প্রতিনিধি
চাঁদপুর শহরসহ বিভিন্ন উপজেলা শহরে একের পর এক বহুতল ভবন নির্মাণ হচ্ছে। চাঁদপুর শহরে গত কয়েক বছর ধরে বলতে গেলে বহুতল ভবন নির্মাণের হিড়িক পড়েছে। আবাসিক ভবন, বাণিজ্যিক ভবন নির্মিত হচ্ছে একের পর এক। কিন্তু এসব ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে অধিকাংশ ভবন মালিকই বিল্ডিং কোড তথা নিয়ম কানুন মানছেন না। বিশেষ করে বিল্ডিং কোডের যে একটি অংশ ‘ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সে’র আওতায় তার শর্তাবলি রক্ষা করা হচ্ছে না। অথচ ভবনের পর ভবন হচ্ছে। এ দিকে সংশ্লিষ্ট কারোরই কোনো তদারকি নেই। এতে করে জীবনের ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে। কোনো কোনো ভবন যেনো একেকটি মৃত্যু ফাঁদ। ভবন নির্মাণের সময় এবং নির্মাণের পর বসবাসের জন্যে যে ফায়ার সার্ভিসের অনাপত্তি ছাড়পত্র নিতে হয় আর এ ছাড়পত্র নেয়ার ক্ষেত্রে ভবন তৈরি করতে যে ১২টি শর্ত থাকতে হয় বাস্তবে এর কোনোটিই নেই ওইসব ভবনে। তারপরও বহুতল ভবন নির্মিত হচ্ছে একের পর এক।
চাঁদপুর শহরে গত কয়েক বছর যাবৎ হাউজিং ব্যবসা খুব জমে উঠেছে। একের পর এক বহুতল ভবন/অ্যাপার্টমেন্ট হচ্ছে। প্লট বেচা-কেনা হচ্ছে। এ ছাড়া এককভাবে মালিকানাধীন বহুতল ভবনও হচ্ছে। বিধি অনুযায়ী ছয় তলার উপরে হলেই সেটা বহুতল ভবনের আওতায়। আর চাঁদপুর শহরে এখন ১০-১৫ তলা ভবন হচ্ছে অহরহ। ছয়তলা ভবন তো কমন বিষয়। বেশ কিছু ভবন/অ্যাপার্টমেন্ট ইতিমধ্যে নির্মিত হয়ে গেছে, নির্মাণাধীন রয়েছে বেশ ক’টি। হাজীগঞ্জসহ কয়েকটি উপজেলায়ও এমন ভবন বিদ্যমান রয়েছে এবং নির্মিতও হচ্ছে। এখন দেখার বিষয়, এসব ভবন/এপার্টমেন্ট কতটুকু নিয়ম মেনে করা হচ্ছে। সরজমিনে ঘুরে দেখা গেছে যে, অধিকাংশ ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড মানা হচ্ছে না। বিশেষ করে এ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোডের একটি অংশ ‘ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সে’র অনাপত্তি ছাড়পত্র নিতে হলে যেসব শর্ত বাস্তবে থাকতে হবে তার সিংহভাগই নেই।
চাঁদপুর ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপ-সহকারী পরিচালকের কার্যালয় থেকে জানা গেছে, ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রথমে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অফিস থেকে অনাপত্তি ছাড়পত্র নিতে হয়। এরপর নির্মাণ শেষে বসবাসের জন্য আবার অনাপত্তি ছাড়পত্র নিতে হয়। প্রথমবার নির্মাণের জন্য অনাপত্তি ছাড়পত্র দেয়ার সময় ১২টি শর্ত প্রযোজ্য করে দেয়া হয়। এরপর নির্মাণ শেষে দেখা হয় ওই ১২টি শর্ত বাস্তবে বিদ্যমান আছে কিনা। তা দেখে বসবাসের জন্য অনাপত্তি ছাড়পত্র দিয়ে থাকে ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ। আরো জানা গেছে, সর্বোচ্চ ছয়তলা পর্যন্ত ভবন নির্মাণের জন্য ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স চাঁদপুর-এর উপ-সহকারী পরিচালকের কার্যালয় থেকে অনাপত্তি ছাত্রপত্র দেয়া হয়। আর এর উপরে তথা বহুতল ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে ছাড়পত্র দেয়া হয় এ সংস্থার মহাপরিচালকের দপ্তর থেকে।
ফায়ার সার্ভিস কার্যালয় থেকে অনাপত্তি ছাড়পত্র দেয়ার সময় যে ১২টি প্রস্তাবনা দেয়া হয় সেগুলো হচ্ছে : আবাসিক ভবনে ফায়ারের গাড়ি সহজে প্রবেশ ও কাজ করার সুবিধার জন্য ন্যূনপক্ষে দশ ফুট প্রশস্ত রাস্তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, ভবনের চারদিকে উন্মুক্ত জায়গা রাখা, যাতে জরুরি প্রয়োজনের সময় নির্বিঘ্নে চলাচল করা যায়, ভবনে বাধামুক্ত অগ্নি নির্বাপণের জন্য ভবনের সম্মুখে বৈদ্যুতিক ওভার হেডলাইন না থাকা, ভবনের আন্ডারগ্রাউন্ড/বেইজমেন্ট ফ্লোরে বিশ হাজার লিটারের পানির পাকা জলাধার সংরক্ষণ করা এবং অগ্নি নির্বাপণের জন্য সার্বক্ষণিক পঞ্চাশ ভাগ পানির মজুদ নিশ্চিত করা, জলাধারের মুখ ২০র্ র্ ডায়া মিটার সম্পন্ন হওয়া, অগ্নি নির্বাপণের জন্য ভবনের ছাদে একটি দশ হাজার লিটার ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন পানির পাকা জলাধার সংরক্ষণ করা এবং এতে ৫০% পানি মজুদ নিশ্চিত করা, বজ্রপাত হতে সৃষ্ট পরিস্থিতি প্রতিরোধে ছাদে লাইটিং কন্ডাস্টার স্থাপন করা, বৈদ্যুতিক মেইন সুইচ/পাওয়ার বোর্ড সিঁড়ি কোঠার নিচে থাকা, ভবনের গ্রাউন্ড ফ্লোর হতে ছাদ পর্যন্ত চার ফুট চওড়া সিঁড়ি থাকা, ভবনের প্রতি ফ্লোরে ৫৫০ বর্গফুটের জন্য পাঁচ কেজি ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন একটি এবিসি ড্রাই কেমিক্যাল পাউডার এক্সটিংগুইসার সংরক্ষণ করা এবং এর ব্যবহার বিধি লিখে রাখা, প্রতিটি রান্না ঘরের সামনে একটি ও ভেতরে একটি করে পাঁচ কেজি ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন এবিসি ড্রাই কেমিক্যাল পাউডার এক্সটিংগুইসার সংরক্ষণ করা। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে যে, ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষের এসব প্রস্তাবনার অধিকাংশই রক্ষা করা হয় না। অথচ ভবন হয়ে যাচ্ছে এবং ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষের অনাপত্তি ছাড়পত্র পেয়ে যাচ্ছে। বাস্তবে দেখা গেছে যে, ভবনগুলো এমনভাবে নির্মাণ করা হচ্ছে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি যাওয়ার রাস্তা নেই, আশপাশে কোনো জলাশয় নেই, ভবনে প্রয়োজনীয় জলাধার নেই এবং ভবনের সিঁড়িও থাকে খুব সঙ্কুচিত। ভবন করার ক্ষেত্রে এতোসব অনিয়ম কেউই দেখছে না। সরকারি কোনো সংস্থা বা ভবন করার জন্য অনুমোদন নিতে হয় এমন সংস্থারও কোনো তৎপরতা লক্ষ্য করা যায় না। ফলে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই বহুতল ভবনের পর ভবন নির্মিত হচ্ছে। এতে করে মানুষের জীবন ও সম্পদ ঝুঁকির মধ্যে থেকে যায়।