চাঁদপুর প্রতিনিধি :ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ থেকে চাঁদপুর পর্যন্ত নৌ-পথে ১ যুগে ১২টি লঞ্চ দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। মেঘনা, শীতলক্ষ্যা ও ডাকাতিয়া নদীতে ১২ বছরে এমভি রাজহংস, এমভি সালাউদ্দিন, এমভি অমিত এক্সপ্রেস, এমভি নাসরিন, এমভি লাইটিং সান, এমভি দিগন্ত, এমভি মহারাজ, এমএল মজলিশপুর, এমএল শাহ্পরান, এমভি মদিনার আলো, এমভি শরীয়তপুর ও এমএল সারস লঞ্চ ডুবিতে ২ সহস্রাধিক লোকের প্রাণহানি ঘটেছে। এছাড়া বাল্কহেডের সাথে সংঘর্ষে অল্পের জন্য বেঁচে যায় আল-বোরাক ও এমভি সোহাগ লঞ্চের ১১শ’ যাত্রী।
২০০০ সালের ২৯ ডিসেম্বর ঈদুল আযহার রাতে ঢাকা থেকে মতলবের উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসা এমভি রাজহংসের সাথে ঢাকা-বরিশালগামী এমভি জলকপোত লঞ্চের সংঘর্ষ হলে মেঘনা নদীর মতলব উত্তরের ষাটনল স্থানে লঞ্চটি ডুবে যায়। এতে মতলব উত্তর ও দক্ষিণ উপজেলাসহ অন্যান্য এলাকার ১শ’ ৬২ জনের প্রাণহানি ঘটে। ২০০২ সালের ৪ এপ্রিল রাত সাড়ে নয়টায় এমভি সালাউদ্দিন-২ নামক তিন তলা লঞ্চটি ঢাকা থেকে ভোলার উদ্দেশ্যে ছেড়ে গিয়ে মেঘনা নদীর মতলব উত্তরের ষাটনল স্থানে কালবৈশাখী ঝড়ের কবলে পড়ে ডুবে যায়। এতে ৫ শতাধিক যাত্রীর মধ্যে ৩শ’ ৬৩ জন প্রাণ হারায়। এদের মধ্যে বেশির ভাগ যাত্রী ছিলো ভোলা ও পটুয়াখালীর। অনেকের লাশ শনাক্ত করতে না পারায় ষাটনল পর্যটন কেন্দ্রের পাশে গণকবর দেয়া হয়।
২০০৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় পারিবারিক নৌ-বিহারে আসা এমভি অমিত এঙ্প্রেস মেঘনা নদীর মতলব উত্তরের আমিরাবাদ এলাকায় হঠাৎ ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ে ডুবে যায়। এতে ২৯ জন যাত্রীর মধ্যে ১১ জন মৃত্যুবরণ করেন। ২০০৩ সালের ৮ জুলাই ঢাকা থেকে লালমোহনের উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসা এমভি নাসরিন অতিরিক্ত যাত্রী ও মাল বোঝাইয়ের কারণে চাঁদপুরে মেঘনা ও ডাকাতিয়া নদীর মিলনস্থলে ডুবে যায়। এতে ১ হাজার ৫শ’ যাত্রীর মধ্যে ১শ’ ২৮ পরিবারের ৮শ’ লোক মারা যায়।
২০০৪ সালের ২২ মে এমভি লাইটিং সান ও এমভি দিগন্ত নামে দুটি লঞ্চ মেঘনা নদীর চাঁদপুরের আনন্দ বাজার স্থানে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে ডুবে যায়। এতে এমভি লাইটিং সানের ৮১ জন ও এমভি দিগন্তের প্রায় ১শ’ জন লোক প্রাণ হারায়। ২০০৪ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি রাতে ঢাকা থেকে মতলবের উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসা এমভি মহারাজ লঞ্চটি মেঘনা ও শীতলক্ষ্যার মিলনস্থানে অপর একটি লঞ্চের ধাক্কায় ডুবে যায়। এতে ২৫০ জন যাত্রীর মধ্যে প্রায় ১শ’ ৫০ জনের মৃত্যু হয়। নিহতদের মধ্যে সবই ছিল মতলব উত্তর এবং দক্ষিণ উপজেলার।
২০০৪ সালের ১২ মে মেঘনা নদীর ভৈরবে এমএল মজলিশপুর লঞ্চটি দেড় শতাধিক যাত্রী নিয়ে ডুবে যায়। এদের মধ্যে ৯০ জনের মৃত্যু হয়েছে। ২০০৬ সালের মেঘনা নদীর মেঘনা সেতুর নিকটবর্তী স্থানে এমএল শাহ্পরান নামে একটি লঞ্চ কালবৈশাখী ঝড়ের কবলে পড়ে ডুবে যায়। এতে ১৯ জন যাত্রী প্রাণ হারায়। ২০১১ সালের ৬ জুলাই বুধবার সন্ধ্যায় শীতলক্ষ্যা ও মেঘনার মিলনস্থানে মুন্সিগঞ্জের চরমুক্তাপুর স্থানে তেলবাহী কার্গোর সাথে ধাক্কা খেয়ে এমভি মদিনার আলো লঞ্চটি শতাধিক যাত্রী নিয়ে ডুবে যায়। এদের মধ্যে প্রায় অর্ধশত লোকের মৃত্যু ঘটে। ২০১২ সালের ১২ মার্চ রাত ২টার সময় ঢাকা থেকে শরীয়তপুর যাওয়ার পথে মেঘনা নদীর মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায় একটি কার্গোর সাথে ধাক্কা খেয়ে এমভি শরীয়তপুর-১ লঞ্চটি ৩ শতাধিক যাত্রী নিয়ে ডুবে যায়। এর মধ্যে ১ শতাধিক যাত্রীর মৃত্যু হয়েছে।
২০১৩ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার সকালে নারায়ণগঞ্জ-মতলব মাছুয়াখালগামী এমএল সারস লঞ্চটি নারায়ণগঞ্জ থেকে ছেড়ে সকাল পৌনে ৮টার দিকে মেঘনা নদীর মুন্সিগঞ্জের ইস্পাহানিরচর নামক স্থানে বালুবাহী কার্গোর সাথে ধাক্কা খেয়ে শতাধিক যাত্রী নিয়ে ডুবে যায়। এতে অর্ধ শতাধিক লোকের মৃত্যু ঘটে। ১৮ জনের লাশ পেলেও নিখোঁজ রয়েছে আরো অনেকে। এছাড়া ২০১২ সালের ২৮ এপ্রিল চাঁদপুর থেকে ঢাকাগামী লঞ্চ আল-বোরাক মেঘনা নদীর মতলব উত্তর উপজেলার ষাটনল লঞ্চঘাটের অদূরে মুন্সিগঞ্জের সীমানায় বালুবাহী ডুবন্ত বাল্কহেডের সঙ্গে আটকে যায় এবং আল-বোরাক লঞ্চের তলা ফেটে যায়। লঞ্চের যাত্রীদের চিৎকার শুনে আশপাশে থাকা লঞ্চ ও ট্রলার যাত্রী উদ্ধার করে। লঞ্চে থাকা ৬ শতাধিক যাত্রী প্রাণে রক্ষা পায়। ২৯ এপ্রিল বাউফল পাতাবুনিয়া থেকে ঢাকাগামী লঞ্চ এমভি সোহাগ মেঘনা নদীর মতলব উত্তর উপজেলার ষাটনল লঞ্চঘাটের অদূরে মুন্সিগঞ্জের সীমানায় বালুবাহী ডুবন্ত বাল্কহেডের সাথে আটকে যায় এবং লঞ্চের তলা ফুটা হয়ে পানি উঠে বাল্কহেডের ওপর দেবে যায়। আল-বোরাক লঞ্চটি উদ্ধারের আধা ঘণ্টা পর একই ডুবন্ত বাল্কহেডের ওপর সোহাগ লঞ্চটি আটকা পড়ে। জানা যায়, বাউফল পাতাবুনিয়া থেকে এমভি সোহাগ লঞ্চটি ৫ শতাধিক যাত্রী নিয়ে ঢাকা যাচ্ছিল। দুর্ঘটনার পর বরিশাল থেকে আসা লঞ্চ সোহাগ লঞ্চের যাত্রীদের উদ্ধার করে ঢাকা নিয়ে যায়। সকল যাত্রী প্রাণে বেঁচে যায়।
নদী পথে নিয়ম নীতি মেনে না চলায় প্রতি বছরই ঘটছে এমন নৌ দুর্ঘটনা। মেঘনা নদীর মোহনায় ব্যারিকেড সৃষ্টি করে একটি মহল অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করছে। নদীতে এলোপাতাড়িভাবে বাল্কহেড ও ড্রেজার চলাচল ও রাখায় দেশের প্রধান নৌ-রুটটির এ স্থানটিতে নৌযান চলাচলে মারাত্মক হুমকি দেখা দিয়েছে। এছাড়া দুর্ঘটনার পর উদ্ধার কাজের জন্য প্রয়োজন অনুযায়ী সরঞ্জামাদি ও জনবল না থাকায়, গাফলতির কারণে প্রাণহানি ও সলিল সমাধির সংখ্যা বাড়ছে।