থানের বিরোধিতা করে তাকে মৃত্যুর হুমকিও দিয়েছিল। সম্ভবত এ কারণেই তাকে হত্যা করা হয়েছে বলে মনে করেন মঈন উদ্দীন। –
হত্যার প্রতিবাদে চট্টগ্রামে ভাংচুর-ব্যারিকেড : মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকীকে গলা কেটে হত্যার প্রতিবাদে বুধবার রাতে নগরীর মুরাদপুর এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল করেছেন মাদরাসার ছাত্র ও আলেমরা। বুধবার রাত পৌনে ১০টা থেকে জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া মাদরাসার ছাত্ররা এসে মুরাদপুরে জড়ো হয়। পরে তারা সড়কে ব্যারিকেড দিয়ে বিক্ষোভ করে। ইসলামী ফ্রন্ট ও ইসলামী ছাত্রসেনার কর্মীরাও মিছিলে যোগ দেন। এক পর্যায়ে দোকানপাট ভাংচুর শুরু হলে বন্ধ হয়ে যায় গাড়ি চলাচল। সড়কের উভয় পাশে আটকে যায় শত শত যানবাহন। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ফাঁকা গুলিবর্ষণ করেছে।
নারায়ণগঞ্জে বিক্ষোভ : নারায়ণগঞ্জ সংবাদদাতা জানান, মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকীকে হত্যার প্রতিবাদে বুধবার রাতেই নারায়ণগঞ্জ শহরে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছেন মুসুল্লিরা। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত নারায়ণগঞ্জ জেলা শাখার উদ্যোগে বিক্ষোভ মিছিলে অসংখ্য মুসুল্লি অংশ নেন। শহরের ডিআইটি মিন্নত আলী মসজিদের সামনে থেকে বিক্ষোভ মিছিলটি বের হয়ে চাষাঢ়া বিজয়স্তম্ভের সামনে প্রতিবাদ সমাবেশ করে। পরে বিক্ষোভ মিছিলটি ম-লপাড়া ঘুরে ২নং রেলগেট এলাকায় বিক্ষোভ সমাবেশ করে। বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ থেকে অবিলম্বে খুনিদের গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করা হয়। অন্যথায় বৃহৎ আন্দোলনের হুশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়। আজ সকাল ১০টায় মিন্নত আলী মসজিদের সামনে থেকে আবারও বিক্ষোভ মিছিল বের হবে। সমাবেশে বক্তব্য রাখেন মাওলানা মহিউদ্দিন হামিদী, মাওলানা সিরাজুল ইসলাম মনির, মাওলানা আবু নাসের মুসা, মাওলানা জামালউদ্দিন নূরী প্রমুখ।