মিজান লিটন–
চাঁদপুরে দীর্ঘদিন যাবৎ এক শ্রেণীর অসাধু ডাক্তার কৌশলে রোগীদের সাথে প্রতারণা করে যাচ্ছে। তারা তাদের মেডিকেল কলেজের মূল শিক্ষাবর্ষ এমবিবিএস পাস করার পর কয়েকটি রোগের বিষয়ে স্পেশাল কোর্স সম্পন্ন করার জন্য ভর্তি হয়ে এটি সম্পন্ন না করেই তারা তাদের প্র্যাকটিস বা কর্মজীবনে এসে রোগীদেরকে আকৃষ্ট করার জন্য বিভিন্ন পদ-পদবী ব্যবহার করছে। এমন অভিযোগ দীর্ঘদিন ধরে চলে আসলেও দেশের আইনগত জটিলতার কারণে এদের বিরুদ্ধে আইনগত কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাচ্ছে না।
জানা যায়, একজন ছেলে বা মেয়ে বিজ্ঞান বিভাগে এইচএসসি পাস করার পরে যখন স্বপ্ন দেখে ডাক্তার হয়ে জনগণের সেবা করবে সেটিকে পূরণ করতে গিয়ে দেশের সরকারি অথবা বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়। আবার কেউ কেউ অর্থশালী হওয়ার কারণে বিদেশে গিয়েও মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়ে এমবিবিএস পাস করেন। সাধারণতঃ এমবিবিএস পাস করার পর কোন ডাক্তার তাকে তার বাকী কর্মজীবনের জন্য এক বছরের ইন্টার্নি অর্থ্যাৎ, পুরোপুরিভাবে হাতে-কলমে শিক্ষা নেয়ার জন্য ইন্টার্নি করতে হয়। এরপর প্রত্যেকে প্রত্যেকের নিজস্ব সুবিধামত স্থানে বা নিজস্ব প্রয়োজন অনুসারে কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। যাকে বলে তার শিক্ষা শেষে ডাক্তারি জীবনের শুরু করা। এ ক্ষেত্রে কোন কোন এমবিবিএস পাসকৃত ডাক্তারগণ মানুষের কিছু কিছু রোগের স্পেশাল অভিজ্ঞতার জন্য বিভিন্ন কোর্সে ভর্তি হন। এ ক্ষেত্রে তার কর্মজীবনের অভিজ্ঞতা বাড়ে এবং রোগ সম্পর্কে তার ধারণা আরো উন্নত হয়। যেমনÑ অনেকেই এফসিপিএস, পিজিটি (গাইন ও অবস্) অর্থ্যাৎ, তিনি মাতৃত্বকালীন মায়েদের বিষয়ে স্পেশাল একটি কোর্স করা আর অবস্ হচ্ছে কোন রোগীর অপারেশনের পূর্বে ঐ স্থান অবশ করার বিষয়। সিএমইউ (সনোলজিস্ট) অর্থ্যাৎ, রোগীর আল্ট্রাসনোগ্রাম বা এক্স-রে বিষয়ে অতিরিক্ত জানা। এভাবেই ডাক্তারদের মেডিসিন নিউরোলজি, কার্ডিওলজি, বক্ষব্যধি, বাতব্যথা, হৃদরোগ, ডায়াবেটিকস, চর্ম, যৌন ইত্যাদি বিষয়ে অতিরিক্ত কোর্স রয়েছে।
অধিকাংশ ডাক্তারগণই কর্মজীবনে প্রবেশ করেই পাশাপাশি এসকল বিষয়গুলো সম্পন্ন করে থাকেন। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে সাধারণত অনেক ডাক্তার রয়েছেন যারা ভর্তি হয়ে এসকল কোর্সগুলো সম্পন্ন করেন না। আবার অনেকেই এগুলোতো সম্পন্ন করেন পাশাপাশি দেশের বাহিরে গিয়েও উন্নত দেশগুলো থেকে বিভিন্ন ধরনের আধুনিক পদ্ধতির উপর প্রশিক্ষণ নিয়ে আসেন। এতে করে আমাদের দেশের গরীব রোগীরা সাধারণত যাদের অর্থনৈতিক অবস্থান ভালো না তারা দেশে চিকিৎসা নিতে পারেন।
দেখা যায়, বর্তমান আধুনিকতার যুগে আমাদের দেশে মেধাবী এই সন্তানরা ডাক্তারি বিষয়ে পাস করে উল্লেখিত কোর্সগুলোতে ভর্তি হয়ে রোগীদেরকে আকৃষ্ট করার জন্য নামের পরে বিভিন্ন ধরনের বাহারি পদ-পদবী লাগিয়ে নিজেদের জাহির করছে। তারা তাদের চেম্বারের সাইনবোর্ড প্রচারপত্র ও ভিজিটিং কার্ডে বিভিন্ন ধরনের যেমন, ডি.সি.এইচ. (অনকোর্স) এম.এস (কোর্স) এফ.সি.পি.এস (শিশু) পার্ট-২ নাক, কান, গলা পার্ট-২, ১ম বর্ষ, পার্ট-১, শেষ বর্ষ ইত্যাদি বিশেষণ লাগিয়ে তার নামের পরে বিশাল সাইনবোর্ড, ব্যানার, ভিজিটিং কার্ড ভারী করেন। আর এতে করে আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ মনে করেন, নামের পিছনে অনেক লেখা দেখে মনে করেন তিনি মনে হয় সবচেয়ে বড় ডাক্তার। তার কাছে গিয়ে চিকিৎসা নিলে তাড়াতাড়ি সুস্থ্য হওয়া যাবে। আর ঐ ডাক্তারের দালালগণ বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করে তার চেম্বারে রোগী ভিড় করান। রাতারাতি এসকল ডাক্তাররা কোটিপতি বা গাড়ি-বাড়ি মালিক হওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে নামের পরে অনেক পদ-পদবী ব্যবহার করে তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেন। অথচ একই দেশের নাগরিক হয়ে অপরকে প্রতারিত করছেন।
বেশ কয়জন সিনিয়র ডাক্তারদের সাথে আলোচনা করে জানা যায়, যে সকল বিষয়ের পর পার্ট-১ লেখা আছে সেটি হচ্ছে তিনি মাত্র যে বিষয়ে ভর্তি হয়ে এ বিষটির ১ম পর্ব শেষ করেছেন। একই ভাবে পার্ট-২, পার্ট-৩ এগুলো বুঝায়। কোর্স-এটির অর্থ হচ্ছে যে লেখাটির পাশে ব্রেকেট দিয়ে লেখা রয়েছে সে বিষয়ে মাত্র তিনি কোর্স শুরু করেছেন। অনকোর্স নামক লেখাটি দ্বারাও একই অর্থ বুঝায়; অর্থ্যাৎ, তিনি এটি মাত্র শুরু করেছেন। অথচ এসকল লেখার মধ্য দিয়ে সাধারণ জনগণ ভদ্রবেশি উচ্চ শিক্ষিত এ ধরনের ব্যক্তিদের দ্বারা প্রতারিত হলেও এ যেনো কেউ দেখার নেই।
বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক স্বাস্থ্য বিষয়ক নীতিমালা থাকলেও এ সকল প্রতারকদের বিরুদ্ধে আইনগত কোন ব্যবস্থা নেয়ার জন্য আইন পাস করার হয়নি। তবে দীর্ঘদিন যাবৎ এ সকল অভিযোগের কারণে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহা-পরিচালক এ সংক্রান্ত একটি নোটিশ জারি করেছেন যেনো এ ধরণের কোর্স, অনকোর্স, পার্ট-১, ২, ৩ ইত্যাদি লেখা না হয়। তারপরও আইন না থাকার কারণে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের নির্দেশকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে হরদমে এ সকল লেখাগুলো চালিয়ে যাচ্ছেন এক শ্রেণীর অসাধু চিকিৎসক।
এ বিষয়ে চাঁদপুর জেলা বিএমএর সাধারণ সম্পাদক ডাঃ মাহমুদুন্নবী মাসুমের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমরা আজ থেকে ২-৩ বছর পূর্বে এ বিষয়ে জেলা বিএমএর পক্ষ থেকে এ সংক্রান্ত বিষয়ে একটি চিঠি দেয়া হয়েছে। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে যে, সকল ডাক্তারগণ তাদের সাইনবোর্ডে বা প্রচার প্রচারণায় উল্লেখিত শব্দগুলো ব্যবহার করছেন। সেগুলো যেনো মুছে ফেলা হয়। এগুলো যেনো ব্যবহার না করা হয়। তারপরও এগুলো প্রতিনিয়তই চলছে। আইন না থাকায় কোন ব্যবস্থা নেয়া যাচ্ছে না। বিষয়টি নিয়ে সিভিল সার্জনের সাথে মুঠোফোনে কথা হলে তিনি বলেন, আইন যদি না থাকে তাহলে মুখের কথা কেউই শুনে না। ভাই আমাদের দেশে অধিকাংশ বিষয়গুলো নিয়ে আইন থাকা সত্বেও সেগুলো মানা হচ্ছে না। তিনি এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, দেশের আইন মোতাবেক আমি স্বাস্থ্য বিভাগের একজন কর্মকর্তা হিসেবে শুধুমাত্র আমার অধীনস্থ কোন কর্মকর্তা চিকিৎসা সেবার ক্ষেত্রে অনিয়ম করলে তার বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে লিখতে পারি। এ বাহিরে আর কোন ক্ষমতা নাই। তবে আমি মনে করি নৈতিকতার ক্ষেত্রে এ ধরণের ভূয়া বা প্রতারণার আশ্রয় ঠিক না।
সর্বোপরি দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষিত ও সুধীজন খ্যাত ভদ্রবেশি এ সকল ব্যক্তিরা এ ধরণের অন্যায় থেকে বের হয়ে সঠিকতার পথে চললে দেশ ও জাতির আগামী প্রজন্ম দেশের উন্নয়নে এবং নৈতিকতা বিষয়ে এদের মনে রাখবেন।
চাঁদপুর নিউজ সংবাদ