ময়মনসিংহ প্রতিনিধি: দুই বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে নয়, একাই বাবা-মাকে হত্যা করেছে ঐশী রহমান। আগের সব অগোছালো, বিভ্রান্তিকর তথ্য বাদ দিয়ে নিজে বাবা-মা’র হত্যার দায় স্বীকার করে গতকাল শনিবার আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে ঐশী। গত শনিবার পল্টন থানায় আত্মসমর্পণের পর থেকে প্রথম তিন দিন শক্ত আর কঠিন মনোভাব নিয়ে নিজের বক্তব্যে ঐশী ছিল অবিচল। তার চোখ দিয়ে এক ফোঁটা পানি পর্যন্ত বের হয়নি। আর শেষ দুই দিন অঝোরে কেঁদেছে ঐশী। বুঝেছে নিজের অপরাধ আর এতিম হওয়ার বেদনা।
ঢাকা মেট্টোপলিটন পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম গতকাল শনিবার সাংবাদিকদের কাছে হত্যাকাণ্ডের পুরো বিষয়টি পরিষ্কার করেন। ঐশী হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে যে দুই বন্ধুর কথা বলছিল, শেষ পর্যন্ত সেখান থেকে সরে এসেছে। আসলে দুই বন্ধু নয়, শুধুমাত্র আসাদুজ্জামান জনিই জানত সবকিছু। তবে ঘটনাস্থলে তার উপস্থিতি ছিল না। মনিরুল ইসলাম বলেন, জনির বিরুদ্ধে এই হত্যাকাণ্ডে প্ররোচনা দেয়ার তথ্য উপাত্ত মিলেছে। ঐশীর সঙ্গে সুমিও আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। ঐশীকে কারাগারে পাঠিয়েছে আদালত। আর সুমিকে পাঠিয়েছে সংশোধনাগারে। ঐশীর বন্ধু মিজানুর রহমান রনিকে আরো ৫ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ।
সর্বশেষ ঐশী স্বীকার করেছে, আসলে ১০টি নয়, ৬০টি ঘুমের ওষুধ (৬ পাতা) গুঁড়ো করে কফি তৈরির সময় আগেই মিশিয়ে দেয়। দুই কাপ কফি তৈরির পর মা ও বাবাকে খাওয়ায়। আর এই ৬০টি ওষুধ সে কিনেছিল শান্তিনগরের দু’টি ওষুধের দোকান থেকে। দুই কোম্পানির দুই ধরনের ঘুমের ওষুধ সে কেনে। ওই দুই ওষুধের দোকানিকেও আটক করেছে পুলিশ। তবে তাদের নাম ও পরিচয় এখনই বলতে চাচ্ছে না গোয়েন্দা পুলিশ। ঐশী স্বীকার করেছে, সে নিজেই অনেক দিন আগে থেকে ঘুমের ওষুধ নিয়মিত খেত। ফলে কোন দোকানে প্রেসক্রিপশন ছাড়া ওষুধ পাওয়া যায় তা তার জানা ছিল। একবার তো সে অনেকগুলো ঘুমের ওষুধ খেয়ে অচেতন হয়ে পড়েছিল। ফলে বাবা-মা তাকে ওই এলাকার একটি হাসপাতালে নিয়ে স্টোকাম ওয়াশ করার পর সে সুস্থ হয়।
কেন বাবা-মাকে খুন করল ঐশী? তারও জবাব দিয়েছে সে। বাবার একাউন্টে অনেক টাকা থাকলেও তিনি ছিলেন কৃপণ। আর মা ছিলো অসামাজিক। বর্তমান যুগের সঙ্গে তার মা একেবারেই বেমানান। অনেক বান্ধবীর মা ডিজে পার্টির সময় মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে আসেন। আবার নাচ-গান শেষে মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে যান। কিন্তু ঐশীর মা কখনই এমন ছিলেন না। সঙ্গে তো যেতেনই না, বরং ঐশী গেলে তাকে গালিগালাচ করতেন। এরপরও বাবার কাছে এসব নিয়ে নালিশ করতেন। মাস দু’য়েক ঘরে বন্দি রাখার পর ৩১ জুলাই যখন তার মোবাইল ফোনটিও কেড়ে নেয় মা, তখনই বেপরোয়া হয়ে পড়ে ঐশী। প্রথমে নিজে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিয়ে লিখে ফেলে ‘সুইসাইডাল নোট’ এরপর বন্ধুদের সঙ্গে আত্মহত্যার সিদ্ধান্তের বিষয়টি শেয়ার করে। কিন্তু বন্ধুরা বিশেষ করে জনি তাকে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার অনুরোধ করে বলেন, ‘তুই মরবি কেন, তোর বাবা-মারই বেঁচে থাকার অধিকার নেই। প্রয়োজন হলে তুই তোর বাবা-মাকেই দুনিয়া থেকে সরিয়ে দে।’
ঐশী নিয়মিত মাদক সেবন করলেও পুলিশ অবশ্য তার কোন ডাক্তারী পরীক্ষা করায়নি। মনিরুল ইসলাম বলেন, কখনও প্রয়োজন মনে হয়নি বলেই তার ডাক্তারী পরীক্ষা করানো হয়নি। কারণ বাবা-মায়ের হত্যার ৬০ ঘন্টা পর সে থানায় এসে ধরা দেয়। তখন তার আচরণে মাদকসেবী বলে মনে হয়নি। হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিয়ে ঐশী স্বীকারোক্তিতে বলেছে, ছুরি (খঞ্জর) সে কেনেনি, বাসাতেই ছিল। ঘটনার দিন সকালে বাবার সঙ্গে প্রাতঃভ্রমণে যায় ঐশী। একসঙ্গে বাসায় ফেরার পর সারাদিন বাসাতেই ছিল ঐশী। হাসি-খুশি ভাবে সবার সঙ্গে সময় কাটায়। দুপুরে মায়ের সঙ্গেই খাওয়া দাওয়া করে। এরপর সবাই বিশ্রাম নেয়ার পর সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে ঐশী কফি তৈরি করে। এই কফিতে কিছু একটা মেশাতে দেখে সুমি। খুব আদর করে মাকে ঐশী কফি খাওয়ায়। এরপরই তার মা ড্রয়িং রুমে মাদুরের উপর শুয়ে পড়ে। অস্বস্তি লাগছে বললে ঐশী তাকে লেবুর শরবত খাওয়ায়। সেভাবেই ঘুমিয়ে পড়েন ঐশীর মা। তখন ঐশী, ঐহী ও সুমি ড্রয়িং রুমে টিভি দেখছিল।
ঐশী বলেছে, বাবাকে তিন বার ফোন করে ডেকে আনে। রাত ১১টার দিকে মাহফুজুর রহমান বাসায় ফেরেন। দেখেন ঐশীর মা ড্রয়িং রুমেই ঘুমাচ্ছেন। তিনি ডেকে তোলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। এ সময় ঐশী বাবাকে জানায়, সন্ধ্যা থেকে মা খারাপ লাগছে বলছিল- ঘুমের ওষুধ খেয়ে হয়তো ঘুমাতে পারে। ফলে ঐশী ও তার বাবা ধরে তাকে বেডরুমে নিয়ে শুয়ে দেন। খাওয়া দাওয়া শেষে মাহফুজ পৌনে ১২টার দিকে ঘুমাতে চাইলে ঐশী তাকে কফি খাওয়ার অনুরোধ করেন। না চাইলেও মেয়ের আবদারে তিনি কফি খান এবং গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে পড়েন। তখনও ঐশী, ঐহী ও সুমি ড্রয়িং রুমে টিভি দেখছিল। এক পর্যায়ে ঐহী মায়ের পাশে শুয়ে পড়ে। আর সুমি ড্রয়িং রুমের নিচে ঘুমিয়ে পড়ে। রাত ২টার দিকে ওয়ারড্রব থেকে খঞ্জর বের করে প্রথমে মায়ের চোখ ও মুখ বরাবর কোপ দেয়। দুই তিন কোপ দেয়ার পরও দেখে তার মা নড়াচড়া করছে তখন একাধারে কোপাতে থাকে। এক পর্যায়ে গলার শ্বাসনালীতে কোপ দিলে দেখে তার মা নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। ফলে তার ধারণা হয়, শ্বাসনালীতে কোপ দিলেই মৃত্যু দ্রুত হয়। এর মধ্যে তার ভাই জেগে গেলে সে বাথরুমে নিয়ে আটকে রাখে। সেখানে তার ভাই কিছুক্ষণ চিত্কার চেচামেচি করলেও সেই শব্দ বাইরে বের হচ্ছিল না।
এরপর বাবার রুমে গিয়ে মাত্র তিনটি কোপ দিয়েই বাবার মৃত্যু নিশ্চিত করে। তখন ঠান্ডা মাথায় বাথরুমে গিয়ে নিজের কাপড় পরিবর্তন করে, চাকু ধুয়ে ফেলে। বালতিতে পানি এনে ঘরের মধ্যের রক্ত মুছে পরিষ্কার করে। তারপর সে সুমিকে ডেকে লাশ বাথরুমে নিয়ে রাখে। ভাইকে বাথরুম থেকে ঘন্টাখানেক পর বের করে আনে। তখন তার ভাই জানতে চাই মা কোথায়? জবাবে ঐশী বলে, বাবা মাকে মারধরের পর হাসপাতালে নিয়ে গেছে। সারারাত আর ঐশী ঘুমোয়নি। তবে ঐহী ও সুমি ড্রয়িং রুমে ঘুমিয়ে পড়ে। ভোর ৭টায় ঐহী ও সুমিকে ডেকে তুলে বাসা থেকে বের হয়। এর আগেই জনির সঙ্গে তার কথা ছিল, একটি বাসা ঠিক করে দেবে। সেই বাসাতেই ভাইকে নিয়ে থাকবে। সুবিধামতো সময়ে বিদেশে চলে যাবে। বাসা থেকে ঐশী ৫ হাজার টাকা, ১৩১ গ্রাম স্বর্ণালংকার, কিছু বিদেশি টাকা ও দুই ভাই বোনের কাপড়চোপড় নিয়ে বের হয়। কিন্তু ঘটনা জানার পর জনি আর তার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। ফলে সুমিকে সিএনজি চালকের বাসায় রেখে ভাইকে নিয়ে সে বান্ধবী তৃষার বাসায় যায়।
ঐশীর সঠিক বয়স পাওয়া না গেলেও গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, খুলনার মিশু ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ তাদের জানিয়েছে, ১৯৯৪ সালের ১৭ আগস্ট তাদের ক্লিনিকেই ঐশীর জন্ম। রেজিষ্টারে তার প্রমাণ রয়েছে। তারপরও ঢাকা মেডিক্যালে পরীক্ষার রিপোর্ট এখনো আসেনি। সেটা পাওয়া গেলেই সঠিক বয়স মিলবে বলে মনে করেন গোয়েন্দারা। ঐশী গত রোজার ঈদের সময়ও বাবা-মায়ের উপর রাগ করে ১৫ দিন জনির এক বান্ধবীর বাসায় ছিল। তার স্বাভাবিক চলাফেরায় বাবা-মা বাধা দেবে না- এমন আশ্বাস দিলেই সে বাসায় ফিরে আসে। কিন্তু তখন থেকেই তাকে ঘরে বন্দি করে রাখে। এক পর্যায়ে মোবাইল ফোনটিও কেড়ে নেয়। আর বাবা-মায়ের এসব আচরণ ঐশীকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। যার শেষ পরিণতি বাবা-মাকে হত্যা করে ঐশীর ঠাঁই মিলেছে কারাগারের চার দেয়ালের মধ্যে। বিচারে নির্ধারিত হবে ঐশীর সাজা? কিন্তু আমাদের সমাজের কাছে ঐশী একজন বখে যাওয়া মেয়ে, বাবা-মায়ের খুনি?
গাজীপুর প্রতিনিধি ও কাপাসিয়া সংবাদদাতা জানান, হত্যা মামলার আসামি ঐশী রহমানকে গাজীপুরের কিশোরী উন্নয়ন কেন্দ্রে নেয়া হয়েছে। শনিবার রাত ৯ টার দিকে ঐশী ও তাদের কাজের মেয়ে সুমীকে এ কেন্দ্রে আনা হয়।
শনিবার খাস কামরায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়ার পর মহানগর হাকিম আনোয়ার সাদত তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। কিন্তু বয়স সংক্রান্ত জটিলতার কারণে তাকে আপাতত কারাগারের পরিবর্তে উক্ত কেন্দ্রে রাখা হবে।
গাজীপুরের কাশিমপুর কিশোরী উন্নয়ন কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক শংকর চরণ সাহা জানান, রাত ৯টার দিকে ঐশীকে এ কেন্দ্রে পুলিশ প্রহরায় আনা হয়েছে। তাকে এখানে রাখার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
শিরোনাম:
শনিবার , ১৫ মার্চ, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ , ১ চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।