ভ্রাম্যমান প্রতিনিধি-
ছোট বোনের অকাল মৃত্যুতে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন আকলিমা ও লিজা। অন্যদিকে মা-বাবা শোকে বাকরুদ্ধ। বাড়িতে কেউ এলে শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন তাঁরা। চাঁদপুর সদরের কমলাপুর গ্রামের মজুমদার বাড়িতে গতকাল বুধবার গিয়ে দেখা গেল এমন দৃশ্য।
এ বাড়ির বাচ্চু মজুমদার গ্রাম্য চিকিৎসক। তাঁর মেয়ে সাথী আক্তার। চার বোন এক ভাইয়ের মধ্যে সে সবার ছোট। সে ছিল সবার আদরের। চান্দ্রা ইয়াকুব আলী মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণীতে পড়ত। গত সোমবার বিদ্যালয় থেকে বাড়ি ফেরার পথে বখাটের মোটরসাইকেলের নিচে চাপা পড়ে মারা যায়।
ওই বখাটে যুবকের নাম জহির খান। তার বাবা নাসির খান চাঁদপুর সদরের ১২ নম্বর চান্দ্রা ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের কর্মী। দক্ষিণ মদনা গ্রামের তাদের বাড়ি। চান্দ্রাবাজারে একটি ফার্নিচারের দোকান আছে তাদের। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি শেষ না করলেও এলাকাবাসী জানায়, জহির ছাত্রলীগের কর্মী হিসেবে এলাকায় পরিচিত। বখাটে হিসেবে তার কুখ্যাতি আছে। ভাড়ায়চালিত মোটরসাইকেল নিয়ে মেয়েদের যৌন হয়রানি করলেও ভয়ে কেউ কিছু বলত না।
ঘটনার দিন সাথীকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফিরছিল রোজিনা বেগম নামের আরেক ছাত্রী। তাদের পেছনে ছিলেন বড় বোন লিজা। ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে তারা দুজন বলল, ‘স্কুল গেট থেকেই আমাদের পিছু নেয় জহির। আমরা চান্দ্রাবাজার পার হয়ে একটু সামনে এগোতেই সে দ্রুত গতিতে মোটরসাইকেল চালিয়ে সোজা উঠিয়ে দেয় সাথীর ওপর। আমাদের চিৎকারে আশপাশ থেকে লোকজন ও অন্য শিক্ষার্থীরা ছুটে আসে।’ তারা রক্তাক্ত সাথীকে একটি সিএনজি অটোরিকশায় তুলে দেয়। নিয়ে যাওয়া হয় চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালে। সেখানে একদিন চিকিৎসা দেওয়া হয়। অবস্থার অবনতি ঘটলে একটি অ্যাম্বুল্যান্সযোগে ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু নেওয়ার সময় পথেই মঙ্গলবার সন্ধ্যায় সাথী মারা যায়। পরে রাতে গ্রামের বাড়িতে লাশ নিয়ে আসা হয়।
লিজা অভিযোগ করে, ‘বাবা কয়েক দিন ধরে অসুস্থ। তার মধ্যে এমন দুর্ঘটনা।’ সে আরো বলে, ‘বখাটে জহিরের বাবা আওয়ামী লীগ নেতা। আমাদের নানা ভাবে চাপ দিচ্ছিল যেন এই মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে বাড়াবাড়ি না করি।’ এই বলেই লিজা কান্নায় ভেঙে পড়ে।
সাথীর সহপাঠী তানিয়া ও লাভলী বলে, ‘স্কুলে আসা-যাওয়ার পথে আমাদের প্রতিদিনই জহির নানাভাবে উত্ত্যক্ত করত। তার অত্যাচারে আমরা অতিষ্ঠ। উত্ত্যক্তের কথা অভিভাবক বা স্কুলে জানানোর কথা বললে জহির আমাদের অপহরণ করে নিয়ে যাবে বলে ভয় দেখাত।’ তারা আরো বলে, ‘এমন ঘটনা ঘটতে থাকলে আমাদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিতে হবে।’ তারা এ ঘটনায় দায়ী বখাটে যুবক জহির খানকে গ্রেপ্তার ও তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছে।
স্থানীয় বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন নান্নু পাটওয়ারী বলেন, বখাটে যুবক জহির ও তার বন্ধুরা স্কুলের সামনে মোটরসাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে মেয়েদের প্রায়ই উত্ত্যক্ত করত। মেয়েদের উত্ত্যক্ত শেষে বেপরোয়া গতিতে মোটরসাইকেল চালানোর সময় সে সাথী আক্তারকে ধাক্কা দেয়।
চান্দ্রা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান খান জাহান আলী কালু পাটওয়ারী জানান, এলাকার চিহ্নিত বখাটে জহির খান প্রায়ই স্কুলে আসা-যাওয়ার পথে মেয়েদের উত্ত্যক্ত করত।
চান্দ্রা ইয়াকুব আলী মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হুমায়ুন কবির বলেন, এই ঘটনার জন্য তাঁর স্কুলের সবাই শোকার্ত। দোষী জহিরের বিচার দাবি করেন তিনি।
বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সদস্য আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘ঘটনার জন্য আমি লজ্জিত। এই স্কুলে এক হাজার ৪০০ শিক্ষার্থীর মধ্যে ৬৫ ভাগই মেয়ে। বখাটেদের উপদ্রবে তারা অতিষ্ঠ।’
জহিরের বাড়িতে গিয়ে পাওয়া গেছে পান্না নামে নাসির খানের ছোট মেয়েকে। সে জানায়, বাড়িতে আর কেউ নেই। সাথী ও পান্না এক স্কুলে একই শ্রেণীতে পড়ে। শিশু পান্না ভাইয়ের এমন অপকর্মে নিজেও লজ্জিত।
চাঁদপুর সদর মডেল থানার ওসি (তদন্ত) মো. শাহ আলম বলেন, এ ব্যাপারে মামলা রুজুর পর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।