প্রতিনিধি=
চাঁদপুরে নববঁধূ হাজের হত্যা মামলার প্রধান আসামী শরীফকে পুলিশ আটক করেছে। জানা যায়, চাঁদপুর শহরের চাঞ্চল্যকর নববঁধূ হাজেরা বেগম হত্যাকাণ্ডের প্রধান আসামী শরীফ হোসেন মুন্সী (৩০)-কে চাঁদপুর মডেল থানার এস.আই আবুল কাশেম গত সোমবার পৌনে ৪টায় রঘুনাথপুর বেড়িবাঁধ এলাকার সড়কের উপর থেকে আটক করেছে।
পুলিশ ও মামলা সূত্রে জানা যায়, চাঁদপুর শহরের পীর বাদশা মিয়া রোডের মুন্সী বাড়ির নববঁধূর হাতের মেহেদীর রং না মুছতেই হাজেরা বেগম (১৪)-কে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। যৌতুকের দাবিতে হত্যার অভিযোগ এনে ৭ জনকে আসামী করে মামলা দায়ের করা হয়েছে। শনিবার রাত ১০টায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের সংশোধনী ২০০৩ ৭(৩০) ধারায় মামলাটি দায়ের করেন নিহত হাজেরার মা পারভীন বেগম। মামলা নং-১৭। মামলায় আসামীরা হচ্ছেঃ নিহত হাজেরার স্বামী শরীফ মুন্সী, দেবর সোহাগ মুন্সী, হাবীবুর রহমান মুন্সী, আরিফ মুন্সী সর্ব পিতা ফজলুল হক মুন্সী, মনোয়ারা বেগম, আনেয়ারা বেগম, সর্ব সাং- মুন্সী বাড়ি, পীর বাদশা মিয়া রোড, চাঁদপুর পৌরসভা, চাঁদপুর।
১২ ডিসেম্বর শুক্রবার দিবাগত রাত পৌনে ১০টায় নিহত হাজেরার লাশ চাঁদপুর সেন্ট্রাল হাসপাতালে রেখে তার স্বামীর পরিবার পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় হাসপাতাল ভাংচুর ও স্টাফদের ব্যাপক মারধরের ঘটনা ঘটে। চাঁদপুর মডেল থানা পুলিশ হাসপাতাল থেকে লাশটি ময়না তদন্তের জন্য থানায় নিয়ে যায়। পরদিন শনিবার ময়নাতদন্তের পর বিকেল ৪টায় জানাজা শেষে হাজেরার লাশ দাফন করা হয় পিতার বাড়ি বিষ্ণুদী খন্দকার বাড়ির পারিবারিক কবরস্থানে। এ ঘটনায় হাজেরা বেগমের বাবা-মা ও আত্মীয়-স্বজনদের কান্নায় আকাশ বাতাস ভারি হয়ে উঠে। এলাকায় নেমে আসে শোকের ছাঁয়া। হাজেরার স্বামী শরিফ মুন্সী শহরের বিপনীবাগ পৌর মার্কেটে লোহার গ্রীলের ব্যবসা করে। তার পিতা ফজলুল হক মুন্সী তার জীবদ্দশায় রিক্সা চালক ছিলেন।
এলাকাবাসী জানায়, শরিফ মুন্সীর বড় ভাই হাবীব মুন্সী তার স্ত্রীকেও হত্যা করার জন্য পরিকল্পনা নিয়ে ব্যর্থ হয়। পরবর্তীতে হাবীবের স্ত্রী তার পরিবারের বিরুদ্ধে নারী নির্যাতন মামলা করলে হাবীব ২টি সন্তান রেখে তার স্ত্রীকে তালাক দিয়ে বিদায় করে দেয়।
নিহত হাজেরার মৃত্যুর ঘটনাটি সরেজমিন তদন্তে তার স্বামী শরীফ মুন্সীর বাড়িতে গিয়ে পরিবারের কোন সদস্যকে পাওয়া যায়নি। ঘটনার পর থেকে ওই বাড়ির সকলেই পলাতক। শরীফের বড় ভাই হাবীবের মেয়ে শহরের লেডী প্রতিমা মিত্র বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ৬ষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী সূচনা আক্তার জানায়, সন্ধ্যার পর চাচী আমাদের সাথে মুড়ি খায়। এরপর আমার দাদী (মনি বেগম)সহ আমরা কয়েকজন পালিত গরুর অসুস্থ্যতায় গরুর ঘরে ছিলাম। দাদু আমাকে চাচির (হাজেরা) এশার নামাজ পড়া হয়েছি কিনা দেখে তাকে ডাকতে বলে। আমি চাচিকে ডাকতে দো’তালায় চাচীর রুমে গিয়ে দেখি চাচী শাড়ি গলায় পেঁছানো অবস্থায় ঝুঁলে আছে। আমার চিৎকারে আমার পিতা হাবিব মুন্সী, দাদু, দাদা দৌঁড়ে ওই রুমে আসে। ঝুঁলন্ত অবস্থা থেকে সবাই নামিয়ে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। এরপর আর আমি কিছু জানিনা।
গত দু’মাস ৩ দিন পূর্বে শরীফের সাথে হাজেরার এ বিয়ে হয়েছিল দু’পরিবারের অভিভাবকদের পছন্দের মাধ্যমে। বিয়ের পর থেকে শরীফ হাজেরাকে স্ত্রী হিসেবে পছন্দ করতো না। হাজেরা ৯ম শ্রেণীর বার্ষিক পরীক্ষার জন্য প্রায় ১ মাস তার পিতার বাড়িতে ছিলো। গত রোববার ৮ ডিসেম্বর হাজেরাকে তার পিতার বাড়ি থেকে স্বামীর বাড়িতে আনা হয়। তবে এই ঘটনার পর থেকেই শরিফের পরিবারের লোকজন বাড়ি ছেড়ে আত্মগোপন করে আছে।
নিহত হাজেরার চাচাত ভাই সোহেল জানায়, শুক্রবার রাত ৯টায় তার চাচা ফরিদ খন্দকার ফোনে বলে সেন্ট্রাল হাসপাতালে যাওয়ার জন্য হাজেরা অসুস্থ্য। তাৎক্ষণিক সে হাসপাতালে গিয়ে হাজেরার স্বামী শরীফের বড় ভাই হাবীবকে হাসপাতালে উপস্থিত পায়। তবে কিভাবে হাজেরার মৃত্যু হয়েছে জানতে চাইলে কোন কথা বলেনি। তবে হাবীব কাঁদতে কাঁদতে বলছিলো ‘ও ভাই তোরা কী করলি’? এরপর কেবিনে গিয়ে রাবেয়ার মৃত লাশ দেখতে পাই।
হাজেরার পিতা ফরিদ খন্দকার জানায়, আমার মেয়েকে তার শ্বশুর পরিবার লোকজন পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে। কারণ গত ২০/২৫দিন পূর্বে আমার জামাতা আমাকে বলেছে, সে তার পরিবারের লোকদের চাপে পড়ে আমার মেয়েকে বিয়ে করেছে। সে এত কম শিক্ষিত মেয়েকে বিয়ে করার ইচ্ছে ছিলো না।
অপরদিকে হাজেরা তার বাবাকে এর কয়েকদিন পূর্বে ফোনে জানায়, তার স্বামী শরীফ নতুন ব্যবসা শুরু করবে, সেই ব্যবসার জন্য ৩ লাখ টাকা প্রয়োজন। একথা হাজেরা তার পিতাকে জানালে তিনি তাৎক্ষণিক এতটাকা জোগার করতে পারবেন না বলে জানান। ফরিদ খন্দকার মেয়েকে তৌফিক হলে টাকা দিবেন বলে জামাইকে বলতে মেয়েকে সান্ত্বনা দেন। এরপর থেকে টাকার ব্যাপারে আর কোন ধরনের কথা হয়নি। হাজেরা পরীক্ষার জন্য ২৭দিন বাড়িতে থেকে গত রোববার ৮ ডিসেম্বর শ্বশুর বাড়িতে আসে। উল্লেখ্য, হাজেরা ও শরীফের পরিবারের সম্মতিতে সামাজিকভাবে গত ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৩ তারিখে ইসলামী শরীয়াহ মোতাবেক তাদের বিয়ে সম্পন্ন হয়। তবে এই ঘটনায় চাঁদপুর শহরময় ব্যাপক উত্তেজনা ও জল্পনা-কল্পনা চলছে।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই আবুল কাশেম জানায়, সুরতহাল রিপোর্টে তিনি হাজেরার গলায় চাপের চিহ্ন ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে নির্যাতনের দাগ পেয়েছেন। তিনি ধারণ করছেন তাকে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করা হয়েছে। এদিকে চাঁদপুরের কয়েকটি মানবাধিকার সংস্থা, জেলা মহিলা পরিষদ ও এলাকাবাসী এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন এবং হত্যাকারীদেরকে আইনের আওতায় এনে তাদের শাস্তি তথা ফাঁসি দাবি করেছেন। এদিকে এ ঘটনায় চাঁদপুরের অর্ধশত প্রাইভেট হাসপাতাল গতকাল মঙ্গলবার দিনব্যাপী ধর্মঘট পালন করেছে।