শওকতআলী,
চাঁদপুরে ৩০০ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি আধুনিক নৌ- টার্মিনাল নিমার্ণে উদ্যোগ সরকার গ্রহন করেছে। এ কাজের জন্য ইতি মধ্যে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নপুষ্ট প্রকল্প থেকে সরকার ৬৬ কোটি টাকা ছাড় দিয়েছে।
চাঁদপুর নৌ টার্মিনাল ডাকাতিয়া নদীর তীরেই থাকবে, নাকি মেঘনার তীরে হবে এ নিয়ে চলছিলো বিতর্ক, কালক্ষেপন। নৌ-মন্ত্রণালয় বিতর্ক অবসানে প্রয়াসও চালায়। অবশেষে মেঘনার তীরেই চাঁদপুর আধুনিক নৌ-টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদন পেয়েছে।
২০০১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর আকস্মিক ডাকাতিয়ার ভাঙ্গনে রেল স্টেশন, স্টিমার ঘাট ও লঞ্চ টার্মিনাল বিলীন হয়ে যায়। ‘৯৬ সালের ১২ সেপ্টেম্বর মেঘনা নদীর তীরে চালু হয় বিকল্প লঞ্চ টার্মিনাল। প্রায় ৩০০ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি আধুনিক টার্মিনাল নিমার্ণে উদ্যোগী হয় সরকার। কিন্তু চাঁদপুর চেম্বার অব কমার্সসহ কিছু সংখ্যক ব্যবসায়ীর চাপের মুখে পড়ে। দফায় দফায় মন্ত্রী, এমপি, সচিব, কর্মকর্তাদের চলতে থাকে মতবিনিময় ও বিতর্ক। অবশেষে সরকার চাঁদপুরে আধুনিক লঞ্চ টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্পের মূল কাজ মেঘনা নদীর তীরে বাস্তবায়নের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
বিআইডব্লিউটিএ চাঁদপুর কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম জানান, আধুনিক নৌ-টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্পের প্রাথমিক কাজে সরকার ৬৬ কোটি টাকা ছাড় দিয়েছে। কনসালটেন্ট নিয়োগ, ভূমি অধিগ্রহণসহ আনুষঙ্গিক কাজ সম্পাদক করা হবে। মূল প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয়ের পরিমাণ ৩০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে।
মেঘনা তীরের বর্তমান লঞ্চ টার্মিনালের আওতায় রয়েছে ১.৯ একর জায়গা। এখানে চাঁদপুর আধুনিক নৌ-টার্মিনাল প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে আরো প্রায় দেড় একর ভূমি অধিগ্রহণ করা হবে। শহর থেকে এ টার্মিনাল অভিমুখে রাস্তা নির্মাণ করা হবে। নির্বাহী প্রকৌশলী আরো জানান, ২০১৮ সালের প্রথম ভাগে চাঁদপুর আধুনিক নৌ-টার্মিনালের মূল প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
শহরের পশ্চিম প্রান্তে মেঘনা ও ডাকাতিয়া নদীর পাড়ে চাঁদপুর নদী বন্দরের এক পাশে ছিল রেল স্টেশন অপর পাশে স্টিমার ঘাট। পাক-ভারত যুদ্ধের আগে ভারতের আসাম প্রদেশের লোকজন পশ্চিমবঙ্গ যেতে চাঁদপুরকেই ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করতো। এ কারনে চাঁদপুরকে বলা হতো আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের গেটওয়ে বা প্রবেশদ্বার। পশ্চিমবঙ্গের লোকজন ট্রেনযোগে গোয়ালন্দ এসে স্টিমারে চড়ে চাঁদপুর আসতো। তারপর চাঁদপুর থেকে ট্রেনযোগে আসাম যেতো। এভাবে আসামের লোকজন চাঁদপুর এসে স্টিমারে চড়ে গোয়ালন্দ হয়ে পশ্চিমবঙ্গে যেতো।
দেশের দক্ষিণাঞ্চল বিশেষ করে খুলনা ও বরিশাল বিভাগের লোকজন এবং ঢাকা বিভাগের শরীয়তপুর, মাদারীপুরসহ সন্নিহত অঞ্চলের লোকজন পূর্বাঞ্চলের চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগে যাতায়াতে চাঁদপুরকে ট্রানজিট হিসেবে সুদূর অতীত থেকে ব্যবহার করে আসছিলো। দেশের পূর্বাঞ্চলের লোকজন দক্ষিণাঞ্চলে যেতে রেল ও সড়কযোগে চাঁদপুর এসে লঞ্চ-স্টিমারে স্বল্প খরচে দক্ষিণাঞ্চল যাতায়াতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে।
১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের পর এ দুটি দেশের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। চাঁদপুর হয়ে আসাম ও পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে সংক্ষিপ্ত যাতায়াত ব্যবস্থা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। ফলশ্রুতিতে চাঁদপুর নদী বন্দরের ব্যস্ততা ও প্রাণচাঞ্চল্য অনেকটা থমকে যায়। আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে নব্বইর দশক পর্যন্ত দেশের সড়ক খাতে বৈপ্লবিক উন্নতি সাধিত হওয়ায় নৌ-পরিবহনে ভাটা পড়ে। ঐ সময়টাতে লোকজন সড়কে যাতায়াতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। নদী পথে যাত্রী সংকটও সৃষ্টি হয়। নৌ-পথে জরাজীর্ণ স্টিমারে যাতায়াতে বহুবিধ বিড়ম্বনা ও নিরাপত্তাহীনতা এবং নি¤œমানের লঞ্চযোগে যাতায়াতে জীবনহানিসহ নানাবিধ ছোটখাট ঘটনায় যাত্রীরা নৌ-পথ বিমুখ হয়ে পড়ে। বিশেষ করে বার বার লঞ্চডুবির ঘটনায় ব্যাপক প্রাণহানিতে নৌ-পথে যাতায়াতে ঝুঁকি ও আতঙ্কের সৃষ্টি হয়।
নব্বইর দশকের মাঝামাঝি সময়ে চাঁদপুর-ঢাকা, ঢাকা-চাঁদপুর-বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন রূটে আধুনিকমানের লঞ্চ সার্ভিস প্রবর্তন হয়। যাত্রীদের সামর্থ্য বাড়ায় লঞ্চগুলোতে যুক্ত হতে থাকে ফ্যান, এসি ও টিভিসহ বিলাসবহুল কেবিন। চাঁদপুর-ঢাকা রূটের লঞ্চগুলোতে বিমানের সীটের মতো আরামদায়ক সীটসহ প্রথম, দ্বিতীয় ও ৩য় শ্রেণী সংযোজন করা হয়। কেন্টিন, টয়লেট, নামাজের জায়গা এবং ছাদে ছাতার নিচে বসে আড্ডার ব্যবস্থাসহ ছায়াছবি দেখার সুব্যবস্থা করা হয়। লঞ্চগুলোর কাঠামোতে বিমানের আঙ্গিক, পাখির অবয়বসহ আকর্ষণীয় বিভিন্ন অবয়ব, ফুলের টব, বিভিন্ন কারুকাজ ও ব্যাপক আলোকসজ্জায় লঞ্চগুলোকে আধুনিক থেকে আধুনিকতর করা হয়। এক সময়ে চাঁদপুর-ঢাকা যাতায়াতে ৪-৬ ঘন্টা সময় লাগতো, এখন মাত্র ৩ ঘন্টায় নেমে এসেছে। খেয়ে-দেয়ে, গান শুনে, ছবি দেখে, ধর্মকর্ম করে বিশেষ করে নদীর জলছোঁয়া নির্মল বায়ুতে অবগাহন করে চাঁদপুর-ঢাকা নৌ-রূটে লঞ্চযোগে যাতায়াত ব্যবস্থা ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠে।