প্রথমে গ্রামীণফোনের ধামাকা অফারটি দিয়ে রাখি, ফেসবুক ফ্রি ব্যবহার করা যাবে গ্রামীণফোন ইন্টারনেট প্যাকেজে। গ্রাহকেরা প্রতিদিন রাত ১২ থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত বিনামূল্যে ফেসবুক ব্রাউজের সুবিধা পাবেন। রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে এক সংবাদ সম্মেলনে নতুন এই অফারের ঘোষণা দিয়েছে গ্রামীণফোন কর্তৃপক্ষ।
এই অফারের উপলক্ষ্যটা হল, ‘সবার জন্য ইন্টারনেট’ অর্জনের অংশ হিসেবে গ্রামীণফোন এই অফার চালু করেছে। এটা হল গ্রামীণফোনের যুক্তি। বর্তমান কথা থাক, এবার কিছু অতীতের কথা বলি।
তখন আমি ভার্সিটির স্টুডেন্ট। হলের বাসিন্দা। এখন যেমন ইন্টারনেটের অবস্থা, তখন তেমন ছিল মোবাইলফোনের অবস্থা। সময়টা সম্ভবত এপ্রিল ২০০৫। তরুন সমাজ টার্গেটেট একটা সেগমেন্ট করল গ্রামীণফোন। নাম দিল, ডিজুস- ডিজিটাল জুস! সবার কাছে মোবাইল ফোন পৌঁছে দিতে ধামাকা একটা অফার দিয়ে দিল ডিজুস। রাত ১২টা থেকে ভোর ছয়টা পর্যন্ত কথা বলা ফ্রি! এ যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি, রূপকথার গল্পের অফার। ফলে, মৌলিক চাহিদা- কথা-বলাটা হয়ে দাঁড়ালো জৈবিক চাহিদা। নিশিরাতের জৈবিক চাহিদা মেটাতে ডিজুস ছাড়া উপায় থাকলো না আর কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতী, তরুণ-তরুণী সম্প্রদায়ের। রাত ১২টা হলেই পাল্টে যেত বাংলাদেশের চিত্র। বিছানায়, বাথরুমে, রাস্তার ধারে, সিঁড়ি রুমে, ছাদের উপর, মাঠে, বিল্ডিংয়ের চিপায় যেখানেই নিরিবিলি সেখানেই খালি কথা আর কথা। ফলে, এপ্রিল ২০০৫-এ গ্রামীনফোনের গ্রাহক ৩ মিলিয়নে গিয়ে ঠেকল আর তা বেড়ে আগস্টে হল, ৪ মিলিয়ন। মোট অপারেটিং রেভিন্যিউ ২০০৫ সালে হল- ২ হাজার ৯৬২ কোটি টাকা, যা ২০০৪-এ ছিল ১ হাজার ৯৭০ কোটি টাকা! অবাক হবার ব্যাপার হচ্ছে, ফ্রির দুনিয়ায়ও তাদের রেভিন্যিউ কমেনি বরং বেড়েছে চরম হারে।
কিন্তু ভয়ংকর ব্যাপারটা ঘটলো অন্য জায়গায়। ঐ সময় গ্রামীণফোনের ডিজুসের কারনে ছাত্রদের ডেইলি রুটিন মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন হল। রাত জেগে কথা বলার কারনে ক্লাসে উপস্থিতি, ক্লাস টেস্টের রেজাল্ট সবখানেই এর কুপ্রভাব পড়তে লাগলো। একটা উদাহরন দেই। তাহলে, ঘটনার গভীরতা বুঝতে সুবিধা হবে। তখন অনার্স কেবল পাশ করবো করবো এমন সময়। তো এক জুনিয়রের সাথে চিন্তা করলাম একটা স্টার্টআপ শুরু করার। প্রজেক্টটা ছিল, প্যাপাইন এনজাইম উৎপাদনের। সব প্লান ঠিক করা হচ্ছে। ও নিয়মিত আসছে, এটার উপর লেখাপড়া করছে। জিনিসপত্র শেয়ার করছে। আমার মনে হল, হ্যাঁ ব্যাপারটা আলোর মুখ দেখবে। হঠাৎ আবিস্কার করলাম সে আমার রুমে আসা বন্ধ করে দিয়েছে। মোবাইল নাম্বার খোলা নেই। ওর ফ্রেন্ড-এর সাথে দেখা হলে খোঁজ নিলাম। ওর ফ্রেন্ড হাসতে হাসতে বলে, ভাই ডিজুস ইফেক্ট!
প্রিয় পাঠক, অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন, এই ফ্রি দিলে লাভ কোথায়। লাভটা হল এডিকশনে। রাতের বেলা কথা ফ্রি বললেও তার রেশ থেকে যায় দিনে। দিনের কথা কিন্তু ফ্রি থাকে না। আর অফারটাও থেকে যায় না। অফার চলে যায় কিন্তু অভ্যাস থেকে যায়। ভয়ানক যে ব্যাপারটা ঘটে, কথা বলার অভ্যাস তখন বেড়ে যায় অনেকগুন। শুধু যে টাকা যায় তা নয়, যায় সময়ও!
যেসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এডিকশন নিয়ে খেলা করে সেসব প্রতিষ্ঠান মারাত্মক! ডিজিটাল দুনিয়ায় ফ্রিমিয়াম নামের একটা শব্দ আছে। ফ্রিমিয়াম হল পপি গাছ। দেখুন, আফিম বানানোর প্রক্রিয়া। প্রথম দিকে ফ্রি হবে সবকিছু। এডিকশন চলে এলে তখন ব্যাপারটা হবে প্রিমিয়াম! তখন আপনি ভার্চুয়াল জিনিসপত্র কিনতে শুরু করবেন। লাভ হয় এখানেই। ফ্রিতে টকিংটম খেলতে খেলতে একদিন হয়তো ঐ টমের জন্য একটা টুপি কিনবেন বা তার প্রেমিকার জন্য কিনবেন কোন গিফট। বিজনেস অন!
গ্রামীণফোনের বর্তমান এই ইন্টারনেট অফারটিও আসলে ফ্রিমিয়াম। তারা এই অফারটি উইকিপিডিয়ার জন্য দিতে পারতো। কিন্তু দেয়নি। কারন, তারা কর্পোরেট। তাদের মূল উদ্দেশ্য প্রফিট ম্যাক্সিমাইজেশন। আমাদের চামড়া দিয়ে জুতা বানিয়ে আমাদেরই পরতে দিয়ে বলবে- জুতা ফ্রি, বেঁচে যাওয়া চামড়া ফ্রি, দিতে হবে অনলি জুতা বানানোর মজুরী! আমাদের প্রতি তাদের দরদ দেখে আবেগে তখন কান্দা ছাড়া উপায় থাকে না আসলে।
আসুন, একটু চিন্তা করি। জটিল চিন্তা নয়, ব্যাকটেরিয়া টাইপ চিন্তা। ফ্রির অফার উইকিপিডিয়ার বদলে কেন ফেসবুকে দিল গ্রামীণফোন? এই প্রশ্নের উত্তরও কিন্তু কঠিন নয়। সোজা উত্তর, ধুর! ক’জন মানুষ আর কতক্ষন উইকিপিডিয়া দেখে!
হ্যাঁ সেটাই। উইকিপিডিয়া মানুষকে শিক্ষা দিতে পারলেও, গ্রামীনফোনকে টাকা দিতে পারবে না। কারন, ফেসবুকের মতো উইকিপিডিয়ায় তো লিঙ্কের কোন খেলা নেই! ফেসবুকে প্রতিদিন শেয়ার হচ্ছে কোটি কোটি লিঙ্ক। আপনি ব্রাউজিং ফ্রিতে করছেন ফেসবুকে কিন্তু এই কোটি কোটি লিঙ্কের মধ্য থেকে কোনো লিঙ্কেই কি ক্লিক করবেন না আপনি? অবশ্যই করবেন। এই লিঙ্কে যখন ক্লিক করবেন তখন কিন্তু আপনাকে টাকা গুনতেই হবে। ব্যবহার করতে করতে, এডিকশন সৃষ্টি হবে ডিজুসের মতো। তাই ফ্রি দিলেও টাকা উঠে আসবে গ্রামীনফোনের, রেভিন্যিউ বেড়ে যাবে অনেক গুন।
বলা হয়ে থেকে, কোম্পানি হল মানুষের মত। ফলে তাকে সচেতন হতে হয়। গবেটের মতো কাজ করলে চলে না। গ্রামীনফোনও জানে ফেন্সিডিল বা ইয়াবার থেকেও এই ফ্রি ফেসবুকিং হবে মারাত্মক নেশা, যেমন হয়েছিল ডিজুস!
শুধু তাই নয়, এর মাধ্যমে একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতার দিকে ঠেলে দেয়া হল পুরো ইন্ডাস্ট্রিকে। যখন ডিজুস এসেছিল, তার পেছন পেছন বর্তমানের রবি তখনকার একটেল নিয়ে এসেছিল জোড়া সিম প্যাকেজ “জয়”- ডিজুসের মতো কার্যকারিতা ছিল সেটারও। এখন দেখা যাক, অন্যরা কী নিয়ে আসে!
সেই সময় সরকারকেই টানতে হয়েছিল গবেটের মতো কাজ করার লাগাম। তবে সরকারের বোধোদয় হয়েছিল বেশ কিছু দিন পর। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) এক আদেশ জারি করে। সেই আদেশে বলা হয়, কলচার্জ হবে সর্বোচ্চ ২ টাকা এবং সর্বনিম্ন ২৫ পয়সা। আর এর মধ্য দিয়ে সমাপ্তি ঘটে অসুস্থ প্রতিযোগিতার, শেষ হয় একটি ভয়ংকর নেশার জগতের!
আবার একই খেলা শুরু করতে চলেছে গ্রামীণফোন। ফেসবুক ব্যবহার মানেই কি ‘সবার জন্য ইন্টারনেট’? ইন্টারনেটের ব্যবহার কি শুধুই ফেসবুকভিত্তিক? আসলে আমাদের মনে রাখতে হবে, যেহেতু গ্রামীণফোন বিদেশি কোম্পানি- এরা কখনো আমাদের নিজেদের বা দেশীয় সমস্যা সমাধান করবে না বা আমাদের যুবক বা তরুণদের কী হচ্ছে এটা নিয়েও তারা কখনো মাথা ঘামাবে না।
সহজ একটা ব্যাপার বলি। গ্রামীণফোনকে কখনো আমাদের নিজস্ব কোন পোর্টালকে বা সাইটকে প্রমোট করতে দেখবেন না। ফেসবুকের পরিবর্তে তারা তো আমাদের দেশের “বেশতো”কে প্রমোট করতে পারতো। না, তারা সেটা করবে না। তারা করবে whatsapp, viber এইসব। কারন, তারা চিন্তা করে তাদের দেশের অর্থনীতি নিয়ে। কারন, তারা জানে যে জাতি ব্যবসা করে, সেই জাতিই আসলে শাসন করে। তাই তারা তাদের স্বজাতি বা নিজ দেশের পণ্যকেই উপরে তুলে ধরে সবার আগে।
এখানেই যে শেষ, তা নয়। ডিজিটাল শোষণের আরও দিক আছে। যে অ্যাপস দিয়ে হয়তো আপনি শুরু করতে পারতেন একটি স্টার্ট-আপ, প্রতিযোগিতার প্রলোভন দেখিয়ে সেই অ্যাপের মালিকানাও চলে যায় এইসব জলজ কুমিরদের কাছে।
তা সে যাই হোক, ফিরে যাই প্রথমে প্যারায়, এই ভাইরাসটা ছড়িয়ে পড়ার আগে সরকার বা এর সাথে সংশ্লিষ্ট কেউ কি এগিয়ে আসবেন?
এখানে একটি ব্যাপার পরিষ্কার করা দরকার। জিরো ফেসবুক বা জিরো ইউকিপিডিয়া শুধুমাত্র মোবাইল ভার্সনের জন্য। আর গ্রামীণফোনের এই অফার সকল ডিভাইসের জন্য।
শিরোনাম:
বুধবার , ৪ ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ , ২০ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।