চাঁদপুর নিউজ রিপোর্ট
রাজধানীর মতিঝিলের ঘরোয়া হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টের কর্মচারী কিশোর রিয়াদকে (১৬) গত মঙ্গলবার রাতে গুলি করে হত্যার পরও মতিঝিলেই অবস্থান করছিলেন প্রতিষ্ঠানটির মালিক আরিফুল ইসলাম সোহেল। ঘটনা জানাজানির পরও দীর্ঘ সময় প্রকাশ্যেই ছিলেন তিনি। অথচ পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তারের কোনো চেষ্টাই করেনি, বরং থানা পুলিশের মাধ্যমে রিয়াদের আত্মীয়স্বজনকে ম্যানেজ করে বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চালিয়েছিলেন সোহেল। অনুসন্ধানে এসব তথ্য জানা গেছে।
হত্যাকাণ্ড ঘটানোর পর মঙ্গলবার গভীর রাত পর্যন্ত সোহেল অবস্থান করছিলেন ওয়ারী থানার সামনে। বুধবার দুপুর পর্যন্ত নিজের বাসায়ই ছিলেন তিনি। বুধবার দুপুর ১টার পর পরিবারকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি যাওয়ার কথা বলে বাসা থেকে বেরিয়ে গা ঢাকা দিয়েছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত তাঁর ফ্ল্যাটে পুলিশ যায়নি। এমনকি হত্যাকাণ্ডের সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত ঘরোয়া রেস্টুরেন্টের ব্যবস্থাপক শফিক, কর্মী রাজুসহ কয়েকজনকে মামলায় আসামি হিসেবে অন্তর্ভুক্তই করেনি পুলিশ।
সহকর্মী রিয়াদ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে রেস্তোরাঁকর্মীরা গতকাল প্রেসক্লাবের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ করে। এ সময় তারা খুনিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করে। ছবি : কালের কণ্ঠ
তবে পুলিশের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, সোহেলকে গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে। মামলায় এজাহারভুক্ত আসামি ও ঘরোয়া রেস্তোরাঁর কর্মী জসিমকে (২৫) গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ, যা গতকাল বিকেল পর্যন্ত প্রকাশ করা হয়নি। গতকাল পর্যন্ত হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত অস্ত্রটি বৈধ নাকি অবৈধ তা নিশ্চিত করতে পারেনি পুলিশ।
এদিকে রিয়াদ হত্যার বিচার দাবিতে গতকাল বিকেলে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করেছে কয়েক হাজার রেস্তোরাঁকর্মী। তারা জানিয়েছে, আসামি সোহেলকে গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না দেওয়া হলে এ কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে।
জানতে চাইলে পুলিশের ওয়ারী বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) সৈয়দ নূরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা আসামি সোহেলকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা করছি। এক আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সোহেলের অস্ত্রের লাইসেন্সের বৈধতা যাচাই করা হচ্ছে।’ তিনি জানান, সোহেল যাতে পালিয়ে যেতে না পারে সে জন্য সব থানা ও ইমিগ্রেশনে বার্তা দেওয়া হয়েছে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও ওয়ারী থানার পরিদর্শক আলিম হোসেন শিকদার বলেন, ‘আশপাশের থানা, নিজ এলাকা, ডিসি অফিসসহ কয়েকটি স্থানে যাচাই করে অস্ত্রের লাইসেন্সের তথ্য পেতে হয়। আসামি যেহেতু পলাতক, তাই দু-চার দিন লাগবে।’ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আগামীকাল (আজ) আসামি জসিমকে আদালতে হাজির করা হবে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে আসামি গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।’ তিনি জানান, সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় ঘটনাস্থলে সোহেলের উপস্থিতি ছিল।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও নিহত রিয়াদের খালাতো ভাই মাইনুদ্দিন গতকাল বলেন, হত্যাকাণ্ডের সময় ৭৩ স্বামীবাগের নির্মাণাধীন বাড়িটির দ্বিতীয় তলায় অন্তত ২৫ জন উপস্থিত ছিল। ঘরোয়া থেকে সেখানে রিয়াদকে নিয়ে বাধার নির্দেশ দেন সোহেল। তখন বাবুর্চি খবির রিয়াদকে বেঁধে ফেলে। এরপর মোটা লাঠি দিয়ে রিয়াদকে মারতে থাকেন সোহেল। একপর্যায় কোমরে থাকা অস্ত্র বের করে ঠেকিয়ে গুলি করেন। তখন মাইনুদ্দিন ভাইয়ের হয়ে ক্ষমা চাইতে গেলে সোহেল তাঁকে বলেন, ‘তোকেও গুলি করব।’ মাইনুদ্দিন তখন পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। গুলি করার পর খবির, জসিম, রাজুসসহ কয়েকজন রিয়াদকে নিয়ে গাড়িতে তোলে। এ সময় তিনি পাশের কক্ষে গিয়ে বঙ্গবন্ধু প্রজন্ম লীগের ঢাকা মহানগরের নেতা আবু হানিফ সেতুকে ঘটনাটি জানান। এরপর মোবাইল ফোনে রিয়াদের বড় ভাই রিপনকে ঘটনাটি জানান। কয়েক মিনিট পরই সোহেল ব্যবস্থাপক শফিককে ফোন করে মাইনুদ্দিনকে আটকে রাখতে বলেন। তখন সেতুর সহায়তায় তিনি ওয়ারী থানায় গিয়ে ঘটনাটি জানান এবং জিডি করেন।
মাইনুদ্দিন বলেন, ওয়ারী থানায় যাওয়ার পর থেকেই সোহেল তাঁকে ফোন করা শুরু করেন। সোহেল মাইনুদ্দিনকে ফোনে বলেন, ‘আমি থানার সামনে আছি। পাঁচ মিনিটের জন্য থানার বাইরে আয়। আমি যা বলি তাই বল। তাইলে তোদের লাভ হবে। আমারও লাভ হবে।’ এভাবে কয়েকবার বলা হলেও মাইনুদ্দিন থানার বাইরে যায়নি।
পুলিশ রাতে ব্যবস্থাপক শফিককে আটক করে। তবে শফিক মালিকের শেখানো মতে ঘটনাটি ছিনতাই বলেই দাবি করেন। বুধবার ভোরে সত্য প্রকাশ করেন তিনি। এদিকে মাইনুদ্দিন আরো জানান, বৃহস্পতিবার ভোর ৪টার দিকে সোহেলের বন্ধু সালাউদ্দিন ওয়ারী থানায় যান। তিনিও মাইনুদ্দিনকে একই প্রস্তাব দেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মঙ্গলবার দিবাগত রাত ২টার পরও সোহেলের গাড়িটি ঘরোয়ার সামনে ছিল। গতকাল শান্তিনগরের ৮৮ (৫৯ চামেলীবাগ) অ্যাপার্টমেন্টে গেলে সেখানকার নিরাপত্তাকর্মী লিটন জানান, গত বুধবার দুপুর ১টার দিকে বাসার সবাই তাঁদের গ্রামের বাড়িতে চলে গেছে। জানা গেছে, ষষ্ঠ তলায় ২/৬০২ নম্বর ফ্ল্যাটে সোহেলের বড় ভাই শহীদুল ইসলাম রাসেলও থাকেন। গতকাল রাসেলের মোবাইল ফোনে কল করলে সাংবাদিক পরিচয় পেয়েই তিনি ফোন কেটে দেন।
নিহত রিয়াদের বড় ভাই রিপন মোবাইল ফোনে বলেন, ‘ঘটনার পর সোহেলের লোকজন হাসপাতালে গিয়ে ছিনতাইয়ের ঘটনা বলেছে। আমি বলছি, আমার ভাই রিয়াদকে খুন করছে। পুলিশ সোহেলকে ধরার চেষ্টা করেনি। তারা সারা রাত আমার ভাইরে (মাইনুদ্দিন) জেরা করছে। দিনেও হাজতে রাইখা জেরা করছে। আমারেও জেরা করছে। অথচ সিসি ক্যামেরায় দেখা গেছে গুলি কইরাই রিয়াদ রে নিয়া যায়।’ রিপন বলেন, ‘পুলিশ সঙ্গে সঙ্গে তারে ধরলে পালাইতে পারত না। আমি শুনছি, রাতে সে পুলিশের সামনেই ঘুরছে।’
মামলার বাদী রিপন জানান, গতকাল সকালে সোহেলের বড় ভাই রাসেল তাঁকে ফোন করে এক লাখ টাকা দেওয়ার কথা বলেন। এরপর ঢাকায় আসার প্রস্তাব দেন। রাসেল ‘কৌশলে’ বলেন, ‘ও (সোহেল) আমার বিরুদ্ধে মামলা করছে। ঢাকায় আয়। আমি তোদের সাহায্য করব।’ রিপন ও তাঁর সহকর্মীরা খোঁজ নিয়ে জেনেছেন, সোহেল ও রাসেলের মধ্যে যোগাযোগ আছে।
মামলার এজাহার ও সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, হত্যা মামলায় সোহেল, জসিম ও বাবুর্চি খবিরকে আসামি করা হয়েছে। তবে ব্যবস্থাপক শফিক, রাজুসহ আরো কয়েকজন এ হত্যায় সহযোগিতা করেছে যাদের নাম এজাহারে নেই। এ ব্যাপারে প্রত্যক্ষদর্শী মাইনুদ্দিন বলেন, ‘আমি পুলিশকে সবার নামই বলেছি। তারা কিভাবে নাম দিছে জানি না।’
বিচার দাবিতে আন্দোলন : রিয়াদ হত্যার বিচার দাবিতে গতকাল বিকেল ৩টা থেকে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান নেয় হাজার হাজার রেস্তোরাঁকর্মী। এ সময় গুলিস্তান, মতিঝিল, পল্টন, ফকিরাপুল, বংশালসহ আশপাশের রেস্টুরেন্টগুলোতে কর্মীরা কাজ বন্ধ রাখে। রেস্তোরাঁকর্মীরা মানববন্ধন এবং বিক্ষোভ মিছিল করে রিয়াদ হত্যার প্রতিবাদ জানায়। ঢাকা মহানগর হোটেল-রেস্তোরাঁ শ্রমিক লীগের সভাপতি শেখ সোলায়মান কবির বলেন, ‘আমাদের ভাইকে এভাবে হত্যা করার পরও সোহেলকে কেন পুলিশ ধরছে না? আমরা এর বিচার চাই। সোহেল গ্রেপ্তার না হওয়া পর্যন্ত আমাদের এই আন্দোলন চলবে। এ ঘটনা রাজন ও রাকিব হত্যার ঘটনাকে ছাড়িয়েছে। রেস্তোরাঁর কর্মীরা এভাবে মরতে চায় না।’
‘আমার ছেলে হত্যার বিচার চাই’ : আমাদের প্রতিনিধি জানান, রিয়াদ খুনের ঘটনার তার পরিবারে চলছে শোকের মাতম। রিয়াদের বয়স যখন তিন মাস, তখনই মারা যান তার বাবা। সেই থেকে রিয়াদ ও তার বড় ভাই রিপনকে নিয়ে বেঁচে থাকার নিরন্তর সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন দরিদ্র মা রোকেয়া বেগম। নিজে অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে যা সামান্য উপার্জন করেছেন, তাই দিয়েই দুই সন্তানের আবদার মিটিয়েছেন, সংসার চালিয়েছেন। এত কষ্টে বড় করা রিয়াদকে হারিয়ে তার মা এখন শোকে মুহ্যমান।
চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ উপজেলার ৮ নম্বর হাটিলা পূর্ব ইউনিয়নের হাড়িয়াইন গ্রামে রিয়াদদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তার মা রোকেয়া বেগম বিলাপ করতে করতে বলছেন, ‘আমার সোনার টুকরাকে ফিরিয়ে দেও। ওই ডাকাতকে মাইরা আমার চাঁদের টুকরার প্রতিশোধ নাও। যেই সন্তানের লাইগা জীবন শেষ করলাম, সেই সন্তানরে মিথ্যা অপবাদ দিয়া গুলি করল কেন?’- বলতে বলতেই মূর্ছা যাচ্ছিলেন রিয়াদের মা।
নিহত রিয়াদের চাচি মুন্নী বেগম বলেন, মাত্র তিন মাস বয়সে তার বাবা মফিজুল ইসলাম হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। সেই থেকে দুই সন্তানকে নিয়ে কষ্টে দিনাতিপাত করছিলেন রিয়াদের মা। বসতভিটা ছাড়া আর কোনো সম্পত্তি নেই তাদের।
বুধবার রাতে ঢাকা থেকে স্বজনরা নিহত রিয়াদের লাশ গ্রামে নিয়ে ফেরে। গতকাল সকালে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তার লাশ দাফন করা হয়।
প্রসঙ্গত, গত মঙ্গলবার রাতে স্বামীবাগে গুলি করে রিয়াদকে হত্যার পর মতিঝিলে ছিনতাইকারীদের গুলিতে নিহত হয়েছে বলে ‘নাটক’ সাজানো হয়। পরে রিয়াদের ভাই, প্রত্যক্ষদর্শীর বক্তব্য এবং সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজে জানা যায়, ঘরোয়া রেস্টুরেন্টের মালিক সোহেল একটি মোবাইল ফোন ও দেড় হাজার টাকা চুরির অপবাদে রিয়াদকে গুলি করে হত্যা করেন। তাঁর রেস্টুরেন্টে রুটি বানানোর সহকারী হিসেবে তিন বছর ধরে কাজ করছিল রিয়াদ।
শিরোনাম:
রবিবার , ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দ , ৯ আশ্বিন, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।