প্রতিনিধি
চলমান সমাজ ব্যবস্থায় প্রতিটি মানুষই নিজ ও তার পরিবার নিয়ে ব্যস্ত। সামাজিকভাবে কেউ কারো খোঁজ-খবর নেয়ার সময় এখন কারো নেই! এটি চিরন্তন সত্য। এমনি এক পরিস্থিতি স্বয়ং ঐতিহ্যবাহী চাঁদপুরে বিরাজ করছে। সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই পাটের রাজধানী খ্যাত এ চাঁদপুরে ব্রিটিশরাই এ ব্যবসা শুরু করে। এরপর পাকিস্তান আমলেও সেটি চলমান ছিলো। স্বাধীনতার পরও বাংলাদেশে চাঁদপুরে পাটের ব্যবসা জমজমাট ছিল। এর শহরের ব্যবসা কেন্দ্র পুরাণবাজারের পূর্ব শ্রীরামদী এলাকায় দু’টি জুট মিল ছিলো। এ দু’টি মিলে যে পরিমাণ পাটের বস্তা ও সুতা তৈরি হতো তা শুধু দেশেই নয়, দেশের বিদেশেও রপ্তানী করা হতো।
চাঁদপুরের ডাব্লিউ রহমান জুট মিল ও স্টার আলকায়েদ জুট মিলের সারা দেশব্যাপী সুনাম ও ঐতিহ্য রয়েছে। এ দু’টি মিলে এক সময় প্রায় ৫ থেকে ৭ হাজার শ্রমিক কাজ করতো। যা দ্বারা এ শহরের ব্যবসা বাণিজ্য সর্বক্ষেত্রেই জমজমাট ছিলো। কালের বিবর্তনে ও আধুনিকতার ছোঁয়ায় ধীরে ধীরে পাটের ব্যবহার কমে গেছে। প্লাস্টিকের ব্যবহার বাড়ার কারণে হারিয়ে যেতে বসেছে এ পাটের উৎপাদিত পণ্য দরি বা সুতা এবং পাটের সুতা দ্বারা তৈরি বস্তার ব্যবহার। এক সময় যারা এই পাটের পণ্য ব্যবহার করতো এবং যে দামে ক্রয় করে এটি ব্যবহার হতো তার চেয়ে কম দামে প্লাস্টিকের বস্তা ও সুতা পাওয়ার কারণে ব্যবসায়ীরা ধীরে ধীরে এদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। এক পর্যায়ে মালিকপক্ষ দিনের পর দিন লোকসানের খাতা গুণতে থাকে। নিরূপায় হয়ে শ্রমিকদের অজান্তেই মিল দুটি বন্ধ করতে বাধ্য হয়। পরবর্তীতে শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়নের সকল সংগঠনগুলোর ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের কারণে মালিক পক্ষ শ্রমিকদের প্রাপ্য টাকা দিতে বাধ্য হয়। কিন্তু মিল দু’টো চালাতে রাজি হয়নি।
পরবর্তীতে দীর্ঘদিন চাঁদপুর ডাব্লিউ রহমান জুট মিল ও স্টার আলকায়েদ জুট মিল বন্ধ থাকে। অবশ্য এ দু’টি জুট মিলের মালিকপক্ষ আলাদা। এক পর্যায়ে চাঁদপুরের কিছু কিছু রাজনৈতিক নেতার অনেক অনুনয় বিনয়ের পর ডাব্লিউ রহমান জুট মিলের মালিক ট্রান্সকম গ্র“পের কর্ণধার লতিফুর রহমান হবিগঞ্জের জনৈক মালিক ওয়াহিদ মিয়ার নিকট ৭ বছরের চুক্তিনামায় মিলটি ভাড়া দেয়। এ মালিক মিলটি ভাড়া নিয়ে চালুর পূর্বেই শ্রমিকদেরকে শর্ত জুড়ে দেয়। সেই শর্ত হলো নো ওয়ার্ক, নো পে- এ পদ্ধতিতে শ্রমিকদের কাজ করার অনুমতি দেয়া হয়। নিরূপায় হয়েই শ্রমিকরা পেটের তাগিদে কাজ করতে বাধ্য হয়। পরবর্তীতে ভাড়াটিয়া মালিকপক্ষ মূল মালিকের কাছ থেকে যে শর্তে মিলটি ভাড়া নিয়েছে সেটি না করে অল্প কয়েকটি তাঁত ও সুতার মেশিন চালু করে। যেখানে প্রায় দেড় হাজার শ্রমিক কাজ করতো। ভাড়াটিয়া মালিকের আরো দু’বছর মেয়াদ থাকার পরও হঠাৎ করেই গত ডিসেম্বর মাসে রাতের অন্ধকারে মিলটি লে অফ ঘোষণা করে বন্ধ করে দেয়। এতে করে এ মিলে চালু অবস্থায় ২শ’ তাঁতের প্রায় দেড় হাজার শ্রমিক অসহায় হয়ে পড়ে। দীর্ঘ সাত মাসে এ শ্রমিকরা অনাহারে অর্ধাহারে অসহায় অবস্থায় পরিবার পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছে।
একই সময় স্টার আল কায়েদ জুট মিলটিও মালিকপক্ষের মাছুমা খান মিলটির পুরো সম্পত্তিসহ বিক্রি করে দেয়। আর স্টার আল কায়েদ জুট মিলসহ সকল সম্পত্তি ক্রয় করেন চাঁদপুরের কৃতী সন্তান জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও চাঁদপুর-৪ আসনের সাংসদ ড. মোহাম্মদ শামছুল হক ভূঁইয়া। তিনি মিলটি ক্রয় করে এ জেলার শ্রমিকদের কল্যাণ করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যান। একদিকে বিদ্যুতের লোডশেডিং অন্যদিকে পণ্য উৎপাদনে ও বিক্রয়ে প্রতিনিয়ত বর্তমান মালিকপক্ষ লোকসান গুণতে গুণতে এক পর্যায়ে তিনিও মিলের প্রায় একশ’ ভাগের আশিভাগ তাঁত বন্ধ করে দেন। বর্তমানে ওই মিলটিতে প্রায় যে ক’টি তাঁত চলমান রয়েছে সেখানে দু’শ’ শ্রমিকের মতো কাজ করছে। দীর্ঘ ৮ মাস যাবৎ অধিকাংশ তাঁত বন্ধ করে দেয়ায় প্রায় ৫শতাধিক শ্রমিক বেকার হয়ে যায়। এ মালিকপক্ষ ও শ্রমিকদের নো ওয়ার্ক, নো পে এ শর্তে কাজ করান। দু’টি মিলেই দু’ শিফটে চালু ছিলো। এক কথায় দু’টো মিলের একটি সম্পূর্ণ বন্ধ অন্যটি সম্পূর্ণ না হলেও চার ভাগের তিনভাগ বন্ধ হওয়ায় প্রায় ২ হাজার শ্রমিক এখন দিশেহারা ও তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে চোখে অন্ধকার দেখছেন।
এদিকে এ দু’টো মিলের মালিক পক্ষের একটি সূত্র জানায়, বর্তমানে পাটের উৎপাদিত পণ্য উৎপাদনে ব্যাপক ব্যয়বহুল। আর এতো ব্যয়ের মধ্য দিয়েও উৎপাদন করে মালিক পক্ষকে প্রতিনিয়তই লোকসান গুণতে হচ্ছে। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, একটি বস্তা তৈরি করতে ব্যয় হয় ৫২ টাকা। আর এটি বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে ৪৭/৪৮ টাকা। অর্থাৎ প্রতিটি বস্তা মালিক পক্ষকে ৫ এবং ৬ টাকা করে লোকসান দেয়ার কারণে তারা এ পদ্ধতি গ্রহণ করতে বাধ্য হচ্ছে।
অপরদিকে এ বিষয়ে চাঁদপুর জেলার শ্রমিক লীগের সভাপতি নূরুল ইসলাম মিয়াজীর সাথে কথা হলে তিনি বলেন, মালিকপক্ষ যে শর্ত দিয়ে শ্রমিকদের কাজ করিয়েছে এতে আমাদের আন্দোলন করার মতো কোনো সুযোগ নেই। তারপরও আমরা আন্দোলন সংগ্রাম করেছি, মালিকপক্ষের সাথে বার বার সভা করেছি, আশা করছি পবিত্র রমজানের ঈদের পরে মিল দু’টি চালু করার ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। তিনি এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, বর্তমানে একজন রিক্শা চালক বারো ঘণ্টা রিকশা চালিয়ে ৫শ’ টাকা আয় করে। আর আমাদের এ মিলে একজন শ্রমিক বারো ঘণ্টা কাজ করে ১শ’ ৩৫ থেকে ২শ’ টাকা আয় করেন। তারপরও তারা কোনোরকম পরিবার পরিজন নিয়ে বেঁচে থাকতে চান।
মুসলমানদের সবচে’ বড় আনন্দের প্রথমটি হলো পবিত্র সিয়াম সাধনার মাস মাহে রমজান শেষে পবিত্র ঈদুল ফিতর। এ ঈদের আনন্দ সকলেই যখন ভাগাভাগি করে উদ্যাপন করবে সেই মুহূর্তে এ দু’টো মিলের প্রায় ২ হাজার শ্রমিকের পরিবারের মুখে আনন্দের বন্যা না ভেঁসে বেদনার ছাপ থাকবে। আর তাদের শুধু আনন্দই নয়, পরিবার পরিজন নিয়ে বেঁচে থাকাটাই যখন কষ্ট হয়ে দাঁড়িয়েছে সেই মুহূর্তে সৃষ্টিকর্তার রহমতের বাণী কারো উপর নাজিল হবে কী? তাদের খোঁজ নেয়ার বা কোনোরকম বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম কর্মের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে কী? এটাই এখন প্রশ্ন।
শিরোনাম:
শনিবার , ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ , ৩ ফাল্গুন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।