
আমি সাকসেস, এবার হয় আমাকে মেরে ফেলেন, না হয় আমাকে পুলিশে দিন। নিজের স্ত্রী ও শাশুড়িকে হত্যার পর পালিয়ে যাওয়ার সময় স্থানীয় জনতার হাতে আটক ঘাতক মোহন জনতার সামনেই প্রকাশ্যে চিৎকার করে উপরোক্ত কথা বলে গেছেন। ৪ জন প্রত্যক্ষদর্শীর উপস্থিতিতে স্ত্রী ও শাশুড়িকে হত্যাকারী ঘাতক মোহন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি না দেয়ায় উক্ত মামলার ভবিষ্যৎ নিয়েও এখন চিন্তিত রয়েছে বাদী পক্ষ।
ফরিদগঞ্জে আলোচিত চাঞ্চল্যকর জোড়া খুনের ঘটনার পর থেকে নিহতের পরিবারের লোকজন নিরাপত্তার স্বার্থে তাদের তিনতলা ভবনে তালা মেরে নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে ঢাকায় চলে গেছে। জনমানবশূন্য বাড়িটিতে এখন আর আগের মতো আলো জ্বলে না। যেন অন্ধকারে ডুবে থাকে তিনতলা বাড়িটি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দুর্ধর্ষ মোহন তার স্ত্রী কলেজ পড়ুয়া তানজিনা আক্তার রিতু (২০) ও শাশুড়ি পারভিন বেগমকে হত্যার কথা স্বীকার না করায় এই মামলার ভবিষ্যৎ নিয়ে অজানা আতঙ্ক বিরাজ করছে বাদী পক্ষের মধ্যে। প্রায় ৪ মাস অতিবাহিত হওয়ার পর এখনো পুলিশ উক্ত হত্যার পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট ও ভিসেরা রিপোর্ট হাতে পায়নি। প্রভাবশালী বিবাদী পক্ষের জোরালো তদবিরের কারণে উক্ত ঘটনাটি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্যে একটি মহল উঠেপড়ে লেগেছে বলে ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছে।
শনিবার সরেজমিনে রিতুর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, জনমানবশূন্য তিনতলা বাড়িটি খাঁ খাঁ করছে। বাড়ির মূল ফটকে তালা দেয়া। বাড়িতে বাতি জ্বালানোরও কেউ নেই। রিতুর বাবা সেলিম খান বর্তমানে রয়েছেন বিদেশে। স্ত্রী ও এক কন্যাকে হারিয়ে সেলিম খান এখন পাগলপ্রায়। রিতুর ছোট ভাই নবম শ্রেণীর ছাত্র শাহাদাৎ হোসেন তার নিরাপত্তার স্বার্থে বর্তমানে আছে ঢাকায় তার নিকটআত্মীয়ের আশ্রয়ে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, এ উপজেলার গৃদকালিন্দিয়া এলাকার প্রবাসী সেলিম খাঁনের মেয়ে তানজিনা আক্তার রিতুর (২০) সাথে বিয়ে হয় পার্শ্ববর্তী লক্ষ্মীপুর জেলার রায়পুর উপজেলার দেবীপুর গ্রামের আলহাজ্ব মমতাজ মাস্টারের ছেলে আল মামুন মোহনের (৩২)। বিয়ের ক’মাস পরই মোহন চলে যায় সৌদি আরবে। এক পর্যায়ে মোহন বিদেশ থেকে আসার পরই শুরু হয় তার স্ত্রী রিতুর সাথে মনোমালিন্য। মোহন প্রায়শই তার স্ত্রীর মোবাইলে ইমুর মাধ্যমে ধারালো ছোরা ও পিস্তল পাঠিয়ে রিতুকে মেরে ফেলার হুমকি দিতো। দুজনেই একে অপরকে অহেতুক নানা কারণে সন্দেহ করে। এ সন্দেহ নিয়ে উভয়ের দ্বন্দ্বের মাত্রা তীব্র হতে থাকে। স্বামী-স্ত্রী হিসেবে কেউ কাউকে সহজে মেনে নিতে পারেনি। এ বিরোধ মিটানোর জন্য দুই পরিবারের সদস্যদের সাথে বৈঠক হলেও তা আর সুষ্ঠুভাবে সমাধান হয়নি।
ঘটনার দিন গত ১৩ মে অর্থাৎ ২৩ রমজান ইফতারের আগ মুহূর্তে রিতুর মা ইফতার তৈরি নিয়ে রান্না ঘরে ব্যস্ত। ঠিক এমন সময়ই রিতুর স্বামী একাই মোটরসাইকেল যোগে এসে গৃদকালিন্দিয়ায় তার শ্বশুরের ঘরে প্রবেশ করে। এক পর্যায়ে রিতুর কক্ষে গিয়ে রিতুর বুকে ও পেটে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করতে থাকে। চিৎকার শুনে রিতুর মা এগিয়ে আসলে মোহন তার শাশুড়িকে বুকে ও পেটে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করে বাথরুমে গিয়ে নিজের রক্ত মাখা হাত ধুয়ে মোটরসাইকেল যোগে পালিয়ে যেতে চায়। এ খবর শুনে এলাকাবাসী দৌড়ে এসে ঘাতক মোহনকে ঝাপটে ধরে উত্তম মধ্যম দিতে থাকে। এ সময় রিতুর স্বামী মোহন চিৎকার করে বলতে থাকে ‘আমি সাকসেস। এবার হয় আমাকে মেরে ফেলুন না হয় আমাকে পুলিশের হাতে তুলে দিন’। এক পর্যায়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে রক্তমাখা ছুরি সহ মোহনকে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যায়।
ওই এলাকার সাবেক এক ইউপি চেয়ারম্যান রিতুর চাচা বিল্লাল খাঁন বলেন, ঘাতক মোহন অত্যন্ত পরিকল্পিত ভাবে তার স্ত্রী ও শাশুড়িকেই হত্যা করে ক্ষান্ত ছিল না। রিতুর এক ভাইকেও হত্যা করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সে সময়ে রিতুর ছোট ভাই বাড়ির ছাদে থাকায় সে রক্ষা পেয়েছে। উক্ত বাজারের জনৈক ব্যবসায়ী রাজা সহ কয়েকজন বলেন, মোহন পালিয়ে যাওয়ার সময় জনতার হাতে আটক হওয়ার পর শুধু চিৎকার করে বলতে থাকে, আমি সাকসেস, এবার আমাকে হয় মেরে ফেলুন, না হয় পুলিশে দিন।
উক্ত ঘটনার পর গৃদকালিন্দিয়া হাজেরা হাসমত বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের শিক্ষার্থীরা নিহত রিতু ও তার মা পারভিনের হত্যাকারী মোহনের ফাঁসি চেয়ে মানববন্ধন করে।
উক্ত জোড়া খুনের মামলার বাদী লিয়াকত জানান, ফরিদগঞ্জ থানায় মোহনকে প্রধান আসামী করা ছাড়াও তার আরেক ভাই সুমন হোসেন (৪৫) ও বোন মনি বেগম মায়ার বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়। কিন্তু প্রধান আসামী গ্রেফতার হলেও বাকি দু আসামীকে পুলিশ গ্রেফতার করতে পারেনি।
এ মামলার তদন্তকারী পুলিশ অফিসার মোঃ সহিদ (পরিদর্শক) গত শনিবার এ প্রতিনিধিকে বলেন, রিতু ও তার মা পারভিন খুনের মামলার আসামীর সর্বোচ্চ শাস্তি যেন নিশ্চিত হয় সে জন্যে আমরা সব তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করেছি। খুনি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি না দিলেও খুনের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ৪ জনের জবানবন্দি আদালতে রেকর্ড করে রাখা হয়েছে। এখন পোস্টমর্টেম রিপোর্ট ও ভিসেরা রিপোর্ট হাতে আসলেই দ্রুততম সময়েই আদালতে চার্জশীট দেয়া হবে।