এম. আর. ইসলাম বাবু
প্রশাসনের নজরদারী থাকা সত্ত্বেও চাাঁদপুর মা ইলিশ নিধনে, ক্রয়-বিক্রয়ে চলছে মহোৎসব! কে কতো কম দামে ক্রয় করতে পেরেছে ইলিশ। চাঁদপুর সদর থেকে শুরু করে হাইমচর পর্যন্ত বিস্তির্ণ এলাকার নদী তীরের ঘাট, মাঠ, বাগান, জঙ্গল সকল স্থানে অবাধে মা ইলিশ-ক্রেতা ও বিক্রেতাদের ছড়াছড়ি। মা ইলিশ রক্ষা অভিযানে লাগামহীন ঘোড়ার মতো চলছে ইলিশ নিধন। নদীতে টহল নেই বল্লেই চলে। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে হাজার হাজার জেলেরা নৌকা, ইঞ্জিন চালিত ছোট ট্রলার যোগে দিন-রাত ব্যাস্ত ইলিশ ধংশে। শুধু চাঁদপুর নয় আশে পাশের জেলায় এখন সকলেই জানে চাঁদপুরে নদী তীরবর্তি অঞ্চলে সস্তা দরে বিক্রি হচ্ছে ইলিশের হালি। প্রজননের এ মৌসুমে প্রতি মুহুর্তে লক্ষ লক্ষ মণ ডিম ওয়ালা ইলিশ ক্রয় বিক্রয় চলছে।
খবর নিয়ে জানা যায়, দেশের সম্পদ বিনষ্ট ও রাষ্ট্র বিরোধী এ কাজে সরাসরি জড়িত রয়েছে জেলে, দাদনদার, আড়ৎদার ও দালালরা।
অভিযোগ রয়েছে জেলেরা নদীতে মাছ ধরার সময় প্রশাসনের নাম ভাঙ্গিয়ে এক দল স্পীড বোর্ড বা ট্রলারে করে নদীতে নামে সন্ধ্যার পর থেকে। তারা জেলেদের কাছে গিয়ে বিভিন্ন দপ্তরের নাম ভাঙ্গিয়ে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। মাছ বিভিন্ন ঘাট দিয়ে উপরে উঠানোর জন্য স্থানিয় পাতি নেতা দালাল রয়েছে। তারা বিভিন্ন সেক্টর ম্যানেজ করে বড় ধরনের চালান পরিবহনের মাধ্যমে নানা জায়গায় পাঠাচ্ছে। প্রশাসনের যেসব সেক্টরে সুবিধা আদায় করতে পারেনি তারা খবর পেলে পথে মাছ আটক করে নগদ অর্থ বা মাছের বিণিময়ে নিজেদের স্বার্থ হাছিল করে।
যদি কোন ক্রেতা, বিক্রেতা বা আড়ৎদার উক্ত দালালদের সাথে সম্পর্ক ত্রুটি ঘটায় তাহলেই কেল্লাফতে। প্রশাসনের মাধ্যমে আটক হয় মাছের চালান। সকল আইন উপেক্ষা করে রোগী বহনকারী এম্বুল্যান্স, পিকাপ ভ্যান, সিএনজী, অটো, রিক্সা, সহ বিভিন্ন কায়দায় ইলিশ ভোগের জন্য ক্রেতা-বিক্রেতাদের দৌরাত্ম দেখা যায়। উল্লেখিত এসব যানবাহনে করে মাছ নিয়ে যাওয়ার পথে বেশির ভাগ সময়ে টহল পুলিশ, পাতি মাস্তান, ডিবি সহ বিভিন্ন পর্যায়ে থামিয়ে জেল জড়িমানার ভয় দেখিয়ে মাছ রেখে ক্রেতাদের ছেড়ে দিলেও সেই মাছ প্রশাসনের দৃষ্টিতে আর না এসে রাতেই ভাগ বাটোয়ারা হয়ে যায়। জেলেরা জাতীয় সম্পদ ইলিশ রক্ষায় প্রজনন মৌসুমে ৫ অক্টোবর থেকে ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত পদ্মা-মেঘনার প্রজনন ক্ষেত্র এলাকায় সকল ধরনের মাছ নিধন নিষিদ্ধ করেছে সরকার। এই সময় ইলিশসহ যে কোন ধরনের মাছ নিধন, পরিবহন, মওজুদ ও বিক্রয় বন্ধ থাকবে। কিন্তু চাঁদপুরের মতলব উত্তরের ষাটনল থেকে শুরু করে দক্ষিণে লক্ষীপুরের চর আলেকজেন্ডার পর্যন্ত ১শ’ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে এখন চলছে মা ইলিশ নিধনের মহোৎসব। প্রকাশ্যে দিন ও রাতে কারেন্ট ও গুল্টিজালে মা ইলিশ হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে জেলেরা। অল্প সংখ্যক লোকবল দিয়ে জেলেদের নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব হয়ে পড়েছে জেলা টাস্কফোর্সের। তারপরও প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২৪ঘন্টা অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
চাঁদপুর সদর উপজেলার বিষ্ণুপুর, তরপুরচন্ডী, চাঁদপুর পৌরসভা, ইব্রাহীমপুর, লক্ষ্মীপুর মডেল ও হানারচর ইউনিয়নের মেঘনা নদীর তীরবর্তী এলাকা ঘুরে দেখা গেছে প্রতিটি জেলে পাড়ার নৌকা নিয়ে জেলেরা মা ইলিশ নিধন করছে। ৫ তারিখের পূর্বে ইলিশের দেখা তেমনভাবে না মিললেও এখন নদীতে জাল ফেললেই অসংখ্য ছোট বড় ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। এতে করে অনেক জেলে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলেও মাছের আমদানি দেখে তারাও উৎসাহিত হয়ে নদীতে নামছে।
চাঁদপুর নদী কেন্দ্রের একাধিক ইলিশ গবেষক জানিয়েছেন, পুর্ণিমার আগে ও পরে ১১দিন অভিযান থাকার কারণে দক্ষিনাঞ্চলের জেলেরা মাছ ধরা থেকে বিরত থাকে। নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে ডিম ছাড়ার জন্য সাগর থেকে মা ইলিশগুলো মিঠা পানিতে আসে। আর এই সুযোগে জেলেরা মা ইলিশ নিধন শুরু করে।
গত ৫ অক্টোবর থেকে ইলিশের অনেক আড়ৎ বন্ধ হলেও শুরু হয়েছে ভাসমান আড়তে বেচা বিক্রি। প্রকাশ্যে দিনের বেলায় হরিন ফেরীঘাট, বহরীয়া বাজার, দোকান ঘর এলাকা, আনন্দ বাজার, আখনের হাট মৎস্য আড়তে মা ইলিশ বিক্রি হচ্ছে। এছাড়াও মেঘনার পশ্চিম পাড়ে আলুর বাজার, রাজরাজেশ্বর, ইশানবালা ইত্যাদি চরকে নিরাপদ মনে করে অনেক জেলে সেখানে লাখ লাখ টাকার মাছ বিক্রি করছে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত হাজার হাজার জেলে এখন পদ্মা-মেঘনায় ইলিশ নিধন করছে। ইলিশ প্রকাশ্যে আড়তে বিক্রি না হলেও জনসচেতনতা না থাকার কারণে প্রতিদিন শহর ও গ্রামাঞ্চল থেকে শত শত মানুষ জেলে ও ভাসমান আড়তে এসে ক্রয় করছে।
হরিণা ঘাট এলাকার জেলে মিজানুর, নজরুল, ইলিয়াছ ও আখনের হাট এলাকার জেলে কামাল, রহিম বেপারী, তাজু মন্সুী জানায়, “অভিযানের পুর্বে আমরা তেমন কোন ইলিশ পাইনি। দক্ষিনাঞ্চলে ইলিশ ধরা বন্ধ হওয়ায় এখন পদ্মা-মেঘনায় প্রচুর পরিমানে ইলিশ ধরা পড়ছে। দাদনদারদের ঋন পরিশোধ করার জন্য বাধ্য হয়ে আমাদের মাছ ধরতে হয়। একেক নৌকার জেলেরা এখন প্রতিদিন ৪০/৫০ হাজার টাকার ইলিশ বিক্রি করছে।”
অভিজ্ঞ মহল মনে করেন হাজার হাজার কোটি টাকার জাতীয় সম্পদ মা ইলিশ রক্ষার জন্য সরকারকে বিকল্প পদ্ধতী গ্রহন করতে হবে। সরকার প্রশাসনের পক্ষে অ-সম্ভব বলতে কিছু নেই। প্রয়োজনে যেসব ঘাটগুলো দিয়ে মাছ ধরা, ক্রয়-বিক্রয় করা হয় সেখানে অতিরিক্ত পুলিশ, নৌ পুলিশ সহ বিভিন্ন বাহিনীর লোকদের কাজে লাগানো যেতে পারে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নৌ বাহিনী, কোষ্ট গার্ড সহ অন্যান্যদের পর্যাপ্ত পরিমান লোকবল নিয়ে স্বচ্ছতার সাথে অভিযান পরিচালনা করতে হবে। সার্বক্ষনিক ভাসমান তাবু করে অভিযান পরিচালনা করতে হবে। আইন আরো কঠোর করে আইনের প্রয়োগ করলে রাষ্ট্র লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সুযোগ পাবে। আর আমাদের জাতীয় ইলিশ রক্ষা পাবে।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. সফিকুর রহমান জানান, জেলেদের নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। ইতোমধ্যে কয়েকজনের সাজা হয়েছে। জনসচেতনতার অভাবে মা ইলিশ নিধন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ আনা সম্ভব হচ্ছে না। সাধারণ মানুষ সচেতন না হলে, মা ইলিশ ক্রয় থেকে বিরত না থাকলে এই ধরনের অভিযান সফল করা সম্ভব নয়।
শিরোনাম:
শনিবার , ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ , ২৩ ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।