মিজানুর রহমান রানা,
চাঁদপুরের দুটি জুট মিল বন্ধ থাকায় টাকার অভাবে ঈদের আনন্দ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে প্রায় দু’হাজার শ্রমিক পরিবার। এসব শ্রমিক পরিবারের সাথে কথা বলে জানা গেছে অনেক হতাশা-বঞ্চনার চিত্র। যা শুনলে যে কোনো বিবেকবান মানুষও চোখের অশ্র“ ঝরাতে ব্যস্ত হবেন। আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় প্রতিটি মানুষই নিজ ও তার পরিবার নিয়ে ব্যস্ত। সামাজিকভাবে কেউ কারো খোঁজ-খবর নেওয়ার সময় পাচ্ছেন না। এমনি এক পরিস্থিতি স্বয়ং ঐতিহ্যবাহী চাঁদপুরে বিরাজ করছে।
সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই পাটের রাজধানী খ্যাত এ চাঁদপুরে স্বয়ং ব্রিটিশরাই এ ব্যবসা করতো। এরপর পাকিস্তান আমলেও সেটি চলমান ছিলো। স্বাধীনতার পরও স্বাধীন বাংলাদেশে জমজমাট ব্যবসাপাটের চাঁদপুরেই রাজধানী হিসেবে খ্যাত ছিলো। এর শহরের ব্যবসা কেন্দ্র পুরাণবাজারের পূর্ব শ্রীরামদী এলাকায় পাটের রাজধানী চাঁদপুরে দুটি জুট মিল ছিলো। এ দুটি মিলে যে পরিমাণ পাটের বস্তা ও সুতা তৈরি হতো তা শুধু দেশেই নয়, দেশের বাইরেও রপ্তানী করা হতো।
সেই রাজধানী খ্যাত চাঁদপুরে ডব্লিউ রহমান জুট মিলস ও স্টার আলকায়েদ জুট মিলস সারাদেশব্যাপী সুনাম ও ঐতিহ্য রয়েছে। এ দুটি মিলে এক সময় প্রায় ৫ থেকে ৭ হাজার শ্রমিক কাজ করতো। যা দ্বারা এ শহরের ব্যবসা বাণিজ্য সর্বেেত্রই জমজমাট ছিলো। কালের বিবর্তনে ও আধুনিকতার ছোঁয়ায় ধীরে ধীরে পাটের ব্যবহার কমে গিয়ে প্লাস্টিকের ব্যবহার বাড়ার কারণে হারিয়ে যেতে বসেছে এ পাটের উৎপাদিত পণ্য দড়ি বা সুতা এবং পাটের সুতা দ্বারা তৈরি বস্তার ব্যবহার। এক সময় যারা এই পাটের পণ্য ব্যবহার করতো এবং যে দামে ক্রয় করে এটি ব্যবহার হতো তার চেয়ে কম দামে প্লাস্টিকের বস্তা ও সুতা পাওয়ার কারণে ব্যবসায়ীরা ধীরে ধীরে এদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। এক পর্যায়ে মালিক প দিনের পর দিন লোকসানের খাতা গুণতে থাকে। নিরূপায় হয়ে শ্রমিকদের অজান্তেই মিল দুটি বন্ধ করতে বাধ্য হয়। পরবর্তীতে শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়নের সকল সংগঠনগুলোর ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের কারণে মালিক প শ্রমিকদের প্রাপ্য টাকা দিতে বাধ্য হয়। কিন্তু মিল দুটো চালাতে রাজি হয়নি। পরবর্তীতে দীর্ঘদিন দেশব্যাপী খ্যাত চাঁদপুর ডব্লিউ রহমান জুট মিল ও স্টার আলকায়েদ জুট মিল বন্ধ থাকে। অবশ্য এ দুটি জুট মিলের মালিক প আলাদা। এক পর্যায়ে চাঁদপুরের কিছু কিছু রাজনৈতিক নেতার অনেক অনুনয় বিনয়ের পর ডব্লিউ রহমান জুট মিলের মালিক ট্রান্সকম গ্র“পের কর্ণধার লতিফুর রহমান হবিগঞ্জের জনৈক মালিক ওয়াহিদ মিয়ার নিকট ৭ বছরের চুক্তিনামায় মিলটি ভাড়া দেয়। এ মালিক মিলটি ভাড়া নিয়ে চালুর পূর্বেই শ্রমিকদেরকে শর্ত জুড়ে দেয়। সেই শর্ত হলো নো ওয়ার্ক, নো পে- এই পদ্ধতিতে শ্রমিকদের কাজ করার অনুমতি দেওয়া হয়। নিরূপায় হয়েই শ্রমিকরা পেটের তাগিদে কাজ করতে বাধ্য হয়। পরবর্তীতে ভাড়াটিয়া মালিকপ মূল মালিকের কাছ থেকে যে শর্তে মিলটি ভাড়া নিয়েছে সেটি না করে অল্প কয়েকটি তাঁত ও সুতার মেশিন চালু করে। যেখানে প্রায় দেড় হাজার শ্রমিক কাজ করতো। ভাড়াটিয়া মালিকের আরো দু’বছর মেয়াদ থাকার পরও হঠাৎ করেই রাতের অন্ধকারে মিলটি লে অফ ঘোষণা করে বন্ধ করে দেয়। এতে করে এ মিলে চালু অবস্থায় ২শ’ তাঁতের প্রায় দেড় হাজার শ্রমিক অসহায় হয়ে পড়ে। মিলটি গত ডিসেম্বরে বন্ধ করে দেয়। দীর্ঘ সাত মাসে এ শ্রমিকরা অনাহারে অর্ধাহারে অসহায়ত্ব অবস্থায় পরিবার পরিজন নিয়ে জীবন নামের গাড়িটি চালিয়ে যাচ্ছে। একই সময় স্টার আল কায়েদ জুট মিলটিও মালিক পরে মাছুমা খান নামে ওই ব্যক্তি মিলটির পুরো সম্পত্তিসহ এটি বিক্রি করে দেয়। আর স্টার আল কায়েদ জুট মিলসহ সকল সম্পত্তি ক্রয় করেন চাঁদপুরের কৃতী সন্তান জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও চাঁদপুর-৪ আসনের সাংসদ ড. মো. শামছুল হক ভূঁইয়া। তিনি মিলটি ক্রয় করে এ জেলার শ্রমিকদের কল্যাণ করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যান। একদিকে বিদ্যুতের লোডশেডিং অন্যদিকে পণ্য উৎপাদনে ও বিক্রয়ে প্রতিনিয়ত বর্তমান মালিকপ লোকসান গুণতে গুণতে এক পর্যায়ে তিনিও মিলের প্রায় একশ’ভাগের আশিভাগ তাঁত বন্ধ করে দেন। বর্তমানে ওই মিলটিতে প্রায় যে ক’টি তাঁত চলমান রয়েছে সেখানে দু’শ’ শ্রমিকের মতো কাজ করছে। দীর্ঘ ৮ মাস যাবত অধিকাংশ তাঁত বন্ধ করে দেওয়ায় প্রায় ৫শতাধিক শ্রমিক একইভাবে নিরূপায় হয়ে যায়। এ মালিক প শ্রমিকদের নো ওয়ার্ক, নো পে এ শর্তে কাজ করান। দুটি মিলেই দুশিফটে চালু ছিলো। এক কথায় দুটো মিলের একটি সম্পূর্ণ বন্ধ অন্যটি সম্পূর্ণ না হলেও চার ভাগের তিনভাগ বন্ধ হওয়ায় প্রায় ২ হাজার শ্রমিক এখন দিশেহারা ও তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে চোখে অন্ধকার দেখছেন।
এদিকে এ দুটো মিলের মালিক পরে একটি সূত্র জানায়, বর্তমানে পাটের উৎপাদিত পণ্য উৎপাদনে ব্যাপক ব্যয়বহুল। আর এতো ব্যয়ের মধ্য দিয়েও উৎপাদন করে মালিক পকে প্রতিনিয়তই লোকসান গুণতে হচ্ছে। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, একটি বস্তা তৈরি করতে ব্যয় হয় ৫২ টাকা। আর এটি বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে ৪৭/৪৮ টাকা। অর্থাৎ প্রতিটি বস্তা মালিক পকে ৫ এবং ৬ টাকা করে লোকসান দেওয়ার কারণে তারা এ পদ্ধতি গ্রহণ করতে বাধ্য হচ্ছে। অপরদিকে এ বিষয়ে চাঁদপুর জেলার শ্রমিক লীগের সভাপতি নূরুল ইসলাম মিয়াজীর সাথে কথা হলে তিনি বলেন, মালিকপ যে শর্ত দিয়ে শ্রমিকদের কাজ করিয়েছে এতে আমাদের আন্দোলন করার মতো কোনো উপাদান নেই। তারপরও আমরা আন্দোলন সংগ্রাম করেছি, মালিকপরে সাথে বার বার সভা করেছি, আশা করছি পবিত্র রমজানের ঈদের পরে মিল দুটি চালু করার ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। তিনি এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, বর্তমানে একজন রিকশা চালক বারো ঘণ্টা রিকশা চালিয়ে ৫শত টাকা আয় করে। আর আমাদের এ মিলে একজন শ্রমিক বারো ঘণ্টা কাজ করে ১শ’ ৩৫ থেকে ২শ’ টাকা আয় করেন। তারপরও তারা কোনোরকম সৃষ্টিকর্তার সৃষ্ট এ পৃথিবীতে পরিবার পরিজন নিয়ে বেঁচে থাকতে চান।
সকল ভেদাভেদ শেষে একে অপরের পরিপূরক হিসেবে মানব সভ্যতার বিগত ইতিহাস হতে পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, সকল আনন্দই ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবার কাছে আনন্দ হয়েই দাঁড়ায়। কিন্তু মুসলমানদের সবচে’ বড় আনন্দের প্রথমটি হলো পবিত্র সিয়াম সাধনার মাস মাহে রমজান শেষে পবিত্র ঈদুল ফিতর। এ ঈদের আনন্দ সকলেই যখন ভাগাভাগি করে উদ্যাপন করবে সেই মুহূর্তে এ দুটো মিলের প্রায় ২ হাজার শ্রমিকের পরিবারের মুখে আনন্দের বন্যা না ভেসে বেদনার ছাপ থাকবে। আর তাদের শুধু আনন্দই নয়, পরিবার পরিজন নিয়ে বেঁচে থাকাটাই যখন কষ্ট হয়ে দাঁড়িয়েছে সেই মুহূর্তে সৃষ্টিকর্তার রহমতের বাণী কারো উপর নাজিল হবে কি? তাদের খোঁজ নেওয়ার বা কোনোরকম বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম কর্মের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে কি? এটিই এখন প্রশ্ন করছেন মিল দুটির সাধারণ খেটে খাওয়া শ্রমিক পরিবারগুলো।
শিরোনাম:
শনিবার , ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ , ৩ ফাল্গুন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।