মিজান লিটন ॥
ভুয়া এএসপি পরিচয়দানকারী চাঁদপুরের ইয়াছিন ফরহাদ (রাসেল) চলতি বছরের ২৯ জানুয়ারি বিকালে সিনিয়র পুলিশ সুপারের পোশাক পড়ে ঢাকায় একটি রিক্রুটিং এজেন্সির অফিসে এসে উল্টাপাল্টা কথা বলেন ফরহাদ (রাসেল)। এতে সন্দেহ হলে রিক্রুটিং এজেন্সির মালিক সাইফুল হাসান আজাদ রমনা থানা পুলিশকে খবর দেন। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলে সে তাদের পুলিশের পরিচয়পত্র দেখাতে পারেননি। জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে সে নিজেকে ভুয়া পুলিশ বলে স্বীকার করে। রমনা থানার এসআই মো. মিজানুর রহমান মামলাটি তদন্ত করছেন। দুই বার রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত।
রাসেল শুধুমাত্র রাজধানীতে প্রতারণা করেননি। সে চাঁদপুরের নিজ এলাকা এএসপি পরিচয় দিয়ে দাপটের সাথে এলাকায় প্রভাব খাটিয়েছে। এলাকার লোকজনদেরকে বিভিন্ন কাজ করে দেওয়ার নাম করে প্রায় সময়ই মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিতেন। নতুন বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়ার নাম করে বহু মানুষের কাছ থেকে বিপুল পরিমান টাকা নিয়েছে। তবে তার সাথে স্থানীয় আরো কিছু সংখ্যক দালাল চক্র জড়িত থাকায় ভয়ে অনেকে মুখ খুলতে রাজি হয়নি। প্রতারণার টাকায় সে তার বাড়ীতে আলিশান ৫ তলা ভবন নির্মাণের লক্ষ্যে এ পর্যন্ত দ্বিতল ভবন নির্মাণ করেছেন। বাড়ীর ডিজাইন দেখলে যে কেউ সহজে বুঝতে পারবেন একজন বেকার যুবকের এত বড় আলিশান বাড়ি নির্মাণের অর্থ রোজগারের উৎস কি।
ইয়াছিন ফরহাদ এটি তার ভুয়া নাম। এ ধরনের আরো নাম ব্যবহার করে সে মানুষের সাথে প্রতারণা করে আসছে। মূলত সে চাঁদপুর সদর উপজেলার ২নং আশিকাটি ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ডের রালদিয়া গ্রামের মোল্লা বাড়ীর মোখলেছুর রহমান মোল্লার বড় ছেলে রাসেল মোল্লা। বিসিএস পাশ করেছে বলে এলাকায় মানুষের কাছে সে প্রভাব বিস্তার করার জন্য প্রচার করত। তার পিতাও একই কথা জানালেন।
বুধবার (৭ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে সরেজমিন রাসেল মোল্লার গ্রামের বাড়ীতে গিয়ে দেখা যায়, তার বাড়ীর উত্তর ভিটায় ৫ তলা ফাউন্ডেশনের নির্মাণাধীন দ্বিতল ভবন। বর্তমান নির্মাণ পর্যন্ত যার আনুমানিক খরচ প্রায় কোটি টাকার মতো। বাড়ীতে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগসহ সকল সুবিধা রয়েছে।
রাসেলের পিতা মোখলেছুর রহমান জানান, তার দুই ছেলে ও এক মেয়ে। ছোট ছেলে চাঁদপুর সরকারি কলেজে অনার্স পড়েন। মেয়ের বিয়ে হয়েছে। রাসলেই বড়। সে চাঁদপুর সরকারি কলেজ থেকে সমাজ কল্যাণ বিষয়ে অনার্স ও মাষ্টার্স সম্পন্ন করেছে। বর্তমানে সে ঢাকায় থাকে। সেখানে সে কোসিং সেন্টার পরিচালনা করে এবং একটি বিদেশি কোম্পানিতে চাকুরী করে বলে আমরা জানি। মাঝে মাঝে ঢাকা থেকে বাড়িতে এসে দুই তিনদিন থাকে। বেশীরভাগ সময়েই থাকেন রাজধানীতে।
এ দিকে রাসেল পরিবারের লোকদের না জানিয়ে কয়েক বছর আগে চাঁদপুর শহরের চেয়ারম্যানঘাট এলাকায় রশিদ মাঝির মেয়েকে বিয়ে করে। কিন্তু তার প্রতারণার কথা জানতে পেরে স্ত্রী ডিভোর্স দিয়ে চলেগেছেন বলে জানা যায়। এ ঘটনায়ও ২০১৭ সালের ১৫ অক্টোবর শ^শুর পরিবার চাঁদপুর মডেল থানায় মামলা দায়ের করেন।
রাসেলের পিতা আরো জানান, সে রমনা থানায় গ্রেফতার হওয়ার পর আমরা কয়েকজন সাক্ষাৎ করতে গিয়েও সাক্ষাত করতে পারিনি। পরে চলে এসেছি। সে এ ধরনের প্রতারণামূলক কাজে জড়িত আছে বলে তিনি জানতেন না। আলিশান বাড়ি তৈরীর কথা জানতে চাইলে মোখলেছুর রহমান জানান, বাড়ি তৈরীতে আমারও টাকা আছে। আমি দোকান ও জমি বিক্রি করে টাকা দিয়েছি, যেন শেষ বয়সে একটু শান্তিতে থাকতে পারি। কিন্তু কোটি টাকা খরচের উৎস্য সম্পর্কে তিনি সঠিক উত্তর দিতে পারেননি।
স্থানীয় হোসনপুর গ্রামের দোয়া বাড়ীর বাসিন্দা দিপক মজুমদার জানান, রাসেল এলাকার মানুষকে নতুন বিদ্যুৎ সংযোগ ও খুটি এনে দিবেন বলে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা করে নিয়েছেন। আমার কাছ থেকে ৪৫ হাজার টাকা নিয়েছে কিন্তু আমি এখন পর্যন্ত বিদ্যুৎ পাইনি। হোসেনপুর গ্রামের হাজী বাড়ীর বহু পরিবার থেকে বিভিন্ন অংকের টাকা নিয়েছে। কিন্তু ভয়ে কেউ বলতে চায় না। কারণ তার সাথে পল্লী বিদ্যুৎ অফিসের প্রভাবশালী বহু দালালের সখ্যতা রয়েছে।
দক্ষিণ রালদিয়া গ্রামের ব্যবসায়ী শাহ্ আলম খান জানান, রাসেল আমাদের এলাকার সম্মান হানি করেছে। সে একেক জায়গায় একেক পরিচয় দিয়ে চলে। আমাদের পরিবারের কাছ থেকে ৫টি নতুন বিদ্যুৎ সংযোগ দিবে বলে ১লাখ টাকা দাবী করে। তাকে সন্দেহ হলে আমরা টাকা দেইনি। পরক্ষণে মাত্র ২ হাজার টাকা খরচ করে বিদ্যুৎ সংযোগ এনেছি। রাসেল তার বাড়ি তৈরি করতে গিয়ে এলাকার কোন লোকদেরকে কাজে নেয়নি। সে জেলার বাহির থেকে লোক এনে পাথর দিয়ে আলিশান বাড়ি তৈরী করছে।
চাঁদপুর মডেল থানায় রাসেলের বিরুদ্ধে মামলার বিষয়ে মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি তদন্ত) মাহবুবুর রহমান মোল্লা জানান, এ ধরনের একটি মামলা হয়েছে। মামলাটির তদন্ত চলছে।
চলতি বছরের ২৯ জানুয়ারি বিকালে সিনিয়র পুলিশ সুপারের পোশাক পড়ে ঢাকায় একটি রিক্রুটিং এজেন্সির অফিসে এসে উল্টাপাল্টা কথা বলেন ফরহাদ (রাসেল)। এতে সন্দেহ হলে রিক্রুটিং এজেন্সির মালিক সাইফুল হাসান আজাদ রমনা থানা পুলিশকে খবর দেন। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলে সে তাদের পুলিশের পরিচয়পত্র দেখাতে পারেননি। জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে সে নিজেকে ভুয়া পুলিশ বলে স্বীকার করে। রমনা থানার এসআই মো. মিজানুর রহমান মামলাটি তদন্ত করছেন। দুই বার রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত।