চাঁদপুর:
ব্যাপক তর্জন-গর্জন করে ধেয়ে আসা ঘূর্ণিঝড় ‘মহাসেন’ অবশেষে বিদায় নিয়েছে। বৃহত্তর বরিশাল জেলাসহ দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হলেও চাঁদপুর জেলায় বলতে গেলে ‘মহাসেন’ আঘাত হানেনি। যদিও চাঁদপুর ৭ নম্বর বিপদ সংকেতের আওতায় ছিলো। তবে মহাসেনের প্রভাবে চাঁদপুরে বুধবার রাত থেকে বৃহস্পতিবার দুপুর পর্যন্ত প্রবল বৃষ্টিপাত হয়েছে। বুধবার মধ্যরাত থেকে গতকাল সকাল পর্যন্ত মুষলধারে বৃষ্টি হয়েছে। এ ছাড়া অন্যান্য সময় গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হয়েছে। হাইমচরে ঘূর্ণিঝড় আতঙ্কে একজন মারা গেছেন। এ ছাড়া বিভিন্ন স্থানে বিদ্যুতের খুঁটি ভেঙ্গে গেছে এবং বিদ্যুতের তার ছিড়ে গেছে। ‘মহাসেন’ চলে যাওয়ায় বিপদ সংকেত প্রত্যাহার করে নিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। তাই গতরাত থেকেই নৌযান চলাচল শুরু করেছে।
ঘূর্ণিঝড় ‘মহাসেন’ প্রবল শক্তি নিয়ে ধেয়ে আসছে বাংলাদেশের দিকে। এর প্রভাবে ৫ থেকে ৭ ফুট জলোচ্ছ্বাস হওয়ার আশঙ্কা ছিলো। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও চাঁদপুরসহ বেশ কয়েকটি জেলাকে ৭ নম্বর বিপদ সংকেতের আওতায় আনে আবহাওয়া অধিদপ্তর। চাঁদপুর ৭ নম্বর বিপদ সংকেতের আওতায়- এ খবর জানতে পেয়ে বুধবার তাৎক্ষণিক জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির জরুরি সভা করেন জেলা প্রশাসক। সে সভায় জানানো হয় ব্যাপক প্রস্তুতির কথা। বিশেষ করে মেঘনা-ডাকাতিয়ার তীরবর্তী উপজেলা হাইমচর, চাঁদপুর সদর ও মতলব উত্তর উপজেলার জন্য নেয়া হয় বিশেষ সতর্ক ব্যবস্থা। ‘মহাসেন’ আঘাত হানলে যে কোনো উদ্ভূত পরিস্থিতিতে জনগণের জানমাল রক্ষায় যেনো তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়া যায় সে জন্যে সব ধরণের প্রস্তুতি নিয়ে রাখা হয়। এমনকি ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী পরিস্থিতিতে করণীয় ব্যাপারেও যাবতীয় ব্যবস্থা নিয়ে রাখা হয়। অর্থাৎ জনগণের জানমাল রক্ষায় সব ধরণের আগাম প্রস্তুতি ও ব্যবস্থা নিয়ে রাখা হয়।
‘মহাসেন’ বুধবার শেষ রাত থেকে বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে যে কোনো সময় আঘাত হানার আশঙ্কা ছিলো। শেষ পর্যন্ত চাঁদপুর জেলায় এটি আঘাত না হানলেও এর প্রভাবে প্রবল বৃষ্টিপাত ও ব্যাপক ঝড় হয়েছে। মুষলধারে বৃষ্টি হওয়ায় চাঁদপুর সেচ প্রকল্প ও মেঘনা-ধনাগোদা সেচ প্রকল্পের অভ্যন্তরে মারাত্মক জলাবদ্ধতার সৃষ্টিও হয়েছে। এ ছাড়া এর বাইরেও ফসলি জমিতে জলাবদ্ধতা হয়েছে। এতে ব্যাপক ফসলহানির আশঙ্কা করা হচ্ছে।
চাঁদপুর আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা গেছে, বুধবার ভোর ৬টা থেকে গতকাল সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত চাঁদপুর জেলায় ৭৭ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। আর বুধবার রাত থেকে গতকাল সকাল পর্যন্ত ‘মহাসেন’-এর প্রভাবে চাঁদপুরে যে ঝড় হয়েছে সে সময় বাতাসের গতিবেগ ছিলো ঘণ্টায় ১৮ থেকে ২০ কিলোমিটার। এই ঝড়ে অনেক জায়গায় বিদ্যুতের খুঁটি ভেঙ্গে গেছে, গাছের ডালপালা ভেঙ্গে এবং গাছ উপড়ে বিদ্যুতের তারের উপর গিয়ে পড়ে তার ছিড়ে গেছে। চাঁদপুর পল্লী বিদ্যুৎ অফিসে যোগাযোগ করে জানা গেছে, ফরিদগঞ্জের রামদাসেরবাগ ও কামতা এলাকায় বিদ্যুতের ২টি খুঁটি ভেঙ্গে গেছে এবং মহামায়া এলাকায়ও কয়েকটি খুঁটি ভেঙ্গে গেছে। তাছাড়া কমপক্ষে ৩০ থেকে ৪০টি স্পটে বিদ্যুতের তার ছিড়ে গেছে। যে সব জায়গায় বিদ্যুতের এই সমস্যা হয়েছে ওইসব স্থানে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে বিদ্যুতের লোকজন বিকেল থেকেই কাজ শুরু করে দিয়েছে বলে জানান চাঁদপুর পলস্নী বিদ্যুৎ জোনাল সদরের ডিজিএম। আজ কাজ শেষ করে ওইসব স্থানে পুরোপুরি লাইন চালু করা যাবে বলে তিনি আশাবাদী। আর চাঁদপুর পিডিবি অফিসে যোগাযোগ করে জানা গেছে, পিডিবির আওতাধীন বিদ্যুতের তেমন কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। ঝড়ের সময় অনেক জায়গায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়। কোথাও কোনো তার ছেড়ার সংবাদ পেলে ঝড়-বৃষ্টি কমার পর তাৎক্ষণিক বিদ্যুৎ বিভাগের লোক গিয়ে তা মেরামত করে বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক করা হয়।
সর্বোপরি আগাম প্রস্তুতি নিয়ে রাখা হয়। এ দিকে চাঁদপুর শহরের স্টেডিয়াম রোডস্থ চাঁদপুর বক্ষব্যাধি ক্লিনিকের বাউন্ডারির ভেতরে ঝড়ে বড় একটি গাছ উপড়ে বিদ্যুতের তারের উপর গিয়ে পড়ে। এতে ওই ক্লিনিকের এবং ক্লিনিকের পেছনের হাওলাদার বাড়িতে ২০-২৫টি পরিবার বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায় রয়েছে। আজ তা মেরামত করে বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক করা হবে বলে জানান পিডিবির কর্মকর্তা।
এ দিকে ঘূর্ণিঝড় আতঙ্কে হাইমচরে জোবেদা বেগম (৫০) নামে একজন মারা যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। তার বাড়ি ৫নং হাইমচর ইউনিয়নের চরকোড়ালিয়া গ্রামে। তার স্বামীর নাম আঃ গণি কবিরাজ। বেলা আনুমানিক ২টার দিকে জোবেদা বেগম নিজ বাড়িতে হার্ট অ্যাটাক করেন। তার বাড়ি নদীর ওপারে হওয়ায় এবং সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ থাকায় তাকে কোথাও চিকিৎসার জন্যে নেয়া সম্ভব হয়নি। ফলে তিনি বাড়িতেই মারা যান। গ্রাম্য চিকিৎসক এনে তার মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়।
চাঁদপুর বিআইডব্লিউটিএ সূত্রে জানা গেছে, বিপদ সংকেত প্রত্যাহার করায় চাঁদপুরে নৌযান চলাচলের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। গতকাল রাত থেকে চাঁদপুরে সব ধরনের নৌযান চলাচল শুরু হয়। এর আগে বুধবার দুপুরের পর থেকে বিকেল পর্যন্ত চাঁদপুরে সব ধরণের নৌযান চলাচল বন্ধ ছিলো।
এ দিকে দুপুর পর্যন্ত চাঁদপুর শহরের অধিকাংশ দোকানপাট ও প্রায় সব মার্কেট, বিপণী বিতান বন্ধ ছিলো। মানুষজনও তেমন একটা রাস্তায় নামেনি। বিকেল থেকে দোকানপাট খুলতে শুরু করে। বৃষ্টি ও ভয়ভীতির কারণে এমন ভুতুড়ে পরিবেশ ছিলো।