চাঁদপুরে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নারীরা মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে জীবন-বাজি রেখে কাজ করে ॥ অনেক নারী পাক বাহিনীর হাতে নির্যাতিত হলেও এর প্রতিকার আজও হয়নি
শওকত আলী ঃ
চাঁদপুরে ১৯৭১ সালে পাক হানাদার বাহিনী এদেশে বর্বরোচিত হামলা চালিয়ে ছিলো। তারা এদেশের মানুষের উপর অমানবিক ভাবে হামলা চালিয়ে নির্যাতন করেছিলো। যা’ ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। যে চিত্র আজো দেখলে মানুষের শরীর শিহরিত হয়ে উঠে। তারা এ দেশের নারীদের ইজ্জত লুন্ঠন ও হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে ইতিহাসকে হার মানিয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাসে এ ধরনের যুদ্বের ঘটনা বিরল। এ সময় এদেশের প্রান্তিক যুবকরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে পাক বাহিনীর উপর ঝাপিয়ে পড়ে দেশ মাতৃকার টানে। দেশ স্বাধীন করাই ছিলো তাদের একমাত্র লক্ষ। ৩০ লাখ মা- বোনের ইজ্জাতের বিনিময়ে ও শহীদদের রক্তের বিনিময়ে এ দেশ সেদিন স্বাধীন হয়েছিলো মাত্র ৯ মাসের মাথায়। যা পৃথিবীর যুদ্ধের ইতিহাসে একটি মাইল ফলক। কোন জাতি এ অল্প সময়ে স্বাধীনতা অর্জন করা সম্ভব হয় নি। সে সময় ধর্ম বর্ন বেদাভেদ ভুলে গিয়ে সকলে পাক বাহিনিকে প্রতিহত করতে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছিলো এ দেশটাকে শত্রু মুক্ত করতে। সেই সময় চাঁদপুর শহর ও শহরতলীতে বসবাসরত হরিজন প্রান্তিক ও সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠির পুরুষের পাশপাশি নারীরাও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে সকল প্রকার সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলো পাক বাহিনীকে নির্মূল করার প্রয়াসে। এ জন্য অনেক নারীকে জীবন ও ইজ্জত দিতে হয়েছিলো। চাঁদপুর শহরের ৩টি স্থানে এ সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠি বৃটিশ আমল থেকে বসবাস করে যাচ্ছে। পাকিস্তান সরকার এ দেশ শাসনামলে এ হরিজন সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠি তখনো বসবাস করেছিলো বর্তমান অবস্থানে। এ দেশে যখন পাক বাহিনীর সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ শুরু হয়, তখনও এ সম্প্রদায়ের শত শত লোক শহরের তালতলা স্বর্ণ খোলা হরিজন কলোনি, রেলওয়ে বড় স্টেশন হরিজন কলোনি ও পুরান বাজার হরিজন কলোনিতে বসবাসরত ছিলো। হরিজন নেতা ও তাদের এসব কলোনিতে বসবাসরত বর্তমানে কয়েক হাজার হরিজন সম্প্রদায়ের শিশু, যুবক- যুবতী, বৃদ্ধ- বৃদ্ধা রয়েছে।
এদের সাথে ব্যাপক আলোচনাকালে জানা যায়, ১৯৭১ সালে এদেশের মানুষের উপর যখন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আক্রমন চালায়, তখন মুক্তিযোদ্ধারা দেশ মাতৃকার টানে এদেশের সাধারণ মানুষ ও মা বোনের ইজ্জত রক্ষার্থে ঝাপিয়ে পরে। তখন চাঁদপুর সহ বাংলাদেশের যে যে স্থানে হরিজন সম্প্রদায়ের মানুষেরা বসবাস করতো, তারা তখন বসে থাকেনি। হরিজন প্রান্তিক জনগোষ্ঠির যুবকরা তখন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলো। তার পাশাপশি হরিজন নারীরা ঘরে বসে থাকে নাই। তারাও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে মুক্তিযুদ্ধাদের সহযোগীতায় এগিয়ে গিয়েছিলো। এ সম্প্রদায়ের নারীরা পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কাজ করতে গিয়ে পাকিস্তানী পাক হানাদার বাহিনীর বড় ধরনের পদক্ষেপের কথা জানতে পেরে মুক্তিযোদ্ধাদের জানিয়ে দিয়েছিলো। এছাড়া পাক বাহিনী কখন কোথায় অবস্থান করছে, তা মুক্তিযোদ্ধাদের জানিয়ে দেওয়ায় মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর উপর আক্রমন করে সফলতা অর্জন করেছিলো। হরিজন সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠির নারীদের সহযোগীতায় মুক্তিযোদ্ধারা অনেক পাক বাহিনীকে খতম করতে পেরেছিলো। এছাড়া নারীরা নিজেদের আশ্রয় শিবির থেকে খাদ্য সামগ্রী নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের আহারের ব্যাবস্থা করেছিলেন বলে যথেষ্ট প্রমান মিলেছে, তাদের কথার মাধ্যমে।
তাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, হরিজন নারীরা পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কাজ করতে গিয়ে জীবন বাজি রেখে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র-শস্ত্র এক স্থান থেকে অন্য স্থানে সরবরাহের কাজটুকু পর্যন্ত করেছেন। অনেক নারী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার কাজ করতে গিয়ে পাকবাহিনীর আস্তানায় গ্রেনেড ও টাইম বোমা রেখে পাকবাহিনীদেরকে হত্যা করার দায়িত্ব পালন করেছেন।
হরিজন সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠির নেতারা জানান, চাঁদপুর শহরের ৩টি হরিজন কলোনির সুন্দরী নারীদের পাকবাহিনীর হাত থেকে রক্ষা পেতে মুখে কালি মেখে অসুন্দর করে রাখা হতো। তবুও পাকবাহিনীর সেনারা তাদের গড়ি নিয়ে হরিজন কলোনিতে এসে অস্ত্রের মুখে সুন্দরী যুবতীদের নিয়ে নির্যাতন চালাতো এবং অনেক নারীকে হত্যা করেছে বলে তারা জানান। চাঁদপুর হরিজনরা পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কাজ করতে গিয়ে হাতে লাল কাপড় বেঁধে রাখতে হতো। এতে প্রমানিত হতো এরা হরিজন ও পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা কর্মী। পাকা বাহিনী এ সম্প্রদায়ের পরিস্কার পরিচ্ছন্ন কর্মীদের বাঙ্গি উপাদী দিয়েছিলো। নারীদেরকে ধরে নিয়ে গেলে হরিজন প্রান্তিক নেতারা এসব নারীদের বাঙ্গি পরিবারের সদস্য বলে ছাড়িয়ে আনতো পাকবাহিনীর ক্যাম্প থেকে। পাকবাহিনী অনেক নারীকে ওই সময়ে বাঙ্গি পরিবারের সদস্য হিসেবে ছেড়ে দিলেও তারা তাদের ইজ্জত লুন্ঠন করায় নারীরা লজ্জায় ইজ্জতের দিক চিন্তা করে এলাকা থেকে পালিয়ে কোথায় যে চলে গেছে তার কোন সন্ধান আজও পাওয়া যায় নি। তবে রাধা রাণী নামে একজন সুন্দরী যুবতি নারীকে চাঁদপুর রেলওয়ে হরিজন কলোনী থেকে তুলে নিয়ে নির্যাতন করায় তাকে স্বাধীনতার পূর্বেই হরিজন নেতারা গোপনে ভারতে নিয়ে বিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে বলে হরিজন নেতা শ্যামল দাস জানান। এ ছাড়া হরিজনা মুক্তি যুদ্বে অংশ গ্রহন করলেও আজো তারা মুক্তিযোদ্বা হতে পারেনি এবং কোন প্রকার সহযোগিতা তারা সরকারের পক্ষ থেকে পায়নি। এ সব পরিবারের লোকজন ধুঁকে ধুঁকে মরতে হচেছ।
এ ব্যাপারে কথা হয় চাঁদপুর হরিজন সমাজ উন্নয়ন সংস্থার সাধরণ সম্পাদক হিরা সরকার মুন্নার সাথে। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় সংখ্যালঘু প্রান্তিক জনগোষ্ঠির নারীরা মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার রান্না করে দিয়ে ও নিজেদের বাড়ি ঘর থেকে রান্না খাবার এনে দিয়ে সহযোগীতা করেছিলো। এছাড়া সংখ্যালঘু নারীরা মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধকালীন সময়ে তাদের বাড়ি ঘরে আশ্রয় পর্যন্ত দিয়েছিলো। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক হানাদার বাহিনী নারীদেরকে তুলে নিয়ে নিজেদের ক্যাম্পে তাদের ইজ্জত লুন্ঠন করেছিলো। তখন যাদেরকে নিয়ে নির্যাতন করেছিলো সে সব বিরঙ্গনা নারীরা মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে অংশগ্রহণ করে পাকবাহিনীর তথ্য আদান প্রদান করে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগীতা করেছিলো। এছাড়া পাকবাহিনীর অবস্থান সম্পর্কে মুক্তিযোদ্ধাদের আগাম জানিয়ে দিতো। ওইসব কর্মজীবি নারীরা স্বাধীনতার পর চাঁদপুর ডব্লিউ রহমান ও আল কায়েত জুট মেইল থেকে ৯ মাসের ভাতা পেয়েছিলো। অনেক নারী পাকবাহিনীর হাতে ধর্ষণ ও নির্যাতনের শিকার হয়। ওইসব অনেক নারী ওই নির্যাতানের লজ্জায় ও ইজ্জতের কথা চিন্তা করে আর বাড়িতে ফিরে আসেনি। মুক্তিযুদ্ধ কালীন সময়ে যে সব নারীরা নির্যাতনের শিকার হয়েছিলো তারা স্বাধীনতার পর এসব ব্যাপারে প্রতিবাদ করলেও এর প্রতিকার আজও করা হয়নি। এসব নারীরা ও তাদের পরিবার সরকারি কোন ধরনের সহযোগীতা স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত পায়নি। তবে এসব নির্যাতিত নারীদের নাম ঠিকানা জানা থাকলেও তাদের বর্তমান বেঁচে থাকার তাগিতে তাদের নাম প্রকাশ করা সম্ভব হচ্ছে না।
এ ব্যাপারে কথা হয় চাঁদপুর রেলওয়ে হরিজন কলোনীর শ্রী শ্রী রাধা কৃষ্ণ মন্দিরের সাধারণ সম্পাদক বিধান চন্দ্র দাস (জনি) এর সাথে। তিনি বলেন, চাঁদপুর প্রান্তিক হরিজন জনগোষ্ঠির নারীরা ৭১ সালে চাঁদপুর জেলার বিভিন্ন অফিস আদালতে চাকুরীরত অবস্থায় ও বিভিন্ন স্থানে নিজেদের কাজ করতেন। এরই মধ্যে যুদ্ধকালীন সময় হরিজনদেরকে একটি উপাদি দেওয়া হয়েছিলো, যার নাম ছিলো বাঙ্গি। এদের হাতে লাল ফিতা ব্যাবহার হতো। এ লাল ফিতার উপর ভর করে তৎকালিন দলিত নারীরা অনেক নিরীহ মানুষের জীবন ও ইজ্জত বাঁচাতে সক্ষম হয়েছিলো, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে। নারীরা মুক্তিযোদ্ধাদেরকে গোপন তথ্য ও খাদ্য দিয়ে সহযোগীতা করেছিলো। যুদ্ধকালীন সময়ে রেলওয়ে হরিজন কলোনীর অবস্থানটি ছিলো পাক হানাদাবাহিনীর বড় স্টেশন ক্যাম্পের খুব কাছাকাছি। তৎকালিন সময়ে প্রায় হানাদার বাহিনী রেলওয়ে হরিজন কলোনিতে প্রবেশ করতো এবং তখন প্রত্যেক নারীরা লুকান্ত অবস্থায় থাকতো। এর মধ্যে দু’ চার জনকে ইজ্জতহানী করার জন্য পাকহানাদার বাহিনী প্রকাশ্যে আক্রমন চালায় । অনেক নারীদের তারা জোর করে ধরে তাদের ক্যাম্পে নিয়ে ইজ্জত লুন্ঠন করে। ১৯৭১ সালের যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে হরিজন নারীদের নির্যাতনের চিত্র নিয়ে ও তাদের ইজ্জত লুন্ঠনের ব্যাপারে কোন প্রতিবাদ করার সুযোগ পায়নি ওই সব হরিজন নারীরা, যার ফলে তারা প্রতিবাদ করতে পারেনা। এর কোন প্রতিকার আজও স্থানীয় ভাবে তারা করার সাহস পায়নি। তাদের পরিবার ও ওই সব নারীরা সরকারী ভাবে কোন সহযোগীতা আজও পায়নি।
এ ব্যাপারে কথা হয় চাঁদপুর পুরাণ বাজার হরিজন যুব ক্লাবের সভাপতি শ্যামল দাসের সাথে। তিনি জানান, আমাদের এলাকায় রাধা রাণী সহ অনেকে যাদের নাম জানা নেই মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডাররা যখন দু’ একজন নিয়ে বৈঠক করতো তখন নারীরা সেই বৈঠকে অংশগ্রহণ করতো এবং তাদের নির্দেশ মতো সকল ধরনের সহযোগীতা করতেন তাদের কথা শুনে। রাধারাণী মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করলেও কোন ভাতা বা সম্মানি আজও পায়নি। গত ৫ বছর পূর্বে সে মারা যায়। তার স্বামী, ছেলে ও মেয়েরা আজও বেঁচে আছে। স্বামীর নাম পান্না লাল, তার বয়স প্রায় ৮০ বছর। অসুস্থ্য অবস্থায় বিনা চিকিৎসায় দিন কাটাচ্ছে। তার পরিবার মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কোন সহযোগীতা আজও পায়নি। তারা সরকারি ভাবে সহযোগীত পেতে চায়। যুদ্ধকালীন সময়ে পাকবাহিনী সংখ্যালঘু নারীদের উপর নির্যাতন ব্যাপক ভাবে চালিয়ে ছিলো। তারা হরিজন কলোনিতে প্রবেশ করে নারীদেরকে প্রকাশে গাড়িতে তুলে নিয়ে যেতো। তখন এ সম্প্রদায়ের মোড়লরা পাকবাহিনীর কাছে বাঙ্গি পরিচয় দিয়ে এদেরকে ছাড়িয়ে আনতো। পাকবাহিনী এসব সংখ্যালঘু নারীদের ইজ্জত হননের চেষ্ঠা চালাতো। তখন হরিজন মেয়েদের অভিভাবকরা তাদের মেয়েদের মুখে কালি মেখে অসুন্দর করে রাখতো। যেন পাকহানাদার বাহিনী তাদের প্রতি আকৃষ্ট না হয়। এ ভাবে তারা রক্ষা পেতো। স্বাধীনতার পর এ সম্প্রদায়ের লোকেরা নারী নির্যাতনের কোন প্রতিবাদ করেনি। এছাড়া স্থানীয় ভাবে নেতাদের মাধ্যমে কোন প্রতিকার আজও পায়নি হরিজন নারীরা। সরকারি ভাবে এ নির্যাতনের শিকার নারীরা বা তাদের পরিবার সহযোগীতা পায়নি। রেলওয়ে হরিজন কলোনিতে যুদ্ধকালীন সময় এক সুন্দরী যুবতী নারীকে জোর পূর্বক অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়। অনেক চেষ্ঠার পরে তাকে মোড়লরা ছাড়িয়ে আনতে সক্ষম হয়। পরে তাকে গোপনে ভারতে নিয়ে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। কিন্ত সকলে জানে সে নিখোজ, তার কোন সন্ধান আজও নেই।