দেলোয়ার হোসাইন,
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এক প্রজ্ঞাপনে গত ৫ অক্টোবর হতে ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত এ ১১ দিন চাঁদপুর মেঘনা এলাকাসহ দেশের নদী অঞ্চল চৌদ্দটি জেলার নদ-নদীতে ইলিশ প্রজনন রক্ষায় ইলিশ আহরণ, ক্রয়-বিক্রয়, পরিবহণ এবং মজুদ নিষিদ্ধ করেছে। মৎস্য গবেষকদের মতে পূর্ণিমার আগে এবং পরের এগারো দিন প্রজনন সক্ষম ইলিশ মাছ দল বেঁধে সাগর থেকে ডিম ছাড়ার জন্যে মিঠা পানিতে আসতে থাকে। সাগর মোহনা ও নদ-নদীতে প্রজনন সক্ষম মা ইলিশ এ সময়ে নদীতে ডিম ছাড়ে। নিরাপদে যাতে মা ইলিশ নদ-নদীতে ডিম ছাড়তে পারে, কোনোভাবেই যাতে বাধাগ্রস্ত না হয়, সেজন্যে ইলিশ ধর এ সময়ের জন্যে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়। যাতে দেশের জাতীয় সম্পদ ও জাতীয় মাছ ইলিশ উৎপাদন ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায়।
কিন্তু এখন কোন কৌশলে রক্ষা করা যাচ্ছে না “মা ইলিশ” জাতীয় মৎস্য সম্পদ ইলিশ মাছের নিরাপদ প্রজনন তথা ডিম ছাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। জেলেদের সাথে কথা বলে জানা যায় ভরা মৌসুমে মাছ না পাওয়ায় প্রজনন মৌসুমে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে চাচ্ছেন জেলেরা তারা আরো জানান প্রজনন সময়ে মাছ দল বেেেধ আসায় একত্রে অনেক মাছ জালে আটকে গেলে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করে অনেক সময় নদীর মাঝখানে জালে আটকে যাওয়া মাছ সহ জাল কেটে নদীতে ফেলে দিয়ে আসতে হয়। দেশের অন্যান্য জেলার মতো রূপালী ইলিশের জন্য বিখ্যাত চাঁদপুরেও এখন জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষিত সরকারের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে চাঁদপুরের মেঘনা এবং পদ্মায় চলছে মা ইলিশ নিধনের উৎসব। মতলবের ষাটনল থেকে হাইমচরের চরভৈরবী পর্যন্ত মেঘনার প্রায় ৬০-৬৫ কি.মি. নদী এখন ইলিশ শিকারী জেলেদের দখলে। নদীর পাড়ে প্রকাশ্যে ক্রয়-বিক্রয় হচ্ছে নানা সাইজের ইলিশ। ব্যাগ ভরে মাছ কিনে নিচ্ছেন সাধারণ মানুষ। মা ইলিশ রক্ষায় স্থানীয় প্রশাসন সোচ্চার থাকলেও দল বেঁধে জেলে এবং জনগণ সবাই ইলিশ ধরা, ক্রয়-বিক্রয়ের পক্ষে থাকায় অভিযান সফল হতে পারছে না। ইলিশ আটক নিয়েও চলছে বাণিজ্য এবং মাছ ভাগাভাগি। জাল নৌকা জেলে আটক করে নৌ-পুলিশের বিরুদ্ধে রয়েছে চাঁদবাজির অভিযোগ। প্রকৃত মৎস্য ব্যবসায়ীগন আড়ৎ বন্ধ রাখলেও নদীর পাড়ের মৎস্য আড়ৎ হরদম চলছে ইলিশের কেনাবেচা। সবদিক পর্যালোচনায় প্রত্যক্ষদর্শীদের অভিমত, ইলিশ প্রজনন রক্ষা অভিযান তো নয়, এ যেনো ইলিশ নিধন, বিক্রি, সংগ্রহ এবং কম দামে ইলিশ খাওয়ার উৎসব। মা ইলিশ রক্ষা আইন যেমন জেলেরা মানছে না, তেমনি মানছেন না সচেতেন মানুষজনওা। প্রশাসনের অভিযানে কঠোরোতা দেখা গেলেও সেই কঠোরতা শুধুই পড়ছে ক্রেতাদের উপর। এতে কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে
শুক্রবার পুলিশ প্রশাসন ও ম্যাজিষ্টেডের উপস্থিতিতে দেখা যায়, অনেক ক্রেতার মাছ আটক করে ক্রেতাকে দাঁড় করে রাখা হচ্ছে, ক্রেতা বুঝে কাউকে আবার কান ধরে দাঁড়িয়ে রাখা হচ্ছে। চাঁদপুরে যে হারে ডিমওয়ালা ইলিশ মাছ আহরণ হচ্ছে, আগামী ভরা মওসুমে ইলিশ উৎপাদনে এ বছরের চেয়েও আরও খারাপ পরিস্থিতি হবে।
প্রত্যক্ষদর্শী ও ক্রেতাগন অনেকেরই অভিযোগ, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা পাবলিকের মাছ আটক করে নিয়ে যায়। কিন্তু যারা মাছ বিক্রি এবং আড়তদারি করছে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। বিপুল পরিমাণ ইলিশ পুলিশ, কোস্টাগার্ড আটক করলেও পরবর্তীতে তার সঠিক পরিমাণ প্রকাশ করাা হচ্ছে না। প্রতিদিনই ইলিশ আটকের ঘটনা ঘটছে। সেগুলো দুঃস্থদের মাঝে বিতরণ না করে যারাই আটক করছে তাদের আওতায় নিয়ে যাওয়ার পর সেই মাছ গায়েব হয়ে যাচ্ছে। এমন অভিযোগ মানুষের মুখে মুখে।
পবিত্র ঈদুল আযহার ১ দিন আগ থেকে মা ইলিশ রক্ষা অভিযান শুরু হয়। আর সেদিন থেকেই নদীতে মাছ ধরার জন্য জাল, নৌকা নিয়ে নেমে পড়ে শত শত জেলে। জাল ফেললেই বড় বড় ইলিশ এবং নদীর পাড়ে অধির আগ্রহে অপেক্ষা করা ক্রেতাদের উপচে পড়া ভীর বিষয়টি জেলেদের জন্য লোভনীয় ব্যাপার হয়ে উঠে। আর তাই কোনো জেলেই এখন আর ঘরে বসে নেই । সবাই নেমে পড়েছে মাছ ধরার জন্যে। স্রোতের বিপরীতে জাল ফেলা হচ্ছে। প্রতি নৌকায় ৩/৪ জন জেলে। দিন-রাত ২৪ ঘণ্টাই তারা মাছ ধরতে জাল ফেলছে। ফিশারি, নৌ-পুলিশ, কোস্টগার্ডের স্পীড বোট কিংবা ইঞ্জিন চালিত নৌকা নদীতে দেখলেই জেলেরা দূর থেকে তাদের অনুসরণ করে। অবস্থা বেগতিক দেখলে নৌকা কিনারে চাপিয়ে দেয় অথবা চরের পাশে নৌকা ভিড়িয়ে চরে উপর দিয়ে দৌড়ে পালাতে সক্ষম হয়। প্রশাসনের বোট চলে গেলে আবার পুরোদমে শুরু করে ইলিশ শিকার। মাছ ধরা পড়লে সেগুলো বিক্রির জন্যে নদীর পাড়, খালের মুখ ও আড়তে নিয়ে আসে।
ঈদ, পূজার ছুটিতে অনেকেই এখন গ্রামে বাড়িতে, একজন অপরজনকে মোবাইলে জানিয়ে দিচ্ছেন সস্তায় ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে, জেলার প্রায় প্রতিটি অঞ্চল থেকে মানুষ এমন লোভনীয় খবর শুনে গাড়ি ভাড়া করে কিংবা মটর সাইকেলে রওয়ানা হচ্ছেন কম মূল্যে স্বাদের তাজা ইলিশ কিনতে। মেঘনা নদীর পাড় এলাকায় রাত-দিন ২৪ ঘন্টা উপচে পড়া ক্রেতাদের ভিড়। হাতের কাছেই থলে কিনতে পাওয়া যাচ্ছে। প্রতিটি ইলিশ এক কেজি কিংবা তার চেয়ে কম-বেশি ওজনের এক হালি ইলিশ জেলে নৌকার পাশেই দাম হাঁকা হয় হাজার ১২শ’ টাকা আর বিক্রি হচ্ছে ৯শ থেকে ১ হাজার টাকায়। অন্য সময় যার মূল্য ছিল ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা। তাই যার পছন্দ হয় সে সাথে সাথে যে কয়টা মাছ সম্ভব কিনে ব্যাগে করে বাড়ি নিয়ে যায়। অনেকে আরও সস্তায় কেনার জন্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কিংবা রাতও কাটিয়ে দিচ্ছেন নদীর পাড়ে অবস্থান করে। পুরুষের পাশাপাশি মহিলা ক্রেতার সংখ্যা লক্ষ্যনীয়। মাছ নিয়ে যাবার সময় স্থানীয় কেউ সরকারদলীয় লোক পরিচয় দিয়ে মাছ ক্রেতাদের নিকট থেকে মাছ কেড়ে নিচ্ছে, আবার আইনের লোকও আটক করে নিয়ে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় সাধারণ মানুষের মতে, চলমান অভিযানে মা ইলিশ রক্ষা করতে হলে নদী পাড়ের আড়তগুলোতে ও খালের মুখে পুলিশ পাহারা বসিয়ে রাখতে হবে। নদীর ৪/৫টি স্থানে সার্বক্ষণিক কোস্টগার্ড ও নৌ-পুলিশের টইল রাখলে জেলেরা মাছ ধরতে সাহসও পাবে না, মানুষ দল বেঁধে কিনতেও আসবে না।
শিরোনাম:
মঙ্গলবার , ২৮ নভেম্বর, ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দ , ১৪ অগ্রহায়ণ, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।