সুপ্রাচীনকাল থেকেই এদেশে মানুষের বসবাস ছিলো। চতুর্থ বরফ যুগ শেষ হয়েছে পঁচিশ হাজার বছর আগে। এ যুগে ভারতের উত্তরাঞ্চলের অধিবাসীরা বরফের হাত থেকে বাঁচার জন্যে এই নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের পাহাড়ী এলাকাসমূহে এসে ব্যাপকভাবে বসতি স্থাপন করে। এদের উত্তর পুরুষেরাই এদেশের গারো, হাজং কোচ, খাসিয়া, চাকমা, মোরং প্রভৃতি উপজাতি। এরাই বাংলার আদি মানুষ। বর্তমান চাঁদপুর জেলায় এ রকম কোনো আদিবাসীর বসবাস ছিলো না।
মধ্য ভারতের গাঙ্গেয় উপত্যকা ও বাংলার গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা বিধৌত বিস্তৃত সমতলভূমি গড়ে উঠার বহু পূর্বেই সিলেট, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, ফেনী, ময়মনসিংহের পাহাড়ী এলাকা, ভাওয়াল ও মধুপুরের পাহাড়ী এলাকা সমূহের সৃষ্টি হয়েছিলো। উত্তরবঙ্গের বরেন্দ্রভূমিও ছিলো বেশ পুরানো এলাকা। চট্টগ্রাম, সিলেট, কুমিল্লা, ফেনী ও ময়মনসিংহের উত্তরাঞ্চলের পাহাড়ী এলাকাসমূহই বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরোনো স্থলভূমি। এই পাহাড় এলাকাগুলোর সৃষ্টি হয়েছিল হিমালয় পর্বতমালা সৃষ্টি হওয়ার সাথে সাথেই। হিমালয় পর্বতমালার সৃষ্টি হয়েছিল কোটি কোটি বছর পূর্বে এক বিরাট ভূ-বিপর্যয়ের মাধ্যমে। বর্তমানের হিমালয় পর্বতমালা ও তৎসন্নিহিত এক বিশাল অঞ্চল নিমজ্জিত ছিলো সমুদ্রগর্ভে। বর্তমানের দক্ষিণ ভারতের বিন্ধ্যা পর্বতশ্রেণী মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিলো সেই মহাসমুদ্রে। বর্তমানের ভারত মহাসাগরের বিরাট এলাকা জুড়ে ছিলো এক বিশাল স্থলভূমি। সেই বিপুল ভূ-বিপর্যয়ের ফলে সৃষ্টি হলো হিমালয় পর্বতমালার; আর সমুদ্র গর্ভে তলিয়ে গেলো দক্ষিণ ভারতের দক্ষিণের সেই বিশাল স্থলভূমি, যার নাম এখন ভারত মহাসাগর। এ হচ্ছে প্রাচীন বাংলা ভূ-খন্ডের ইতিহাস।
এরপর কোটি কোটি বছর থেকে হিমালয়ের বিশাল পার্বত্য এলাকায় বৃষ্টি হচ্ছে আর দক্ষিণে সমুদ্রের দিকে নেমে আসছে অসংখ্য নদ-নদী। ফলে হিমালয় থেকে কোটি কোটি টন বালি মাটি নেমে আসছে প্রতি বছর নিম্ন এলাকায়। এমনিভাবে সৃষ্টি হয়েছে ভারত ও বাংলাদেশের বিশাল পলিমাটি এলাকা-এই পলল সমভূমি। এক কথায় সমতল ভূমির সৃষ্টি। সর্বশেষ গড়ে উঠেছে বাংলাদেশের পলিমাটি অঞ্চল। তাই এ অঞ্চলের বয়স সবচেয়ে কম। এই পলিমাটি অঞ্চল এখনো বেড়েই চলেছে। আমাদের চাঁদপুর জেলার বেশিরভাগ অংশ সৃষ্টি হয়েছে হাজার দেড় হাজার বছর আগে।
মধ্য ভারতের গাঙ্গেয় উপত্যকায় ছিলো অস্ট্রিক ও দ্রাবিড়দের বাস। গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনায় পলিমাটি এলাকা যতই ভরাট হয়ে বিস্তৃত হতে থাকে এই অঞ্চলের মানুষ ততোই দক্ষিণ দিকে নূতন পলিমাটি অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়তে থাকে।
বাংলাদেশের পলিমাটি এলাকা গড়ে ওঠার বহু পূর্বেই এদেশের পাহাড়ী এলাকায় গড়ে উঠেছিলো মানুষের বসবাস। তাই এসব এলাকাতেই পাওয়া গেছে প্রাচীন সব প্রত্নসম্পদ। চাঁদপুর জেলার প্রাচীন এবং ঐতিহাসিক নিদর্শন সমূহের নির্মাণকাল হাজার বছর অতিক্রম করেনি। সুলতানী আমলের খুব বেশি প্রত্নকীর্তির নিদর্শনও এ জেলায় নেই। তবে হাজীগঞ্জ থানার ফিরোজ শাহ মসজিদ ও ‘হদ্দিনের হথ’ এ জেলার সুলতানী আমলের প্রত্নকীর্তির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। শের শাহের আমলে নির্মিত ‘জাঙ্গাল’ এ জেলার পাঠান আমলের কীর্তি। শুজা মসজিদ, আলমগিরী মসজিদ মোঘল আমলের আরও অনেক মসজিদ এ জেলায় দেখা যায়। মুসলমান আমলের এসব কীর্তি এ জেলায় মুসলমান অধিকারের সুস্পষ্ট চিহ্ন বহন করে।
মেঘনা কন্যা চাঁদপুরকে নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। কেউ বলেন, ‘রূপসী চাঁদপুর’, কেউ বলেন ‘ইলিশের দেশ চাঁদপুর’। আবার কেউ চাঁদ সওদাগরের সপ্তডিঙ্গা মধুকরের পালতোলা জাহাজের নোঙর খুঁজে বেড়ান চাঁদপুর জনপদে। এভাবেই নানাজনের নানা ভাবনায় সুদীর্ঘ সময়ের পথ পরিক্রমায় ঐতিহ্য আর আদর্শের নীরব সাক্ষী চাঁদপুর। মেঘনা-ডাকাতিয়া আর ধনাগোদা নদীর জলধারায় বিধৌত দেশের অন্যতম বাণিজ্য বসতির জনপদ এই শ্যামলী চাঁদপুর। এই জেলার সদর দপ্তরও চাঁদপুর নামক শহরে অবস্থিত। বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নৌবন্দর এই শহরটিকে ঘিরে গড়ে ওঠেছে। চাঁদপুর নামে জনপদ হাজার বছরের পথচলায় প্রত্যক্ষ করেছে প্রকৃতির নানা লীলাখেলা। ভূমিকম্প, বন্যা আর নদীর ভাঙ্গনে বারে বারে বিপর্যস্ত হয়েছে কিন্তু কোনো শক্তির দাপটের কাছে হার মানেনি চাঁদপুর, সে মানুষই হোক কিংবা প্রকৃতি। ঐতিহ্যবাহী এক সময়ের মহকুমা শহর, ‘‘Gate way of Eastern India” আজকের জেলা চাঁদপুর। শত নয়, হাজার বছরের প্রাচীন জনপদ এই চাঁদপুর। বাংলার স্বাধীন সুলতানদের সময় থেকে প্রাচীন বাংলার এক সমৃদ্ধ নগরী চাঁদপুর। বিশিষ্ট চাঁদ ফকির, জমিদার চাঁদ রায় ও ধনাঢ্য বণিক চাঁদ সওদাগরের নামে এ ত্রয়ীযুগলবন্দীতে নামাঙ্কিত চাঁদপুর। এ যুগলবন্দীর নামের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকালে প্রথমেই দৃষ্টিগোচর হয় পুরন্দপুর গ্রাম ও চাঁদ ফকিরের স্মৃতি। কোড়ালিয়া ও পুরন্দপুর গ্রামে চাঁদ ফকির এলমে তাসাউফের বায়াত দিতেন। একদা কোড়ালিয়া গ্রামে তাঁর বাস ছিলো। চাঁদপুরের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে রয়েছে হাজার হাজার প্রত্নসম্পদ।
হাজীগঞ্জ উপজেলার কালোচোঁ উত্তর ইউনিয়নের ফিরোজপুর গ্রামে সুলতান ফখরুদ্দিন মোবারক শাহের আমলে নির্মিত তিন গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদটিই হচ্ছে সবচেয়ে প্রাচীন প্রত্নসম্পদ। প্রাপ্ত শিলালিপি থেকে জানা যায়, ১৩৪৪ সালে অর্থাৎ হিজরী ৭৪৫ সনে সুলতান ফখরুদ্দিন মোবারক শাহ কর্তৃক নির্দেশিত হয়ে ফৌজদার দেওয়ান ফিরোজ খান লস্কর তিন গম্বুজ বিশিষ্ট অনুপম সুন্দর মসজিদ ও একটি বিশালাকার দিঘি খনন করেন। ফিরোজ খান লস্করের দাঁড়া নামে একটি নৌপথ তৈরি করেন।
মেহের কালীবাড়ি
বিখ্যাত হিন্দু সাধক সর্বানন্দ ঠাকুর শাহরাস্তি উপজেলার মেহের শ্রীপুর অঞ্চলে সিদ্ধিলাভ করছিলেন। সিদ্ধিলাভের স্থানটিতে গড়ে উঠেছে মেহের কালীবাড়ি। প্রতি বছর এই মন্দিরে হিন্দু সম্প্রদায়ের মেলা বসে।
যতদূর জানা যায়, আজ থেকে প্রায় ৮ শ’ বছর পূর্বে এটি স্থাপিত হয়। বাংলা সন হিসেবে ৬০৯ অব্দ আনুমানিক। জানা যায় যে, ভারতের বর্ধমানস্থ পূর্বস্থলী গ্রামের অধিবাসী বাসুদেব গঙ্গা তীরে তপস্যা করার সময় অলৌকিক আদেশ পান যে, ‘‘এই স্থানে তুমি আমার সাক্ষাৎ পাবে না। তুমি মেহেরপুর গ্রামে মা তারা আশ্রমে গিয়ে তপস্যা কর। সেখানে তুমি আমার সাক্ষাৎ পাবে’’ আদেশ পেয়ে বাসুদেব শাহরাস্তির মেহেরপুর গ্রামে এসে তপস্যায় রত হন। সে সময়ে শিবানন্দ নামে প্রভাবশালী জমিদার বসবাস করতেন মেহেরপুরে। তিনি বাসুদেবকে আশ্রয় করে দিলেন। তিনি পার্শ্ববর্তী শ্রীপুর গ্রামে বাসুদেবের জন্যে বাড়ি তৈরি করে দিলেন। বাসুদেবের আপনজনেরা তাকে খুঁজে হয়রান হলো। তারা মেহোরপুর গ্রামে এসে তার দেখা পেলো। কিন্তু তারা তাকে ফিরিয়ে নিতে ব্যর্থ হলো। শিবানন্দ তাকে খুব শ্রদ্ধা করতো। বাসুদেব মদ্যপান করতেন। শিবানন্দ এই খবর পেয়ে তাকে দেখতে গেলে বাসুদেব তাকে এই কথা বলে অভিশাপ দেন যে, জমিদারের শিরচ্ছেদ হবে। শুনে শিবানন্দের মন খারাপ হয়ে যায়। তিনি বিষণ্ণ মনে বাড়ি ফিরে যান। এদিকে খবর আসে যে, দিঘি খননের সময় দু’দল শ্রমিকের মধ্যে সংঘর্ষ বেঁধেছে। শুনে শিবানন্দ দেখতে গেলেন। সংঘর্ষ থামাতে গিয়ে শিবানন্দের শিরচ্ছেদ ঘটে গেলো। খবর পেয়ে রাণী নিজে ছুটে গেলেন দেখতে। রাণী বাসুদেবের কাছে তার বংশ রক্ষা করার জন্যে প্রার্থনা জানালেন। বাসুদেব রাণীকে সান্ত্বনা দিলেন। বাসুদেবের আশীর্বাদে রাণীর এক পুত্র সন্তান জন্ম নিলো। তার মাথায় জট ছিলো। তাই তার নাম রাখা হলো জটাধারী। বাসুদেবের প্রধান শিষ্যের নাম হলো পূর্ণানন্দ। প্রধান শিষ্য পূর্ণানন্দকে সাথে নিয়ে বাসুদেব অনেক তীর্থ ভ্রমণ করেন। অবশেষে এলেন কামাখ্যায়। সেখানে তিনি স্বপ্ন দেখলেন যে, স্বর্গীয় দেবতা তাকে আদেশ করে বলছেন যে, তুমি পরজন্মে স্বীয় পৌত্ররূপে জন্ম নিবে এবং তুমি তখন পূর্ণ সিদ্ধিলাভ করবে। তারপর বাসুদেব সেখানে দেহ ত্যাগ করেন। কথিত আছে যে, মেহেরপুর গ্রামে তার পুত্রবধূর ঘরে বাসুদেব সর্বানন্দ নামে পূর্নজন্ম লাভ করেন। সর্বানন্দ ছিলেন অত্যন্ত অবোধ ও অশিক্ষিত। ফলে সর্বমহলেই সে ছিলো অবহেলিত। কিন্তু তিনি ছিলেন গুরু বংশের লোক। একদিন জমিদার সর্বানন্দকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, আজ কোন্ তিথি? সর্বানন্দ বললেন, পূর্ণিমা। কিন্তু সেদিন ছিলো অমাবস্যা। কথা শুনে সবাই হাসাহাসি শুরু করলো এবং নানা রকম বিদ্রূপ করলো। রাজা চিরদিনের জন্যে তার প্রাসাদ সর্বানন্দের জন্যে নিষিদ্ধ করলেন। শিষ্যদের এই হেন উপহাসে সর্বানন্দ মনে নিদারুণ কষ্ট পেলেন। তিনি মনের কষ্টে গৃহত্যাগ করলেন। অনেক তীর্থ পরিভ্রমণের পর পৌষ সংক্রান্তির রাতে কালীমাতা তাকে দেখা দিলেন। দেবীর দয়ায় সর্বানন্দের সিদ্ধিলাভ হলো। সেদিন ছিলো পৌষ সংক্রান্তি। সেই সময় থেকে এখন পর্যন্ত এইখানে পৌষ সংক্রান্তিতে কালীপূজা অনুষ্ঠিত হয়। কালীপূজা উপলক্ষে মেলা বসে প্রতি বছর। কালীমাতা স্বয়ং এখানে উপস্থিত হয়েছেন বলে এখানে কোনো কালীমূর্তি স্থাপন করা হয় না। প্রতি বছর কার্তিক মাসে কালীপূজা হয়, পূজা উপলক্ষে মেলা বসে। দেশ-বিদেশ থেকে আসে অসংখ্য পুণ্যার্থী, মায়ের পায়ে প্রণতি জানান, মনের বাসনা পূরণের জন্যে প্রার্থনা করেন। কালীগাছের চতুর্দিকে ঘুরে ঘরে ভক্তরা সংগীত পরিবেশন করেন। ঢাকের বাদ্যে মুখরিত হয় চারদিক। ভক্তরা সারারাত ধরে নাচে-গানে আনন্দে মাতোয়ারা হন। এ সময় মানত করে ভক্তরা পাঠা বলি দেন। এত সব ঘটনাবহুল ইতিহাস নিয়ে মেহের কালীবাড়ি আজো দাঁড়িয়ে আছে তার আপন ঐতিহ্যে সমুজ্জ্বল হয়ে। পূরণ করেছে জাতি, ধর্ম, গোত্র, ধনী, নির্ধন, উঁচু, নিচু, ছোট-বড় সকল মানুষের মনস্কামনা। ধর্মীয় ভাবধারা রেখেছে সমুন্নত।
হযরত শাহ রাস্তি ও তাঁর দরগা
চাঁদপুর জেলার শাহ্রাস্তি উপজেলাধীন শ্রীপুর গ্রামে হযরত রাস্তি শাহ্ (রঃ)-এর মাজার শরীফ অবস্থিত। এই মহান ইসলাম প্রচারক রাস্তি শাহ্ সম্পর্কে যতটুকু জানা যায়, তাঁর জন্ম ইরাকের বাগদাদ শহরে। তিনি ছিলেন হযরত বড়পীর আবদুল কাদের জিলানী (রঃ)-এর বংশধর। তাঁর পিতা ছিলেন বড়পীর সাহেবের ভাগ্নে। মাজারে রক্ষিত একটি বোর্ড থেকে জানা গেছে, তাঁর জন্ম ১২৩৮ খ্রিঃ সালে এবং তিনি এদেশে আগমন করন ১৩৫১ সালে। বহু অলৌকিক ঘটনা এলাকাবাসীকে প্রত্যক্ষ করিয়ে তিনি ১৩৮৮ সালে ইন্তেকাল করেন।
হযরত শাহজালালের সাথে যে ১২ জন আউলিয়া এদেশে আসেন, তিনি ছিলেন তাঁদের অন্যতম। তিনি যখন এদেশে আসেন তখন দিল্লীর সুলতান ছিলেন ফিরোজ শাহ্ এবং বাংলার সুবেদার ছিলেন ফখরুদ্দিন মোবারক শাহ। রাস্তি শাহের অন্যতম সহচর ছিলেন সৈয়দ আহমেদ তানভী।
ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে তিনি প্রথম ইয়েমেন আসেন ৭৩৮ বঙ্গাব্দে। ইয়েমেন থেকে স্বপ্নাদেশপ্রাপ্ত হয়ে তিনি ইসলাম প্রচারে এদেশে আসেন। ইয়েমেন হতে এদেশে আসেন বলে অনেকে তাঁকে ইয়েমেন বংশোদ্ভূত বলেও থাকেন। এদেশে আসার সময় তাঁর অন্যতম সহচর ছিলেন তাঁরই কনিষ্ঠ ভ্রাতা শাহ্ মাহবুব।
হযরত রাস্তি শাহ্ ছিলেন অকৃতদার। তাঁর ছোট ভাই শাহ্ মাহবুব বিয়ে করেন আশ্রাফপুর গ্রামের চৌধুরী বাড়িতে। আশ্রাফপুর বর্তমানে কচুয়া উপজেলায় অবস্থিত। সেখানেও রয়েছে একটি অতি প্রাচীন তিন গম্বুজ মসজিদ। রাস্তি শাহের মৃত্যুর সাড়ে তিনশ’ বছর পর সুবেদার শায়েস্তা খানের কন্যা পরী বিবির আদেশে কাজী গোলাম রসুল একটি তিন গম্বুজ মসজিদ নির্মাণ করেন।
মাজারের উত্তর দিকে যে দিঘিটি অবস্থিত, তার খননকার্য নিয়েও নানা কথা এলাকায় প্রচলিত। রাস্তি শাহ্র বংশধর বলে দাবিদার শ্রীপুর মিয়াবাড়ির লোকদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী জানা যায়, এক সময় বহু সংখ্যক লোক রাস্তি শাহের মুরিদ হতে এলে, এলাকায় তীব্র পানি সঙ্কট দেখা দেয়। এই পানি সমস্যার সমাধান করতে রাস্তি সাহেব একটি দিঘি খননের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন এবং এক রাতেই জ্বীন দ্বারা ২৮ একর সম্পত্তিতে দিঘিটি খনন করতে শুরু করেন। ভোর হলেই জ্বীনরা চলে যাবে। তখনো দিঘিটির উত্তর পাড় বাঁধানো অসমাপ্ত রয়ে গেছে। এমনি সময়েই শোনা গেলো ফজর নামাজের আজানের সুর। এক এক করে জ্বীন সব চলে গেলো। উত্তর পাড় আর বাঁধানো হয়নি। আজো সেই অবস্থাতেই রয়েছে।
অথচ এই দিঘি খনন সম্পর্কে এলাকায় একটি কথা কিংবদন্তীর মতো ভেসে বেড়াচ্ছে। হয়তো বক্তব্যটি নিয়ে বিতর্কের ঝড় উঠতে পারে। আমরা শুধুমাত্র ঘটনাপ্রবাহের কারণেই দিঘি খনন সম্পর্কিত উক্ত বক্তব্যটি বক্ষ্যমান প্রতিবেদনে অন্তর্ভুক্ত করলাম। দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত সে বক্তব্যটি হলোঃ কালীদেবীর সাথে রাসতি শাহ্ (রঃ) তাঁর আধ্যাত্মিক সাধনা নিয়ে চ্যালেঞ্জের মতোই উক্ত দিঘি খননে প্রয়াসী হন। কালীদেবী নাকি বলেছিলেন, এক রাতে এতো বড়ো দিঘি খনন করা সম্ভব হবে না। এতে নাকি জেদ ধরে রাসতি শাহ্ (রঃ) আধ্যাত্মিক সাধনা বলে জ্বীন আনয়ন করে এই দিঘি খনন করতে থাকেন। দিঘি খননের অগ্রগতি দেখে কালী বিস্মিত হয়ে যান এবং সন্দিহান হয়ে পড়েন যে, রাস্তি শাহ্ (রঃ) শেষ পর্যন্ত কামিয়াবি হতে যাচ্ছেন? তৎক্ষণাৎ তিনি মোরগের ছদ্মবেশ ধারণ করলেন। তখন উক্ত দিঘির শুধুমাত্র উত্তর পাড়টুকু বাঁধানো বাকি। মোরগের ছদ্মবেশে তিনি ভোর হবার ইঙ্গিত করলেন এবং ভোর হয়েছে মনে করে জ্বীনগুলো খননকার্য সমাপ্ত না করেই ফিরে যায়। সেই থেকে অদ্যাবধিও উত্তর পাড় আর বাঁধানো হয়নি।
সম্রাট ফিরোজ শাহ তুঘলকের আমলে (১৩৫১-১৩৮৮) রাস্তি শাহের খানকা শরীফের ব্যয় নির্বাহ করার জন্য সরকার ৬৪ একর সম্পত্তি লাখেরাজ দান করেন।
দীর্ঘদিন পরও এই শ্রীপুরেই তার বংশধরগণ বংশ পরম্পরায় মাজারসহ ৬৪ একর সম্পত্তি দেখাশুনা করে আসছেন। শ্রীপুর মিয়াবাড়ি নামের বাড়িতে রাস্তি সাহেবের বংশধর বাস করে আসছেন। বর্তমানে তারা আলাদাভাবে ৫টি বাড়ি করেছেন। পাঁচ বাড়ির পাঁচজন কর্ণধার হচ্ছেন সর্বজনাব আব্দুল ওহাব মিয়া, মৌলভী আবিদুর রহমান মিয়া, মোঃ বদিউল আলম মিয়া, মজিবুল হক মিয়া এবং মফিজুল হক মিয়া।
এই মাজার রক্ষণাবেক্ষণ করার জন্যে বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী বার্ষিক দু’শ’ দশ টাকা হারে অনুদান (ভাতা) দিতো। মাঝখানে হেনরী মেডকাফ যখন কুমিল্লার ডিএম (ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট) ছিলেন, তখন হযরত রাস্তি শাহের উত্তরসুরি হযরত গোলাম রেজার সাথে ঘাপলা দেখা দিলে তা বন্ধ হয়ে যায়। পরে অবশ্য ঝামেলা চুকে যায়। আজো তার বংশধরগণ সেই দু’শ’ দশ টাকা হারে বার্ষিক ভাতা পাচ্ছেন।
প্রতি বছর মাঘ মাসের শেষ বৃহস্পতিবার এখানে বার্ষিক ওর’স অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রচুর লোক সমাগম হয়ে থাকে।
পঞ্চদশ শতকের পর্তুগীজ দুর্গ সাহেবগঞ্জ
পর্তুগীজ সেনাপতি এন্টেনিও ডি সিলভা মেনজিস ১৫৪০-৪৬-এর মধ্যে এ দুর্গটি নির্মাণ করেন। পর্তুগীজরা এ অঞ্চলে জলদস্যুতা করতো। শের শাহের আমলে পাঠান সেনাপতি খিজির খানের সাথে এখানে পর্তুগীজদের যুদ্ধ হয়েছিলো। খিজির খান জলদস্যুদের বিতাড়িত করেছিলেন। তাদেরই (পর্তুগীজ) বংশধরদের বংশধর এখনও এখানে বসবাস করছে।
চাঁদপুর জেলা সদর থেকে ডাকাতিয়া নদী পার হয়ে চাঁদপুর-লক্ষ্মীপুর আঞ্চলিক মহাসড়ক ধরে ষোল কি. মি. দক্ষিণ-পূর্ব দিকে গেলেই ফরিদগঞ্জ উপজেলা সদর। উপজেলার সর্ব দক্ষিণের ইউনিয়ন ১৬ নং রূপসা। এই রূপসা ইউনিয়নের একটি ঐতিহ্যবাহী জনপদের নাম সাহেবগঞ্জ। অন্যসব গ্রামের চেয়ে এই গ্রামের স্বকীয়তার পেছনে লুকিয়ে আছে এক ঐতিহাসিক বিশিষ্টতা। এখানে রয়েছে ধ্বংসপ্রাপ্ত এক পর্তুগীজ দুর্গ। এই দুর্গটি পাঁচ শতাধিক বছর পূর্বে স্থাপন করেছিলেন পর্তুগীজ এক দুর্ধর্ষ সেনানায়ক এন্টেনিও ডি সিলভা (মেনজিস)। ১৫৪০ থেকে ১৫৪৬ সালের মধ্যে সিলভা এটি নির্মাণ করেন। তখন সুবে বাংলা পাঠান সম্রাট শের শাহের শাসনাধীনে ছিলো। জনশ্রুতি আছে, পর্তুগীজদের দমনকালে শের শাহের সেনাপতি খিজির সম্রাটের আসল নাম অর্থাৎ ফরিদ এই নামানুসারেই এক নয়াবসতি স্থাপন করেন। এর নাম ফরিদগঞ্জ। তখন ফরিদগঞ্জের অবস্থান ছিলো সমুদ্র তীরবর্তী। পর্তুগীজ সেনা তথা লুটেরাদের তাড়া করতে করতে নৌ-বহর নিয়ে খিজির খান এখানে আসেন। খিজির খান চলে যাওয়ার পর বাংলার অপর পাঠান শাসক, মাহমুদ শাহের সেনাপতি হামজা খানের সহায়তায় পর্তুগীজরা সমুদ্রোপকূলীয় এলাকায় বাণিজ্য কুঠির আড়ালে কিছু সংখ্যক দুর্গ স্থাপন করে। সাহেবগঞ্জ তেমনি একটি দুর্গ। এই দুর্গটি স্থাপনের প্রায় তিনশ’ বছর পরে কিছুদিন নীলকুঠি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে, তাই স্থানীয় জনগণ এটিকে সাহেবগঞ্জ নীলকুঠি হিসেবেই জানে। ইতিহাসের একটি অধ্যায় ঢাকা পড়ে যায় নীলকুঠির আবরণে। ঢাকা পড়ে যায় পর্তুগীজদের নির্মম অত্যাচার আর অসহায় বঙ্গবাসীর অনেক করুণ ইতিহাস।
পরবর্তী সময়ে কোনো পর্যটক বা ইতিহাসবিদ ভেবে দেখলেন না, নীলকুঠি এতো বৃহৎ আকারের হয় না। নীল কুঠিতে হাতীশালা থাকে না, থাকে না সুউচ্চ পর্যবেক্ষণ মিনার অথবা সৈনিকদের জন্যে গার্ড শেড বা সেনাচৌকি, থাকে না কোনো সুড়ঙ্গ পথ। সাহেবগঞ্জ দুর্গটি বিস্তৃত প্রায় দু’শ’ একর। এখানে আজ অবধি বিদ্যমান ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গ পথ, একটি পঁয়তাল্লিশ ফুট উঁচু পর্যবেক্ষণ মিনার, পাহারাদারদের ব্যবহৃত চৌকি, বিভিন্ন পর্যায়ের সৈনিকদের আবাসের ভগ্নাংশ। ইতিমধ্যে সম্পূর্ণ দুর্গ এলাকার ভেতরে অনেক বাড়িঘর উঠেছে। স্থানীয় জনসাধারণ এবং প্রত্নসম্পদ লুণ্ঠনকারী তস্কররা ভেঙ্গে নিয়ে যাচ্ছে এই প্রত্নসম্পদের বিভিন্ন স্থাপনার ইট।
দুর্গে রয়েছে একটি পর্যবেক্ষণ মিনার বা টাওয়ার। এই মিনারটি দুর্গের একমাত্র অক্ষত স্থাপনা। এটির অবস্থান দুর্গের দক্ষিণে এবং দুর্গের বর্ধিত অংশে একটি অনুচ্চ মাটির ঢিবির ওপর। এর বর্তমান উচ্চতা ১৫.৬০ মি. এবং পাদদেশের পরিধি ১০.০৩ মি.। চারটি ধাপে ঊর্ধ্বগামী এ মিনারের প্রতিটি অংশেই এর পরিধি হ্রাস পেয়েছে। এর ছাদ একটি গম্বুজ দিয়ে ঢাকা। প্রতিটি ধাপের পশ্চিম ও পূর্বদিকে খিলান দরজা রয়েছে। মিনারের ভেতরের অংশে চুনা-সুড়কির প্রলেপ রয়েছে। মিনারটির ভেতর অংশে এক সময় একটি শিলালিপি ছিলো। এখন এর অস্তিত্ব না থাকলেও নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া শিলালিপিটির অবস্থান চিহ্নিত করা সম্ভব। মিনারটি সম্পর্কে স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে তিনটি বক্তব্য প্রচলিত আছে, প্রথমত, এটি একটি চেরাগদানী>বাতিঘর ছিলো, দ্বিতীয়ত, পর্তুগীজ সেনারা দূরবর্তী জলসীমার স্বপক্ষীয় নৌ-যান অথবা শত্রু নৌ-যান দূরবীনের সাহায্যে পর্যবেক্ষণ করতো, তৃতীয় মত, এটি দুর্গের স্বাভাবিক স্থাপনার একটি অংশ, শত্রুসেনার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করাই এর উদ্দেশ্য ছিলো। এটি সুড়ঙ্গ পথে দুর্গের অন্য অংশের সাথে সম্পৃক্ত ছিলো।
ক্ষয়িষ্ণু ঐতিহ্য একটি মোগল গ্রাম অলিপুর ও দুটি মসজিদ-স্থাপত্য শৈলীর অনুপম নির্দশন
গ্রামটির অবস্থানঃ চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জ উপজেলাধীন ৫নং হাজীগঞ্জ সদর ইউনিয়নের অন্তর্গত একটি গ্রাম অলিপুর। চাঁদপুর-কুমিল্লা মহাসড়কের কৈয়ারপুল নামক স্থানে যানবাহন থেকে নেমে কৈয়ারপুল-ওটতলী সড়ক দিয়ে সোজা দক্ষিণ দিকে প্রায় ২ কিলোমিটার গেলে দেখা যায় ডাকাতিয়া কোলে অলিপুর গ্রাম। রাস্তাটি কেয়ারের আওতায় পাকা করা হয়েছে। পূর্বে এটি ছিলো জেলা পরিষদের রাস্তা। রাস্তাটি ডাকাতিয়ার খেয়া হয়ে ফরিদগঞ্জের রূপসা পর্যন্ত চলে গেছে। তৎকালীন কুমিল্লা জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান খান বাহাদুর আবিদুর রেজা চৌধুরী এ সড়কটি নির্মাণ করেন। জনাব রেজা চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি পন্ডিত রিয়াজউদ্দিন আহমেদের নামে সড়কটির নামকরণ করা হয় পন্ডিত রিয়াজ উদ্দিন সড়ক। ওই সময় (সম্ভবতঃ ১৯৩৫-৩৮ সালে) অলিপুর গ্রামটি ছিলো ৬নং হাজীগঞ্জ ইউনিয়নের অন্তর্গত। ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট ছিলেন সাবেক এমপি মরহুম আঃ রবের পিতা আমিন মিয়া। ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় গ্রামটির তিন পাশেই বহমান ডাকাতিয়া। এক সময় এই ডাকাতিয়া নদী খুবই প্রমত্তা ছিলো। অলিপুর বাজারটি খুব খ্যাতনামা ব্যবসাকেন্দ্র, বন্দর ছিলো। ডাকাতিয়ার স্রোত ক্ষীণ হয়ে আসার সাথে সাথে অলিপুর বাজারটিও বন্দরের মর্যাদা হারিয়েছে। বর্তমানে অস্থিসারশূন্য কঙ্কালরূপে বিদ্যমান। এখানে এখন আর চাঁদ সওদাগরের সপ্তডিঙ্গা মধুকর ভিড়ে না। বন্দরের কোলাহল থেমে গেছে, একটি ছোট্ট গ্রাম্য বাজার হিসেবে কোনোরূপে টিকে আছে।
অলিপুর গ্রামটি হাজীগঞ্জ থানার পশ্চিম-দক্ষিণের সর্বশেষ গ্রাম। এ গ্রামের লাগ পশ্চিমেই চাঁদপুর সদর থানার মনিহার গ্রাম। এর পূর্ব ও দক্ষিণ পাশে সম্পূর্ণ এবং পশ্চিম ও উত্তরে কিয়দংশ ডাকাতিয়া নদীর অবস্থান বলা যায়। নদী পরিবেষ্টিত একটি গ্রামই অলিপুর। এ গ্রামের দক্ষিণ পার্শ্বস্থ ডাকাতিয়া নদী পেরুলেই ফরিদগঞ্জ থানার সুবিদপুর উত্তর ইউনিয়নের বদরপুর গ্রাম এবং পূর্ব পাশে সমেশপুর গ্রাম। উত্তর পাশে রয়েছে হাজীগঞ্জ থানার উচ্চঙ্গা ও বলাখাল গ্রাম। পূর্বকালে অলিপুর নদী দ্বারা পরগণা সদরের সাথে সংযুক্ত ছিলো। অর্থাৎ নৌ যোগাযোগ মুখ্য ছিলো, বতমানে সড়ক যোগাযোগই মুখ্য।
গ্রামটির সংক্ষিপ্ত ইতিহাসঃ ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম দিকে গ্রামটির গোড়াপত্তন হয়। চতুর্দিকে নদী পরিবেষ্টিত ছিলো বলে মোগলরা সমৃদ্ধ নৌ-পথের কারণে এ গ্রামটিতে তহসিল কাচারী গড়ে তোলে। এখান থেকে টোরা পরগণার খাজনা আদায়ের কাজটি পরিচালনা করা হতো। ধারণা করা হচ্ছে, বর্তমান ফেনী, কুমিল্লা, চাঁদপুর ও লক্ষ্মীপুর জেলায় বিদ্যমান ডাকাতিয়া নদীর বিস্তীর্ণ অববাহিকা-অঞ্চল উক্ত টোরা পরগণার অন্তর্ভুক্ত ছিলো। এ গ্রামের পাশেই সাচনমেঘ গ্রামের অংশবিশেষ টোরা মুন্সীরহাট এবং বর্তমান হাজীগঞ্জ পৌরসভার টোরাগড় গ্রাম উক্ত টোরা পরগণার কথা মনে করিয়ে দেয়। মেঘনার পূর্বপাড় থেকে ত্রিপুরা রাজ্যের লাকসাম পর্যন্ত এই পরগণা বিস্তৃত ছিলো। পরগণাটি বেশ কিছু তহসিল কাচারীতে বিভক্ত ছিলো, অলিপুর ছিলো তেমনই একটি তহসিল। অলিপুর গ্রামেই থাকতেন উক্ত পরগণার একজন তহসিলদার। যিনি খাজনা আদায়ের পাশাপাশি প্রশাসনিক দায়িত্বও পালন করতেন। অবশ্য এ তহসিলদার এখনকার মতো ইউনিয়ন পর্যায়ের তহসিলদার ছিলেন না। ১৫২৬ সালে মোগল বাদশা বাবর পানিপথের প্রথম যুদ্ধে জয়লাভ করে দিল্লী অধিকার করেন ও ভারতে মোগল শাসন কায়েম করেন। ভারতের শাসন ব্যবস্থায় বিভিন্ন পদ-পদবীর ব্যবস্থা করেন। ১৫৫৬ সালে মোগল সম্রাট আকবর দ্বিতীয় পানিপথের যুদ্ধে জয়লাভ করেন। পর্যায়ক্রমে সারা ভারতবর্ষে সাম্রাজ্য বিস্তৃত করেন। কিন্তু সুবে বাংলায় তার শাসন ততো সুদৃঢ় ছিলো না। কিন্তু তদীয় পুত্র সম্রাট জাহাঙ্গীর ১৬০৫ সালে ক্ষমতা গ্রহণ করেই সুবে বাংলায় মোগল আধিপত্য সুদৃঢ় করেন। কেন্দ্র, সুবা, পরগণা, তহসিল চার স্তর বিশিষ্ট প্রশাসনিক ব্যবস্থার সৃষ্টি করেন। টোরা পরগণার একটি সমৃদ্ধ তহসিল ছিলো অলিপুর। তহসিলদার ছিলেন মহকুমা প্রশাসকের মতো ক্ষমতাধর ব্যক্তি। এ প্রশাসকের প্রশাসনিক কর্মকান্ড সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা ও সার্বিক নিরাপত্তার স্বার্থে এখানে মোগলদের ঘোড় সওয়ারসহ পদাতিক সৈন্যরা থাকতো, ১৬টি ঘোড়া পাশাপাশি একসঙ্গে দৌড়ানোর মতো বিস্তৃত রাস্তার (গোপাট) অস্তিত্ব কয়েক বছর পূর্বেও এই গ্রামে দৃশ্যমান হতো। এ গ্রামের বাংলা বাড়ি থেকে ডাকাতিয়া নদীর তীরে কাজী বাড়ি পর্যন্ত প্রায় তিন কিলোমিটারব্যাপী এ গোপাটটির অবস্থান ছিলো। এখনো থাক্ নকশায় এ গোপাটের অস্তিত্ব চিহ্নিত করা আছে। এ গ্রামের উক্ত কাজী বাড়ির কাজীরা বিচারকার্য পরিচালনা করতেন। এখন কাজী বাড়িতে কাজীরা না থাকলেও তাদের পুকুর (কাজির আন্দি) আজো রয়েছে, যা গ্রামবাসীদের নিকট স্বচ্ছ পানির আধার হিসেবে খ্যাত। লেখক তার ছোটবেলায় কাজীর আন্দির পানি পান করার কথা এখনো স্মরণ করতে পারেন।
একটি তহসিল (মহকুমা) পর্যায়ের প্রশাসনিক স্তরে যে সব কার্যালয় থাকার দরকার তার সবকিছুই অলিপুরে বিদ্যমান ছিলো। পুরানো দলিল-দস্তাবেজ খুঁজে বের করলে গ্রামটিকে আজো শনাক্ত করা যায়। গ্রামটির উত্তর-পশ্চিম অংশে রয়েছে ‘বাংলা বাড়ি’। আজকাল সার্কিট হাউজ বলতে যা বোঝায় তখন ‘বাংলা বাড়ি’ ছিলো তা-ই। পরিদর্শনের জন্যে মোগল সম্রাটের প্রতিনিধিরা ডাকাতিয়া নদী দিয়ে এসে এ বাড়িতে থাকতেন। নদী থেকে বাড়ি পর্যন্ত একটি প্রশস্ত রাস্তা ছিলো। তহসিলদার থাকতেন গ্রামের প্রায় মধ্যবর্তী অংশে। তিনি তার প্রশাসনিক কাজের সুবিধার্থে নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্যে চারপাশে যেভাবে আবাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলেন তার নিদর্শন এখনো বিদ্যমান। প্রশাসকের বাড়ির সবচেয়ে নিকটে (পশ্চিমে) রয়েছে বরকন্দাজ (পাহারাদার) বাড়ি, আরো পশ্চিম-দক্ষিণ কোণে মোল্লা (মসজিদের মোতওয়াল্লী) বাড়ি, তার সংলগ্ন কাজী (বিচারক) বাড়ি, পূর্ব পাশে পাটওয়ারী (কেরানী) বাড়ি, মজুমদার (হিসাবরক্ষক) বাড়ি, পূর্ব-দক্ষিণে মীর (কোষাগার রক্ষক বা নাজির) বাড়ি, তার পূর্ব পাশে মুন্সী (দলিল লিখক) বাড়ি এবং বাড়ির উত্তর পাশে অলিপুর বাজার ও বন্দর। এসব নামে বাড়িগুলো এখনও পরিচিত হলেও প্রকৃতপক্ষে বর্তমানে যারা বসবাস করছেন তারা সবাই অন্যস্থান থেকে আগত। অলিপুর বাজারে ব্যবসা করতো হিন্দু সম্প্রদায়ের এমন সাহা ও পোদ্দার, মৃৎশিল্পের কারিগর কুমোর, কামারের বাড়িও রয়েছে এ গ্রামে। ডাকাতিয়া নদীকে জীবিকা নির্বাহের উপজীব্য হিসেবে গ্রহণকারী মৎস্যজীবী দাস ও নৌকার চালক মাঝিদের বাড়িও রয়েছে এ গ্রামে। গ্রামের ‘থাক্-নকশায়’য় প্রশাসকের বাড়িসহ তার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বাড়ির সাথে সংযোগ রক্ষাকারী গোপাটগুলোও দেখা যায়। এভাবে কাগজপত্র ও দলিলাদি পর্যালোচনা এবং কালের করাল গ্রাসে হারিয়ে না যাওয়া কিছু নির্দশন গ্রামটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও শত শত বছরের ঐতিহ্যকে ধারণ করে আছে।
চাঁদপুর-কুমিল্লা আঞ্চলিক মহাসড়কের কৈয়ারপুল বাস স্টপেজ থেকে তিন মাইল দক্ষিণে এলেই একটি সুন্দর দিঘির পাড়ে ৫০০ গজ দূরত্বে দুটি প্রাচীন মসজিদ। একটির নাম শাহ সুজা মসজিদ এবং অপরটির নাম শাহী বা আলমগিরি মসজিদ। একটি থেকে অপরটি ৫৪ বছরের প্রাচীন। শাহসুজা মসজিদকে স্থানীয়ভাবে ‘পাঞ্জেগানা মসজিদ’ এবং শাহী বা ‘আলমগিরি মসজিদ’কে ‘জুমা মসজিদ’ নামে অভিহিত করা হয়। যদিও বর্তমানে দু’টি মসজিদেই জুমার নামাজ হয়।
শাহী মসজিদের প্রায় একই সমান্তরালে মাত্র ২০০ মিটার উত্তরে সুজা মসজিদের অবস্থান। এটিকে স্থানীয় মসজিদ কমিটি নিজস্ব বিচার-বুদ্ধিতে সংস্কার করতে গিয়ে মূল আকার-আকৃতির কিছুটা বিকৃতি ঘটিয়েছে। এটি মোগলদের প্রচলিত স্থাপত্যরীতিতে নির্মিত অর্থাৎ তিনগম্বুজ বিশিষ্ট। এটি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের মসজিদ অর্থাৎ ‘পাঞ্জেগানা মসজিদ’ হলেও বর্তমানে এটিতে শাহী মসজিদের ন্যায় জুমার নামাজ আদায় করা হয়। এ মসজিদের সামনে রয়েছে বড় পুকুর ও তার পূর্ব পাড়ে ঈদগাহ। জনশ্রুতি আছে, ওই ঈদগাহটি সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে নির্মিত হয়েছে। বর্তমান সংস্কারের আওতায় পড়ে অনেক কিছুরই পরিবর্তন হয়েছে। মোগল সম্রাটদের তৈরি মসজিদগুলোতে সাধারণ মসজিদের মূল ভবন ছাড়াও খোলা পাকা চত্বর থাকে এবং দেওয়াল দ্বারা ঘেরা থাকে। এখানে এগুলো নেই, আজান দেওয়ার জন্য কোনো পাকা মিনারও নেই। হয়তো কালের আবর্তে ওগুলো হারিয়ে গেছে। হয়তো কোনো ভূমিকম্পে ধ্বংস হয়ে গেছে অথবা বাংলার প্রচন্ড বৃষ্টিপাতের কথা মনে রেখে নির্মাতারা এগুলো নির্মাণ করেননি।
শাহী (বড়) মসজিদটি বাদশাহ্ আওরঙ্গজেবের শাসনামলে স্থানীয় প্রশাসক আব্দুল্লাহ্ কর্তৃক ১৭০২ খ্রিঃ (১১০৪ হিজরীতে) নির্মাণ করা হয় অর্থাৎ পলাশী যুদ্ধের অর্ধ শতাব্দীরও অধিক পূর্বে। এ মসজিদটি নির্মাণের ৫৪ বছর পূর্বে (১০৭৭ হিঃ, ১৬৪৮ খ্রিঃ) ছোট মসজিদটি নির্মাণ করা হয়। কুমিল্লা জেলার ইতিহাস গ্রন্থের ২৫০ পৃষ্ঠায় বর্ণিত তথ্য থেকে জানা যায়, সম্রাট শাহজাহানের দ্বিতীয় পুত্র সুজা এ মসজিদটি নির্মাণ করেন বলে এটি সুজা মসজিদ নামে সমধিক পরিচিত। মসজিদের দৈর্ঘ্য ৪৮ ফুট ও প্রস্থ ২৪ ফুট এবং দেয়ালের ঘনত্ব বা পুরুত্ব ৫ ফুট। উল্লেখ্য, শাহ সুজা এ মসজিদটি নির্মাণের ১০ বছর পর ১৬৫৮ খ্রিস্টাব্দে কুমিল্লার মোগলটুলিতেও প্রায় অনুরূপ তবে এর চাইতে একটি বড় মসজিদ নির্মাণ করেন। ১৬০৮ সালে ঢাকা নগরীর পত্তন হয়, তার আগেই টোরা পরগণার সৃষ্টি হয়।
মসজিদ দুটির নির্মাণের ইতিহাস অনেকটা জনশ্রুতি নির্ভরই ছিলো। ইতিমধ্যে বিভিন্ন জাতীয় দৈণিক ও সাপ্তাহিকে এ মসজিদ দুটিকে নিয়ে যে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে তা জনশ্রুতি ও কিংবদন্তীর বরাত দিয়েই পরিবেশিত হয়েছে। কিন্তু এখনো কোনো পত্রিকায় সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কর্তৃক সংগৃহীত ও সংরক্ষিত সূত্রের বরাত দিয়ে কোনো প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়নি। তবে বর্তমান প্রতিবেদনটি জনশ্রুতি নির্ভর নয়, এটি নিতান্তই তথ্যভিত্তিক। সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ থেকে প্রাপ্ত। ফারসি ভাষায় এর লিখিত ইতিহাস রয়েছে।
১৯৬৫ সালে যখন পাক-ভারত যুদ্ধ চলছিলো তখন ভারতবর্ষে মুসলিম শাসকদের কীর্তিগাঁথা ও স্থাপিত বিভিন্ন স্থাপনা নিয়ে গ্রন্থ রচনার উদ্যোগ নেয় তৎকালীন পাকিস্তান সরকার। এরই ধারাবাহিকতায়, বিস্মৃতির প্রায় অন্ধকার অবস্থান থেকে বেরিয়ে আসে অলিপুর নামক লোকালয়টি। লাহোর শহরে প্রত্নতত্ত্ব দপ্তরে পূর্ব বাংলার প্রাচীন লোকালয়সমূহের বিবরণ লিপিবদ্ধ আছে।
সরকারি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের নজরে আসে অলিপুর আলমগিরি মসজিদ ১৯৬৫ সালের ৩১ বছর পর। ১৯৯৬ সালের ১৬ মার্চ আঞ্চলিক পরিচালক, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর অলিপুর শাহী মসজিদ সংস্কার কাজ হাতে নেন। শুরু হয় শেকড় অনুসন্ধান কাজ। ক্ষয়িষ্ণু ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারকল্পে সরকার ইতিমধ্যে এটিকে একটি পুরাকীর্তির মর্যাদা দিয়ে সংস্কার করেছেন।
বাংলাদেশে ব্যাপক বৃষ্টিপাতের প্রেক্ষিতে আলমগিরি মসজিদটি বারান্দাবিহীন নির্মাণ করা হয়। আযান দেয়ার কোনো মিনারও দেখা যায় না মসজিদটিতে। এ কথা পূর্বেই বলা হয়েছে। মসজিদের ৬০ ফুট পূর্বে রয়েছে একটি বড় পুকুর। এই পুকুরটি মসজিদ নির্মাণকারী কর্তৃপক্ষই খনন করেছিলেন।
সাধারণ মোগল স্থাপত্যরীতির তাৎপর্যপূর্ণ ব্যতিক্রম পরিলক্ষিত হয় এ মসজিদে। সাধারণতঃ মোগলরা তিন গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদই তৈরি করতো। কিন্তু এ মসজিদের আছে পাঁচ গম্বুজ। হয়তো শাহ্ সুজা থেকে আওরঙ্গজেবের কীর্তিকে আলাদা করার প্রচেষ্টা অথবা তহসিলদারের পদমর্যাদা বৃদ্ধির কারণে।
মসজিদের প্রধান দরজার ওপরে স্থাপিত রয়েছে ১.১০ ফুট দীর্ঘ ও সাড়ে এগার ইঞ্চি প্রস্থের ফারসি ভাষায় লিখিত শিলালিপি। এ শিলালিপির ক’টি লাইনের অনুবাদ হচ্ছেঃ (১) পরম দয়ালু ও দাতা আল্লাহ্র নামে (২) আল্লাহ্ ছাড়া কোনো মাবু’দ নেই এবং মুহম্মদ (সাঃ) তাঁর নবী (৩) মহামতি সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাসনামলে (যাঁর সুদৃঢ় প্রতিরক্ষায় অনেক রাজন্যবর্গ আশ্রয় নিত) (৪) উপাসনালয়ের গুণাবলি প্রকাশের জন্যে পৃথিবীতে অনেক ঘটনাই ঘটে। আমি যখন এর প্রতিষ্ঠার কথা জানতে চাইলাম, আকস্মাৎ একটি কণ্ঠস্বর আমাকে এর সাল জানালো (৫) মসজিদটি নির্মিত হয় আমি আবদুল্লাহ্ কর্তৃক (৬) (যে চার সঙ্গী- বকর, ওমর, ওসমান ও আলীর অনুগামী)। ১১০৪ হিজরীতে শিলালিপির বর্ণনা অনুযায়ী নির্মাণকারী একজন সুন্নী সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষ ছিলেন।
মসজিদের নির্মাতা আবদুল্লাহ্ সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায়নি। তবে অনুমান করা হয় তিনি একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা ছিলেন। সম্রাট আওরঙ্গজেবের পৌত্র আজিমুশ্বান যখন বাংলার গভর্নর (সুবেদার) ছিলেন (১৬৯৬-১৭০৬ খ্রিঃ) তখনই আবদুল্লাহ্ নির্মাণ করেন এ মসজিদ। মসজিদের ১০০ মিটার পূর্বে একটি পুরাতন ইটের মাজার আছে। বর্তমানে অপরিকল্পিত সংস্কারে আগের অবয়ব ঠিক নেই। এখানে আছে আবদুল্লাহর সমাধি। শুনেছি মাজারের গায়ে শিলালিপি ছিলো, বর্তমানে নেই।
১৭০৭ সালে মহামতি আওরঙ্গজেব পরলোকগমন করেন। অর্থাৎ মসজিদটি ১৭০২ সালে নির্মাণের পাঁচ বছর পর। ১৯৬৫ সালের ৪ নভেম্বর পাকিস্তান সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের কর্মকর্তা জনাব এ. কে. এম. আমজাদ হোসেন ‘Concept of Pakistan’সাময়িকীতে একটি গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ লিখেন। প্রতিবেদনে তিনি শাহী মসজিদটিকে তাঁর গবেষণায় ‘আলমগিরি মসজিদ’ হিসেবে অভিহিত করেন। আলমগিরি (শাহী) মসজিদের দৈর্ঘ্য ৫২.৮ ফুট ও প্রস্থ ২৯.৯ ফুট। মোগল স্থাপত্যের সাধারণ রীতি অনুযায়ী এ মসজিদের চারটি অষ্টকোণাকার মিনার রয়েছে। মসজিদের ছাদে দুপাশে দুটি করে ৪টি ছোট গম্বুজ এবং মাঝে একটি বড় গম্বুজসহ মোট ৫টি গম্বুজ রয়েছে। পশ্চিম পাশের দেয়ালে তিনটি মিহরাব রয়েছে। ইমাম সাহেব মধ্যবর্তী যে মিহরাবে অবস্থান করে নামাজ পড়ান সেটিই বড় এবং দু’পাশের দু’টি ছোট। মসজিদের ভেতরে রয়েছে অষ্টভুজাকৃতির দুটি বিশাল (স্থুল) স্তম্ভ (পিলার)। যেগুলোর বেড় বা পরিধি কমপক্ষে আট হাত। আর মসজিদের দেয়ালের পুরুত্ব প্রায় আড়াই হাত (প্রায় ৪ ফুট)। মসজিদটিতে মূলত কোনো জানালা ও ভেন্টিলেটার নেই। পূর্ব দেয়ালে তিনটি দরজা রয়েছে। উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালে দুটি করে যে ৪টি দরজা ছিলো সেগুলোকে বর্তমানে জানালায় রূপান্তর করা হয়েছে। মসজিদের চারদিকের দেয়ালের মধ্যে পূর্ব দেয়াল ছাড়া তিনদিকের দেয়ালই সমতল। পূর্বদিকের দেয়ালে এক সময় ছিলো নানা কারুকাজ।
১৯৯৮ সালের বন্যার পর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ মসজিদটিকে তার পূর্ব অবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্যে সংস্কার করেছে। মসজিদের ভেতরে বৈদ্যুতিক আলো ও পাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সুজা মসজিদটির কোনো প্রকার সংস্কার করা হয়নি। অনতিবিলম্বে এটি সংস্কার করা দরকার। সুজা মসজিদের দেয়ালের পুরুত্ব আলমগিরি মসজিদের চেয়ে বেশি।
মসজিদ দুটোর পার্শ্বে রয়েছে আরেকটি স্বচ্ছ পানির দিঘি, যার পাড়গুলো পূর্বে পাহাড়সম উঁচু ছিলো। গ্রামের জনসাধারণ এখান থেকে বিশুদ্ধ খাবার পানির সরবরাহ পেতো। দিঘিটির দক্ষিণ পাড়ে একটি দীর্ঘ শান বাঁধানো ঘাট ছিলো। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভের অব্যবহিত পরেই অজ্ঞতাবশতঃ গ্রামের লোকজন ঘাটটি ভেঙ্গে ইটগুলো তুলে ফেলে। বর্তমানে খনন কাজ ছাড়া এটির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া দুস্কর। দিঘির পশ্চিম পাড়েই রয়েছে একটি মাজার। জনশ্রুতি রয়েছে, এখানে এসে আল্লাহ্র সাহায্য চাইলে প্রার্থনাকারীর মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়। দেশের অন্যান্য মাজারের মতো এখানে সাধু বাবারা অনুপস্থিত। দিতে হয় না কোনো নজর নেওয়াজ।
মাজারটি মূল আকার-আকৃতি হারিয়েছে। সমাধিতে ৪ জন অলির মাজার রয়েছে এটা সঠিক। এ ৪ জন অলির নামে গ্রামটির নাম অলিপুর হয়েছে বলে অধিকাংশ গ্রামবাসীর নিশ্চিত ধারণা। প্রতি বছর ২৫ মাঘ চার অলির মাজারে ওরশ অনুষ্ঠিত হয়।
মসজিদ দুটি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার সুবিধার্থে প্রচুর ওয়াক্ফ সম্পত্তি ছিলো। বর্তমানে যার সবটুকুই ক্রমান্বয়ে নানাজনের দখলে চলে গেছে। যেগুলো আর উদ্ধার সম্ভব হয়নি। প্রায় একশ’ বছর পূর্বে এ মসজিদের মোতওয়াল্লী ছিলেন সৈয়দ দাইমউদ্দিন মোল্লা।
১৬১৮ থেকে ১৬৪৮ সাল পর্যন্ত সারা ইউরোপে প্রটেস্ট্যান্ট ও ক্যাথলিক সম্প্রদায়ভুক্ত খ্রিস্টান রাজ্যগুলোর মধ্যে দারুণ যুদ্ধ-বিগ্রহ চলছিলো। ১৬৪৮ সালে ওয়েস্ট ফিলিয়ার সন্ধির দ্বারা এই যুদ্ধের অবসান হয়, স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে সুইজারল্যান্ড আত্মপ্রকাশ করে। সে বছর অলিপুর গ্রামে শাহ সুজার পদার্পণ ঘটে। তিনি তখন বাংলার সুবেদার ছিলেন। তার আগমন উপলক্ষে এই লোকালয়ে প্রথম তিন গম্বুজ মসজিদটি নির্মাণ করা হয়। এই মসজিদটি নির্মাণের ১০ বছর পর আওরঙ্গজেব সম্রাট হিসেবে দিল্লীর সিংহাসনে আরোহন করেন। আওরঙ্গজেব ৪৯ বছর দিল্লীর সম্রাট ছিলেন। তাঁর আমলে অলিপুর এলাকায় বর্ধিষ্ণু লোকালয় ছিলো এবং অমাত্যবৃন্দের নামাজ আদায়ের স্থান সঙ্কুলানের জন্যে ১৭০২ সালে দ্বিতীয় মসজিদটি নির্মাণ করা হয়।
চাঁদপুর শহরের সৃষ্টি দু’শ’ বছরের নয়, প্রায় পাঁচশ’ বছর পূর্বের। অলিপুর বড় মসজিদটির আঙ্গিনায় পাথরের তৈরি একটি বিষ্ণু মূর্তি অঙ্কিত বেদী আছে যা প্রায় দুই হাজার বছর পূর্বের তৈরি। মসজিদ বাড়িটির নামও ঠাকুরবাড়ি।
তথ্য সূত্রঃ
২. একেএম আমজাদ হোসাইন, কনসেপ্ট অব পাকিস্তান, ৪ নভেম্বর, ১৯৬৫।
২. কাজী শাহাদাত, দৈণিক চাঁদপুর কণ্ঠ, ২৭ মে ১৯৯৯।
৩. কাজী শাহাদাত, দৈণিক চাঁদপুর কণ্ঠ, ২ আগস্ট ১৯৯৯।
৪. আঞ্চলিক পরিচালক, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, স্মারক নং- চ-১০/৯৫
৫. লেখকের পৈত্রিক সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যাবলি।
৬. চাঁদপুর জেলার পুরাতন থাক্-নকশা।
লোহাগড়া মঠ-একটি কিংবদন্তীর নিদর্শন
ফরিদগঞ্জ উপজেলার চান্দ্রা বাজার থেকে দেড় কিলোমিটার দক্ষিণ পশ্চিমে ‘লোহাগড়া’ গ্রামের মঠটি কিংবদন্তীর সাক্ষী হিসেবে এখনো দন্ডায়মান। পরম প্রতাপশালী জমিদার পরিবারের দু’ভাই ‘লোহা’ ও গহড়’ এতোই প্রভাবশালী ছিলো যে, এরা যখন যা ইচ্ছা তা-ই করতেন এবং তা প্রতিফলিত করে আনন্দ অনুভব করতেন। এই দুই ভাইয়ের নামানুসারে গ্রামের নাম রাখা হয় ‘লোহাগড়’। জনৈক ব্রিটিশ পরিব্রাজক লোহাগড় গ্রাম পরিদর্শনে গেলে তাদের আভিজাত্য দেখে বিমুগ্ধ হন। কথিত আছে, ওই পরিব্রাজকের জন্যে নদীর কুল হতে তাদের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা, যার প্রস্থ ২ হাত, উচ্চতা ১ হাত, দৈর্ঘ্য ২০০ হাত সিকি ও আধুলি মুদ্রা দিয়ে নির্মাণ করেন। (এটি বর্তমানে বিলুপ্ত) সাধারণ মানুষ এদের বাড়ির সামনে দিয়ে ভয়ে চলাফেরা পর্যন্ত করতো না। বাড়ির সামনে দিয়ে ডাকাতিয়া নদীতে নৌকাগুলো নিঃশব্দে যাতায়াত করতে হতো। ডাকাতিয়া নদীর কূলে তাদের বাড়ির অবস্থানের নির্দেশিকা স্বরূপ সুউচ্চ মঠটি নির্মাণ করেন। তাদের আর্থিক প্রতিপত্তির নিদর্শন স্বরূপ মঠের শিখরে একটি স্বর্ণদন্ড স্থাপন করেন। এই স্বর্ণদন্ডের লোভে মঠের শিখরে ওঠার প্রচেষ্টায় কেউ কেউ মৃত্যুবরণ করেছেন বলে শোনা যায়। এই বৃহৎ স্বর্ণদন্ডটি পরবর্তীকালে ঝড়-তুফানে মঠ শিখর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নদীতে পড়ে যায় এবং নদী তটের জমি চাষ করার সময় একজন কৃষক পেয়েছিলেন বলে জানা যায়। লোকমুখে শোনা যায়, এই স্বর্ণদন্ডটি প্রায় আড়াই মণ ওজনের ছিলো।
লোহাগড়ের এই দুই ভাইয়ের প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ এখনো বিদ্যমান। এখানে মাটির নিচে গহবর এখনো বিদ্যমান। মঠটি এখন দর্শনীয় স্থানে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন বহু মানুষ মঠটি দেখতে আসে।
মঠটি এখনও দাঁড়িয়ে আছে দুই ভাইয়ের দোর্দন্ড প্রতাপের নীরব সাক্ষী হয়ে। কথিত আছে, নবাব সিরাজউদ্দৌলার রাজত্বকালে, ১৭৫৭ সালের কিছুকাল আগে নবাব সিরাজ-উদ্-দৌলার সভাসদ রাজ বল্লভের ছেলে কৃষ্ণ বল্লভ নবাব রাজত্বের আদায়কৃত খাজনার বিপুল অর্থসহ পালিয়ে ফরিদগঞ্জ এলাকার এক অত্যাচারী জমিদারের আশ্রয় নিয়েছিলেন। ওই জমিদার পরিবারের বসবাস ছিলো বর্তমান লোহাগড় গ্রামে। প্রায় ২০০ বছরের পুরানো লোহাগড়ের মঠটি অত্যাচারী জমিদারদের অত্যাচারের নীরব সাক্ষী হিসেবে আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে আর সরকারিভাবে কোনো পরিচর্যা না থাকায় পুরানো স্মৃতি বিজড়িত প্রাচীন নিদর্শনটি সবার স্মৃতি থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে। ফরিদগঞ্জ উপজেলার সদর থেকে এর দূরত্ব ৫ কিলোমিটার।
হাজীগঞ্জ ঐতিহাসিক বড় মসজিদ
বিরল কারুকার্য খচিত কর্মকুশলতার অনন্য নিদর্শন। উপমহাদেশের সর্ববৃহৎ মসজিদগুলোর অন্যতম, জুমাতুল বিদার বৃহত্তম জামাতের মসজিদ হিসেবে খ্যাত, রহমত ও কারামতপূর্ণ চাঁদপুর জেলাধীন হাজীগঞ্জ উপজেলার প্রাণকেন্দ্রে বিশাল এলাকাজুড়ে অবস্থিত হাজীগঞ্জ ঐতিহাসিক বড় মসজিদ। মসজিদটি নিয়্যত-মানতের অর্থে পরিচালিত আহমাদ আলী পাটওয়ারী ওয়াক্ফ এস্টেটের একটি ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান। ধর্মীয় সর্বপ্রকার আচার-অনুষ্ঠান পালনের পাশাপাশি দ্বীনের সম্প্রসারণ ও মানব কল্যাণে সামাজিক কর্মকান্ডের বাস্তবায়নকারী এক অনন্য প্রতিষ্ঠান।
বাংলা একাদশ শতকের কাছাকাছি সময়ে মকিম উদ্দিন (রঃ) নামে এক বুজুর্গ অলিয়ে কামেল ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে পবিত্র আরব ভূমি হতে সপরিবারে চাঁদপুরের বর্তমান হাজীগঞ্জ অঞ্চলে আসেন। ইসলাম ধর্মের আবাদে তাঁর নামানুসারে এলাকাটির নামকরণ হয় মকিমাবাদ। তাঁরই বংশের শেষ পুরুষ হাজী মনিরুদ্দিন (মনাই হাজী) (রঃ) কর্তৃক সুন্নাতে রাসূল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত দোকান হতে হাজী দোকান, তা থেকে হাজীর বাজার এবং পরবর্তীকালে আজকের হাজীগঞ্জ গড়ে ওঠে। মনাই হাজী (রঃ)-এর প্রপৌত্র হাজী আহমাদ আলী পাটওয়ারী (রঃ) হাজীগঞ্জ ঐতিহাসিক বড় মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা ও ওয়াকীফ।
হাজীগঞ্জ ঐতিহাসিক বড় মসজিদটি একচালা খড়ের এবাদতখানা থেকে খড়ের দোচালা ও তারপর দোচালা টিনের মসজিদ। পর্যায়ক্রমে ১৩৩৭ বঙ্গাব্দের ১৭ আশ্বিন হযরত মাওলানা আবুল ফারাহ জৈনপুরী (রঃ)-এর পবিত্র হাতে পাকা মসজিদের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করানো হয়। কাজ সমাপ্তির পর মর্মর পাথরের মূল মসজিদটিতে বাংলা ১৩৪৪ সনের ১০ অগ্রহায়ণ প্রথম জুমার নামাজের আযান দেয়া হয়। উক্ত জুমার নামাজে উপস্থিত হন অবিভক্ত বাংলার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী একেএম ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, নওয়াব মোশারফ হোসেন ও নওয়াবজাদা খাজা নসরুল্লাহ্সহ গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ। উক্ত দিবসে নামাজের ইমামতি করেন পীরে কামেল আলহাজ্ব হযরত মাওলানা আবুল বাশার জৈনপুরী (রঃ)।
অঙ্গীকার
চাঁদপুরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত লেকের ওপর স্থাপিত একটি স্বাধীনতা ভাস্কর্য। চাঁদপুরের ২য় জেলা প্রশাসক জনাব এসএম শামসুল আলমের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে ‘অঙ্গীকার’ ভাস্কর্যটি নির্মিত হয়। প্রত্যহ বিকেল হতে সন্ধ্যা পর্যন্ত শহরের বিভিন্ন স্থান হতে এখানে প্রচুর লোকের সমাগম হয়। এ ভাস্কর্যের নয়নাভিরাম শিল্প-শৈলী শিল্প সমঝদারদের মুগ্ধ করে।
শপথ
চাঁদপুর পৌরসভার আর্থিক সহায়তা ও ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমির শৈল্পিক ও আঙ্গিক ব্যঞ্জনায় মূর্ত স্বাধীনতা ভাস্কর্য ‘শপথ’ ২০০০ সালে চাঁদপুর শহরের প্রাণকেন্দ্রে নির্মিত হয়। এই ভাস্কর্যে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের চেতনা ও চাঁদপুরের ঐতিহ্য রূপালী ইলিশের বিমূর্ত প্রতীক স্থান পেয়েছে।
মৎস্য গবেষণা কেন্দ্র
চাঁদপুরে একটি মৎস্য গবেষণা কেন্দ্র আছে। এটি চাঁদপুর শহরের অদূরে ষোলঘর নামক স্থানে অবস্থিত। এখানে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে উন্নত জাতের মৎস্য পোনা উৎপাদনের নিমিত্তে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।
আইসিডিডিআরবি
আইসিডিডিআরবি মতলব উপজেলায় অবস্থিত বিদেশী সাহায্যে নির্মিত একটি কলেরা নিরাময় কেন্দ্র। এটি আধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জামাদি দ্বারা সুসজ্জিত একটি হাসপাতাল। মতলব উপজেলার মেঘনা-ধনাগোদা নদীবেষ্টিত ১৪টি ইউনিয়নকে কলেরা প্রবণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই অঞ্চলে অসংখ্য লোক পূর্বে কলেরায় অকালে মৃত্যুবরণ করতো। বর্তমানে আইসিডিডিআরবি’র ইনডোর এবং আউটডোরে চিকিৎসা সেবা প্রদানের মাধ্যমে কলেরাকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে।
পদ্মা-মেঘনার মিলনস্থল
চাঁদপুর শহরের সর্বপশ্চিমে রেলওয়ে বড় স্টেশনের নিকটে পদ্মা-মেঘনার মিলনস্থল অবস্থিত। এই মিলনস্থলে সূর্যাস্তের দৃশ্য সাগর-সৈকতের দৃশ্যকেও হার মানায়।
শ্রীশ্রী জগন্নাথ মন্দির
শ্রী গঙ্গাগোবিন্দ সেন এই মন্দির ১২৭৭ বঙ্গাব্দে প্রতিষ্ঠা করেন। স্থানীয় লোকদের নিকট হতে জানা যায়, গঙ্গা গোবিন্দ সেন রথযাত্রা উপলক্ষে জগন্নাথ দেবকে দর্শন করার জন্যে ভারতের শ্রীক্ষেত্রে যান। অনেক চেষ্টা করার পরেও তিনি জগন্নাথ দেবকে দেখতে না পেয়ে মনের দুঃখে কান্নাকাটি করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েন এবং স্বপ্নে দেখেন ‘তুমি দুঃখ করিও না, আমি নিজেই তোমার আবাসস্থল সাচারে নিজ বাড়িতে আবির্ভূত হইব’। তখন গঙ্গা গোবিন্দ বাড়িতে আসেন এবং কয়েকদিন পর তার বাড়ির দিঘিতে অলৌকিকভাবে ভেসে আসা নিম কাঠ দেখতে পান, যা’ দ্বারা কচুয়ার বিখ্যাত সাচারের রথ এবং দেব-দেবী নির্মিত হয়।
মনসামুড়া
এই মুড়া কচুয়া থানায় অবস্থিত। বর্তমানে উক্ত স্থানে ১৩টি বাঁশঝাড় আছে। উক্ত ঝাড়ের চারদিকে অনেক সাপের গর্ত আছে। জানা যায়, হিন্দুদের মনসা দেবীর সেখানে অবস্থান। হিন্দুরা প্রতি বছর চৈত্র মাসে এই মুড়ায় পূজা-অর্চনা করে। এই উপলক্ষে মেলা বসে। হিন্দুরা অনেক মানত করে এবং দুধ-কলা দিয়ে পূজা করে। শুধু তাই নয়, এই বাঁশ ঝাড়ের বাঁশ কেউ কাটে না।
সাহার পাড়ের দিঘি
কচুয়া উপজেলার রহিমানগর বাজার হতে মাত্র ৫০০ মিটার দূরে কচুয়া-কালিয়াপাড়া সড়কের পূর্ব পার্শ্বে এই দিঘি অবস্থিত। ৬১ একর আয়তন বিশিষ্ট এই দিঘির সুউচ্চ পাড় এবং পাড়ের ওপর সুবৃহৎ বৃক্ষরাজির চমৎকার দৃশ্য, যা সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। জানা যায়, বহুকাল পূর্বে এই এলাকায় ছিলো কড়িয়া রাজা নামে এক প্রতাপশালী রাজা। তার আমলে কড়ির মুদ্রা প্রচলিত ছিলো। একদা কড়িয়া রাজা ব্যাপক আয়োজনভিত্তিক এক পূজা অনুষ্ঠান উপলক্ষে পানীয় জলের সঙ্কট নিরসনকল্পে এবং নিজের নামকে কালজয়ী রাখার মানসে কড়ির বিনিময়ে একটি দিঘি খনন করেন এবং দিঘির নাম কড়িয়া রাজার দিঘি নামকরণ করেন। তার ইচ্ছা পূরণার্থে তার মন্ত্রী সাহাকে এই দিঘি খনন করার নির্দেশ প্রদান করেন। মন্ত্রী সাহা নির্দেশ পেয়ে দিঘি খনন করান। দিঘি খনন কাজে অংশ নেয় বহু নর-নারী। যারা খনন কাজে অংশ নেয় তাদেরকে প্রতি খাঞ্চি মাটি কাটার বিনিময়ে এক খাঞ্চি করে কড়িমুদ্রা দেয়া হয়। দিঘি খনন শেষে মন্ত্রী সাহা উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে তার নামে দিঘির নাম প্রচার করেন। দিঘি নামকরণে মন্ত্রীর চাতুরিপনার খবর পেয়ে কড়িয়া রাজা ক্ষুব্ধ হন এবং তাকে প্রাণদন্ডে দন্ডিত করেন। মন্ত্রীকে প্রাণদন্ড দেয়া হলেও এই দিঘির নাম মন্ত্রীর নামে অর্থাৎ সাহার পাড়ের দিঘিই লোকমুখে থেকে যায়।
ছোট সুন্দর গ্রামের এক গম্বুজ ধ্বংসপ্রাপ্ত মসজিদ
চাঁদপুর জেলা শহর থেকে ১৪ কিলোমিটার পূর্বে ডাকাতিয়া নদীর কোল ঘেঁষে সুন্দর একটি গ্রাম। নাম ছোট সুন্দর। এ গ্রামে ছোট আকারের একটি দিঘি আছে। দিঘির চারপাশ জনবসতিহীন। এর দক্ষিণ-পূর্ব কোণে নানা গাছ ও লতাগুল্মের একটি বড় ঝোঁপ রয়েছে। এই ঝোঁপের ভেতর লুকিয়ে আছে একটি অনিন্দ্যসুন্দর প্রত্নসম্পদ। এক গম্বুজ বিশিষ্ট একটি ছোট মসজিদ। দেয়ালগুলো চল্লিশ ইঞ্চি পুরু। মেহরাব রয়েছে, রয়েছে বাতি জ্বালানোর জন্যে কার্নিশ। সবই অটুট। মাত্র ছয়/সাত জন লোক এখানে নামাজ পড়তে পারতো। একটি বিশাল ঝির গাছের শেকড় সমস্ত মসজিদটি ঢেকে ফেলেছিলো। গত দুই শতাব্দী এখানে কেউ নামাজ পড়েছে বলে মনে হয় না। মসজিদটি সংস্কার করে দর্শনার্থীদের দেখার সুযোগ করে দিলে ইতিহাস সম্বন্ধে অনেক কিছু জানতে পারবে এদেশবাসী।
উজানী বখতিয়ার খাঁ মসজিদ
কচুয়া উপজেলা সদর থেকে তিন কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে উজানী গ্রাম। বর্তমানে এ গ্রামে আছে একটি বিখ্যাত মাদ্রাসা। মাদ্রাসার দক্ষিণ পাশে আছে একটি দিঘি। তার পশ্চিম পাড়ে আছে এক গম্বুজ বিশিষ্ট একটি সুদৃশ্য মসজিদ। এটি বক্তার খাঁ শাহী মসজিদ নামে খ্যাত। এক সময় উজানী গ্রামটি বনজঙ্গলে আচ্ছাদিত ছিলো। ক্বারী ইব্রাহিম সাহেব বন-জঙ্গল পরিষ্কার করে এখানে বসবাস করতে শুরু করেন। তিনি ছিলেন একজন অত্যন্ত কামেল পুরুষ। তিনি এ মসজিদটিকে ব্যবহার্য করে তোলেন। মসজিদে প্রাপ্ত একটি শিলালিপিতে আছে, ‘‘পরম দয়ালু আল্লাহ্তায়ালার নামে আরম্ভ করিতেছি। আল্লাহ্ এক, তাহার কোনো শরীক নাই। মোহাম্মদ তাহার রাসূল। বাদশাহ বাহাদুর শাহ্ গাজীর শাসনামলে খাদেম আবুল হোসেন খাঁর পুত্র ইলিয়াস খাঁর পৌত্র’’।
উল্লেখ্য যে, এই উজানী গ্রামেই আছে হযরত নেয়ামত শাহের দরগাহ। যিনি হযরত শাহজালাল (রঃ)-এর একজন সঙ্গী ছিলেন। উজানী গ্রামে একজন বিখ্যাত ফৌজদার ছিলেন। তার নাম ছিলো বখতিয়ার খাঁ। তিনি মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন। নির্মাণ সাল ১৭৭২। উজানী একটি প্রাচীন গ্রাম। এ গ্রামের নাম পাওয়া যায় মধ্যযুগের মনসামঙ্গল কাব্যে ‘উজানী নগর’ হিসেবে। শোনা যায়, বেহুলা লখিন্দরের লোহার তৈরি বাসরঘর এ গ্রামে ছিলো। যা মাটির নিচে দেবে গেছে। বেহুলার শীল নোড়ার কথিত অংশবিশেষ এখনো এ গ্রামে রয়ে গেছে। লোকজন এখনো এগুলো দেখতে আসে।
নাটেশ্বর রায়ের দিঘি
শাহরাস্তি উপজেলার চিতোষী ইউনিয়নের সর্বশেষ সীমায় রয়েছে নাটেশ্বর রাজার ত্রিশ একর আয়তনবিশিষ্ট দিঘি। এটির উত্তর পাড়ে রয়েছে কোতোয়াল হায়াতে আবদুল করিম নির্মিত অনিন্দ্যসুন্দর মসজিদ। পূর্ব পাড়ে রয়েছে শাহ শরীফ বোগদাদীর মাজার। জনশ্রুতি রয়েছে, হযরত শাহ শরীফ বোগদাদী ছিলেন হযরত শাহজালালের অনুগামী।
কড়ইতলী জমিদার বাড়ি (ফরিদগঞ্জ)
কড়ইতলী গ্রামে রয়েছে এক কুখ্যাত অত্যাচারী জমিদারের বাড়ি। বাড়িটিতে রয়েছে দুর্গামন্দির, ভগ্ন ত্রিতল প্রাসাদ, মনসা মন্দির, অাঁধার মানিক ও সুড়ঙ্গপথ। ১২২০ বঙ্গাব্দে বরিশাল জেলার অধিবাসী হরিশচন্দ্র বসু নিলাম সূত্রে কড়ইতলী জমিদার বাড়িটি ক্রয় করেন এবং ৪১.১০ একর জমির ওপর এই বিশাল বাড়িটি নির্মাণ করেন। ১২৯০ সালে শতায়ু হরিশ চন্দ্র বসু পরলোকগমন করেন। তার পুত্র গোবিন্দ বসু জমিদারির মালিক হন। অত্যাচারী এই জমিদারের মৃত্যুর পর তার উত্তরাধিকারীগণ হীনবল হয়ে পড়ে এবং ভারত স্বাধীন হলে ১৯৫১ সালে তারা জনরোষে পড়ে রাতের অন্ধকারে বিষয় সম্পত্তি ফেলে রেখে ভারতে পলায়ন করে।
ভিঙ্গুলিয়া মসজিদ (হাইমচর)
হাইমচরের ভিঙ্গুলিয়া গ্রামের মল্লিক বাড়িতে রয়েছে একটি তিন গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ ও মসজিদের প্রাঙ্গণে রয়েছে কিছু বাঁধানো প্রাচীন কবর। লোকে বলে, মলুকজান বিবির মসজিদ। শিলালিপি থেকে যতদূর পাঠোদ্ধার সম্ভব হয়েছে তাতে জানা যায়, মসজিদটি ঈসা খাঁর আমলে জালালপুরের মল্লিক খেতাবপ্রাপ্ত কোনো শাসক নির্মাণ করেছিলেন। বাড়ির চারপাশে পরিখা খনন করা আছে। লোকে বলে, মল্লিক বাড়ি। মল্লিক বাড়ি হচ্ছে ঈসা খাঁর আমলে প্রশাসকের পদবী। জনশ্রুতি আছে, মেঘনায় বিলীন হওয়া হিঙ্গুলিয়া গ্রামেও অনুরূপ তিন গম্বুজ বিশিষ্ট একটি মসজিদ ছিলো। ভিঙ্গুলিয়া মসজিদে একটি শিলালিপি আছে। ‘চাখতা মুল্লুকে জাঁহার রেজামন্দির জন্য মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছে। মসজিদ নির্মাণকারীকে শত জান্নাত দান করা হবে।’ -প্রথমে পরম দয়ালুময় আল্লাহর নামে শপথ করিতেছি। ২। আল্লাহ্ এক, মোহাম্মদ (সাঃ) তাঁর রাসূল ৩। এই মোবারক মসজিদ জগতের মালিকের সন্তুষ্টির জন্য স্থাপন করা হয়েছে। ৪। মসজিদ স্থাপনকারী শত জান্নাত পাইবে। উপরে দেখ ইতিহাসের তারিখ ১১০০ হিজরী সনে পৌঁছাইয়াছে।
মসজিদের পাশে একজন মানুষের পাকা কবর রয়েছে। মসজিদ সংলগ্ন এলাকায় আরো দুটো পাকা কবর রয়েছে।
পালগিরি মসজিদ (কচুয়া)
এখানে একটি এক গম্বুজ মসজিদ রয়েছে। মসজিদটি পাঁচশ’ বছরের প্রাচীন। এখানে রয়েছে বিরাট আকারের অসম্পূর্ণ দিঘি। দিঘির পাড়ে থানা বিবি ও দুলাল রাজার কবর, পাকাঘাট। মসজিদের অদূরে রয়েছে দু’টি প্রাচীন পাকা কবর। অনুমান করা হয় এটি নির্মাতার কবরই হবে। দুলাল রাজার দিঘিটি ১৯ একর। মসজিদের পূর্ব পাশে একটি প্রাচীন নৌপথ ছিলো। ক্যাঃ আঃ রব খন্দকারের দাদা জাহনী খন্দকার ১৮০২ সালে মসজিদটি ঝোঁপের মধ্যে দেখতে পেয়ে পুনঃসংস্কার করেন। ক্যাঃ আঃ রব ৯৮ সালে ৮১ বছর বয়সে মারা যান। দুলাল রাজা ও থানা বিবি সম্পর্কে মামা শ্বশুর ও ভাগ্নে বউ ছিলেন। প্রেমের সম্পর্ক থাকলেও তাদের বিয়ে হয়নি বলে জনশ্রুতি আছে।
দারাশাহী তুলপাই মসজিদ (কচুয়া)
কচুয়া উপজেলা সদর থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত দারাশাহী তুলপাই গ্রামে রয়েছে নাগরাজ কন্যা রামেশ্বরী দেবী ও হযরত দারাশাহের অমর প্রেমের স্মৃতিতে নির্মিত তিন গম্বুজ মসজিদ, শেখ দারা রামেশ্বরীর ত্রিতল ভগ্নপ্রাসাদ। ষোড়শ’ শতাব্দীতে সুদূর আরব দেশীয় এক যুবক প্রশাসক দিল্লীর সম্রাট কর্তৃক নিয়োজিত হয়ে বর্তমান কচুয়ার তুলপাই অঞ্চলে আসেন। তিনি নাগরাজ কন্যা রামেশ্বরী দেবীর প্রেমে পড়েন এবং এক যুদ্ধের পর নাগরাজাকে পরাজিত করে রামেশ্বরী দেবীকে বিয়ে করেন। বর্তমানে দারাশাহী তুলপাই গ্রামে তার মাজার রয়েছে। প্রতি বছর ১৪ ডিসেম্বর মাহ্ফিল হয়। দারাশাহের স্মৃতিতে তার মৃত্যুর দু’শ বছর পর নির্মিত মসজিদের শিলালিপিতে আছে, ‘‘মহান আল্লাহর নামে শুরু করিতেছি। আল্লাহ্ এক। মোহাম্মদ তার রাসূল। নুরুজ্জামান দ্বারা মসজিদটি ১২০২ হিজরী সনে স্থাপিত।’’
আশ্রাফপুর মসজিদ (কচুয়া)
আশ্রাফপুরের তিন গম্বুজ মসজিদ। যেখানে রয়েছে আরবদেশীয় বণিকদের কবর। এখানে রয়েছে নিমাই দিঘি। মসজিদটি বাংলার স্বাধীন সুলতানদের আমলে নির্মিত হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। এখানে রয়েছে অনেকগুলো প্রাচীন পাকা কবর। জনশ্রুতি রয়েছে, এগুলো আরবীয় বণিকদের তৈরি।
মির্জা হোসেন আলী মসজিদ, নারায়ণপুর (মতলব দঃ)
নারায়ণপুর বাজারে রয়েছে বরদাখাতের জমিদার মির্জা হোসেন আলীর এক গম্বুজ মসজিদ ও দিঘির উত্তর পাড়ে পাঁচ শতাধিক বছরের প্রাচীন কালীবাড়ি। কোল ঘেঁষেই বোয়ালজুরি খাল।
রাগৈ মসজিদ (শাহরাস্তি)
রাগৈ গ্রামে রয়েছে শেরশাহের আমলের একটি প্রাচীন মসজিদ। মসজিদটি জনৈক আন্তি মজুমদার পুনঃনির্মাণ করেছিলেন। মসজিদটি তিন গম্বুজ বিশিষ্ট। মসজিদের গায়ে একটি শিলালিপি রয়েছে, ‘‘পরম করুণাময় দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করিতেছি। ২। আল্লাহর কোনো শরীক নাই। ৩। আইনুদ্দিনের মতোই আল্লাহর ঘর নির্মাণ করিলেন। ৪। মাথা ও কপাল স্পর্শ করিয়া আল্লাহ্তায়ালার সন্তুষ্টির জন্য। পুনঃনির্মাণ ১২১৪ হিজরী নববী।’’
শাহমাহমুদের (রঃ) মাজার (চাঁদপুর সদর)
হযরত শাহ মুহাম্মদ বাগদাদী (রঃ)-এর মাজার (শাহ মাহমুদ) শাহতলী রেল স্টেশনের নিকটবর্তী খন্দকার বাড়িতে শাহ মুহাম্মদ বাগদাদীর মাজার অবস্থিত। তিনি বাগদাদের অধিবাসী ছিলেন। সুলতান সামসুদ্দিন ফিরোজ শাহের (১৩০১-১৩২২ খ্রিঃ সাল) নিকট হতে শাহতলী মৌজাটি নিষ্কর সম্পত্তি হিসেবে লাভ করেন। শাহ মাহমুদ বাগদাদী জাহাজ যোগে বাগদাদ শহর থেকে চাঁদপুর এসেছিলেন। এই অঞ্চলে ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্যে তার অবদান বিশেষভাবে স্মরণীয়। তিনি রাস্তি শাহের সমসাময়িক শাহ মখদুম দৌলার সাথে পূর্ব বাংলায় এসেছিলেন। এখানে রয়েছে অনেকগুলো মাজার, তার মধ্যে পাগলা বিবির মাজার, পীর আলীসহ অন্যদের মাজার। কিংবদন্তী আছে, হযরত শাহ মাহমুদ এ অঞ্চলে প্রথম প্রশাসনিক শৃঙ্খলা আনয়ন করেন এবং ইসলাম প্রচার করেন।
মাদ্দাখাঁ মসজিদ, আলীগঞ্জ (হাজীগঞ্জ)
হাজীগঞ্জ উপজেলা সংলগ্ন একটি প্রাচীন মাজার ও মসজিদ রয়েছে। মাজারটি অলী আলী মর্দান খানের। তিনি হযরত শাহজালালের সময় তার সাথী হিসেবে ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে আলীগঞ্জ এলাকায় এসেছিলেন। হযরত মাদ্দা খাঁর মৃত্যুর ৩৫০ বছর পর ১৭৩৮ সালে একটি মসজিদ স্থাপিত হয়।
উত্তর মৈশাদী শেখ এনায়েত উল্লাহ্র মসজিদ
শহরের সন্নিকটে অবস্থিত উত্তর মৈশাদী গ্রামে রয়েছে একটি বিরাট দিঘি। দিঘির পূর্ব-দক্ষিণ কোণে রয়েছে একটি প্রাচীন কবর। এখানে আছে একজন বাঁদীর কবর, কাছেই রয়েছে ধ্বংসপ্রাপ্ত একটি কুয়া, পশ্চিম কোণে ছিলো একটি মসজিদ, যা বর্তমানে ধ্বংসপ্রাপ্ত। এলাকায় চতুর্দশ শতকে একজন সাধক বাস করতেন তার নাম হযরত শেখ এনায়েত উল্লাহ। তিনি এ অঞ্চলে ধর্মপ্রচার করার জন্যে আসেন। দিঘিটির নাম গোলা বাড়ি দিঘি। কথিত আছে, মায়ের আদেশে বাদীর কবরে সকল অলঙ্কার দিয়ে দেন শেখ এনায়েত উল্লাহ্। পরে কবর থেকে অলঙ্কারগুলো চুরি হয়ে গেলে শেখ এনায়েত উল্লাহ্ এলাকা ছেড়ে চলে যান। শেখ এনায়েত উল্লাহ্ একজন শাসক ছিলেন। মসজিদ পুনঃনির্মাণকালে অনেক কড়ি পাওয়া যায়।
আমান শাহ ফকিরের পুল, হাজীগঞ্জ
কচুয়া ও হাজীগঞ্জ উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত শৈলখালী খালের ওপর একটি পাকা পুল নির্মাণ করেন তৎকালীন শাসক। চাঁদপুর জেলার এই পুলটি সর্বপ্রাচীন এবং ইট দ্বারা নির্মাণ করা হয়েছে। পুলটি ১৩৩৪-৪২ সনে ফখরুদ্দিন মুবারক শাহের রাজত্বকালে স্থানীয় শাসক আমান শাহ কর্তৃক নির্মিত হয়েছিলো বলে জনশ্রুতি আছে। লাউকরা গ্রামে আমান শাহ ফকিরের ভগ্ন প্রাসাদ ও ভূমিকম্পে ধ্বংসপ্রাপ্ত মসজিদ রয়েছে। পাশেই রয়েছে প্রাচীন কবর। ভগ্ন প্রাসাদটিকে লোকে ফকিরের ভিটা বলে।
নাওড়া মঠ (শাহরাস্তি)
তিন শতাধিক বছরের প্রাচীন একটি মঠ রয়েছে নাওড়া গ্রামে। সাহাপুর রাজবাড়ির দেওয়ান সত্যরাম মজুমদার ১১৯৯ সনে মঠটিকে নির্মাণ করেছিলেন। বর্তমানে মঠটি সুন্দর অবস্থায় রয়েছে।
সাহাপুর রাজবাড়ি (শাহরাস্তি)
প্রায় পাঁচশ’ বছরের প্রাচীন একটি রাজবাড়ি রয়েছে শাহরাস্তি উপজেলার সাহাপুর গ্রামে। সাহাপুর ছিলো প্রাচীন মেহের পরগণার রাজধানী। এখানে রয়েছে রাজাদের প্রাসাদ, রাজবাড়ি প্রাচীর, পাহারা চৌকি, ঠাকুরমন্দির, দুর্গামন্দির, নাট্যশালা প্রভৃতি। সোনারগাঁও রাজ্যের দু’আনা অংশের মালিক ছিলো দাশরাজ বংশ।
রাজা শিবানন্দ রায় এই বংশের প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ছিলেন সাধক জটাধরের পিতা। সদানন্দের ১০ম পুরুষ। সাহাপুরের শ্রেষ্ঠ জমিদার প্রয়াত ভুপেষ রায় চৌধুরী। তার জন্ম ১৩১৭ বাংলা সালের ২ আশ্বিন। পিতা মৃত হরকুমার রায় চৌধুরী। তিনি জানান, ছয়শ’ বছর পূর্বে এই রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা শিবানন্দ খাঁ নিজমেহের হতে সাহাপুর আসেন এবং এই রাজবাড়িটি নির্মাণ করেন।
নাসিরকোর্ট (হাজীগঞ্জ)
নাসিরকোর্ট গ্রামটি হাজীগঞ্জ উপজেলা সদর হতে প্রায় ১০ মাইল উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত। নবাব সিরাজ-উদ্-দৌলার সময় কচুয়া থানার আলীয়ারায় ক্ষত্রিয় রাজা অযোধ্যারাম ছেদ্দা নিজেকে স্বাধীন নরপতি হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। নবাব সিরাজ-উদ্-দৌলা তাকে দমনের জন্য সেনাপতি নাসির খানকে প্রেরণ করেন। নাসির খান এখানে একটি দুর্গ নির্মাণ করেন। যুদ্ধে ছেদ্দা পরাজিত ও নিহত হন। কোর্ট অর্থাৎ দুর্গ। তাই নাসির খানের দুর্গের জন্যেই এই গ্রামের নাম হয় নাসিরকোর্ট।
বর্তমানে এখানে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের গণকবর, শহীদ স্মৃতি কলেজ, উচ্চ বিদ্যালয়, একটি বিশালাকার দিঘি। ১৯৭১ সনের মুক্তিযুদ্ধে এখানে মুক্তিযোদ্ধাদের আঞ্চলিক সদর দফতর ছিলো।
কাশিমপুর রাজবাড়ি বারদুয়ারী (মতলব দঃ)
মতলব (দঃ) উপজেলার নারায়ণপুর গ্রামের কাশিমপুর গ্রামে রয়েছে নাগরাজাদের বাড়ি। এক সময় ছিলো নারায়ণপুর পরগণার সদর দফতর।
নাগরাজাদের জমি ছিলো ৮৫৩১ একর, মহালের সংখ্যা ছিলো ১০টি, রাজস্ব ছিলো ৪৩৮৭ টাকা এই হিসাব ১৭৭৩-৭৪ সালের।
পাঁচ শতাধিক বছরের পুরানো নাগরাজ বাড়িতে রয়েছে অনেক প্রাসাদ ও স্থাপনা। বাড়িটি বারদুয়ারী নামে প্রসিদ্ধ। এখানে একটি সুউচ্চ মঠ রয়েছে। লোকে বলে রাজার মঠ। পাশেই ছোট একটি মঠ বাঁদীর মঠ নামে পরিচিত।
বোয়ালজুরি খালের দু’পাড়ে দুটি জমিদারি ছিলো এবং ওখানে সংঘটিত হয়েছিলো একটি যুদ্ধ, নাগরাজা (রামেশ্বরী দেবীর পিতা) ও দারাশাহের মধ্যে। যুদ্ধে জয়লাভ করে দারাশাহ প্রেমিকা রামেশ্বরী দেবীকে বিয়ে করেন। তুলপাই গ্রামে রয়েছে রামেশ্বরী দেবীর ত্রিতল প্রাসাদের ভগ্নাংশ। বিয়ের পর তিনি শেখ দারা রামেশ্বরী দেবী নামে জমিদারি পরিচালনা করতেন। চাঁদপুরের গান্ধী হিসেবে পরিচিত হরদয়াল নাগ এই রাজবাড়ির অধস্তন পুরুষ। তার পিতার নাম রামদয়াল নাগ।
ঐতিহ্যের স্মারক চাঁদপুরের রূপালী ইলিশ
ঐতিহ্য কথাটির আভিধানিক অর্থ হচ্ছে পুরুষানুক্রমিক ধারা বা পরম্পরাগত কথা বা প্রথা কিংবা কিংবদন্তি। ইংরেজিতে ঐতিহ্যকে ‘Tradition’বলা হয়েছে। স্মারক শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে স্মৃতির উদ্বোধক, যা মনে করিয়ে দেয়। ইংরেজিতে Memorial. আমাদের গর্ব ঐতিহ্যের স্মারক চাঁদপুরের রূপালী ইলিশ। ইলিশের কথা উঠলেই চাঁদপুরের কথা ওঠে। চাঁদপুরের কথা ওঠলেই ইলিশের কথা ওঠে। ইলিশ আর চাঁদপুর হরিহর আত্মা। চকচকে রূপালী ইলিশ আর চাঁদপুরের সখ্যতা হাজার বছরের প্রাচীন। বাংলা অঞ্চলের লোক সাহিত্য-সংস্কৃতিতে রূপালী ইলিশ অচ্ছেদ্য বন্ধনে সম্পৃক্ত। রূপালী ইলিশকে বাদ দিয়ে চাঁদপুরকে কল্পনা করা যায় না।
আমরা খুবই গর্ব অনুভব করি যখন দেখি ইলিশ বাংলাদেশের জাতীয় মাছ। দেশের অর্থনীতি এবং কর্মসংস্থানসহ আমিষ জাতীয় খাদ্য সরবরাহে ইলিশ অনন্য ভূমিকা পালন করে আসছে। বর্তমানে বার্ষিক প্রায় ২.৯ লাখ মে. টন ইলিশ উৎপাদিত হচ্ছে, যার বাজার মূল্য প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা। দেশে মোট মৎস্য উৎপাদনে একক প্রজাতি হিসেবে ইলিশের অবদান প্রায় শতকরা ১২ ভাগ। রূপালি ইলিশ খেতে যেমন সুস্বাদু, খাদ্যগুণেও তেমনি সমৃদ্ধ।
পদ্মা-মেঘনা মোহনায় ইলিশ দেখতে পাতলা কোমরের রূপালী মেয়ের মতোই সুন্দর। অপূর্ব দেহ সৌষ্ঠব আর মোহময়ী মিষ্টিগন্ধের জন্যে জগৎ বিখ্যাত। এ কথা হয়তো অনেকেই জানেন না, মেঘনা নদীর পানি গুণগত ক্ষেত্রে পৃথিবীর দ্বিতীয় সেরা। প্রবল সূর্যকিরণ আর নদীর গভীরতার জন্যে পদ্মা-মেঘনার মিলিত স্রোতধারায় এক ধরনের প্লাংটন জন্মে, যা হচ্ছে ইলিশের প্রিয় খাবার। এই প্লাংটনগুলো দু’প্রকার। উদ্ভিজ্জ প্লাংটন ও প্রাণীজ প্লাংটন। এ খাদ্য ও প্রজননের প্রয়োজনে ইলিশ সাগর থেকে ছুটে আসে পদ্মা-মেঘনায়।
পুরাণবাজার বড় জামে মসজিদ
১৯০১-১৯০৬ সনের মধ্যে পুরাণবাজারের তৎকালীন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী সর্বজনাব বজলুল গণি পাটওয়ারী, ওসমান বেপারী রায়পুরের বড় পীর সাহেবের অনুরোধে নদী বন্দরের মুসলিম জনগোষ্ঠীর জন্যে একটি মসজিদ নির্মাণ করার নিমিত্তে ভূমি ওয়াক্ফ করে দেন। ওয়াক্ফকৃত ভূমিতে একটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়। কালক্রমে বিভিন্ন ব্যবসায়ী বিশেষ করে বোম্বাই থেকে আগত নাখোদা ব্যবসায়ীদের অনুদানে এই বৃহদাকার অনুপম সুন্দর মসজিদটি নির্মিত হয়। পরবর্তী সময়ে জৈনপুর ও ফুরফুরার পীর সাহেবদের অনুরোধে আয়াত আলী ভূঁইয়া, আমজাদ আখন্দ, হাজী লতিফ খান, হাজী জাফর খান প্রমুখ ব্যক্তির সহায়তায় মসজিদটি বর্তমান আকার পায়।
মঠখোলার মঠ
১৭৫৭ সালের নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পরাজয়ের পর ১৭৬১-১৭৭২ সালের মধ্যে মঠখোলার রায় পরিবারভুক্ত জমিদার ও মজুমদার পরিবারবুক্ত জমিদারবৃন্দ শিবমন্দির হিসেবে মঠটি নির্মাণ করেন। এখানে ফাল্গুন মাসে শিব চতুর্দশীর মেলা বসতো। ১৭৬৩ খ্রিঃ সনের ভূমিকম্পে নির্মাণাধীন মঠটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরে মঠটির কাজ সুষ্ঠুভাবে সমাপ্ত হয়। প্রায় এক শতাব্দি পরে স্থানীয় জমিদার কৃষ্ট মজুমদার মঠটির সংস্কার করেছিলেন। আড়াইশত বছরের পুরোনো মঠটি চাঁদপুরের একটি প্রত্নসম্পদ হিসেবে বিবেচিত।
সাচার রথ
কচুয়া উপজেলার ১নং সাচার ইউনিয়নে প্রাচীনকালে একটি জমিদার বাড়ি ছিলো। যা বর্তমানে সাচার বাজারে অবস্থিত শ্রী শ্রী জগন্নাথ ধাম। সাচারের তৎকালীন জমিদার বাড়ির পাশে ছিলো জমিদারদের রঙমহল ভবন। যা বর্তমানে জমিদারদের স্মৃতিরূপে দাঁড়িয়ে আছে। এ বাড়িতে বাস করতো গঙ্গাগোবিন্দ সেন। তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সাচার জগন্নাথ ধাম। তিনি ছিলেন এক মহান ব্যক্তিত্ব। লোভ-লালসা তার জীবনকে কখনো স্পশৃ করেনি। জগন্নাথ দর্শনের জন্য তৎকালীন সময়ে পায়ে হেঁটে তিনি ভারতের শ্রীক্ষেত্র যেতেন। বাড়ি থেকে তার প্রয়োজনীয় কাপড়-চোপড় ও শুকনো খাবার নিয়ে পদযাত্রা শুরু করতেন জগন্নাথ দর্শনে। পথিমধ্যে যেখানেই রাত হতো সেখানেই রাত্রিযাপন করতেন। কথিত আছে রাত্রিকালে শ্রী শ্রী জগন্নাথ জমিদার গঙ্গাগোবিন্দ সেনকে স্বপ্নাদেশে বলেন, ওহে গঙ্গাগোবিন্দ সেন! তোমার আর পায়ে হেঁটে শ্রীক্ষেত্রে যেতে হবে না। তুমি বাড়ি ফিরে যাও। আমিই তোমার বাড়িতে যাবো। তিনি বুঝে ওঠতে না পারলে পুনরায় তাকে স্বপ্নাদেশে বললেন, ‘তোর বাড়িতে একটি মন্দির স্থাপন করবি, তোর দিঘিতে ৩ টুকরো নিম গাছ ভেসে আসবে। এ কাঠ জয়ধ্বনি দিয়ে বাড়িতে নিবি। এ কাঠ দিয়ে জগন্নাথ, শুভদ্রা, বলরাম, শ্রীকৃষ্ণের বিগ্রহ তৈরি করার জন্য তোর কাছে অভিজ্ঞ সূত্রধর আসবে।’ স্বপ্নাদেশ মোতাবেক নিমকাঠ আসলো। বিগ্রহ তৈরিতে সূত্রধর আসলো। গোবিন্দ সেন জগন্নাথ মন্দির স্থাপন করলেন। ৩০/৪০ ফুট উঁচু একটি রথ নির্মাণ করলেন। রথটির চারপাশে চারযুগের ভবিষ্যৎ বাণী চিত্রসহ খচিত ছিলো।
কথিত আছে দ্বাপর যুগে কুরুক্ষেত্রে কুরু-পান্ডবের যুদ্ধের সময় মহাভাগ্যবান ও ভগবদ ভক্ত স্বর্গীয় গঙ্গাগোবিন্দ সেন কাশি নামক বাদ্যযন্ত্র বাজিয়েছিলেন। সেই পূণ্যের ফলে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তার বাড়িতে টুন্ডা রূপে অবতীর্ণ হন। যার রূপ দর্শন করলে পুনর্জন্ম বারণ হয় সেই জগন্নাথ টুন্ডা রূপে সাচারে স্থাপন হয়। যার কারণে বহু ভাগ্যবান হিন্দু ধর্মাবলম্বী ভক্তবৃন্দ সাচারে প্রতি বছর আষাঢ় মাসের ২য় তিথিতে জগন্নাথ দর্শনে দেশ-বিদেশ হতে সমবেত হয়। ভারতের শ্রীক্ষেত্রে জগন্নাথ দর্শনে না গিয়ে সাচারেই জগন্নাথ দর্শন করেন। সাচারের জগন্নাথ দর্শনে বাংলাদেশে ও পাশ্ববর্তী দেশগুলো থেকেও ভক্তরা আসেন।
মোলহেড
ডাকাতিয়া-মেঘনার সঙ্গমস্থলে অবস্থিত চাঁদপুর বড় স্টেশনের পশ্চিম পার্শ্বের ত্রিকোণাকার অংশটি মোল হেড নামে পরিচিত। এখানে দাঁড়ালে খুব স্পষ্টভাবে পশ্চিম দিগন্তে সূর্যাস্ত দর্শন করা যায়। ১৯২১ সনের এপ্রিল মাসে সিলেটের চা বাগানে কুলি বিদ্রোহ ও কর্মস্থল ত্যাগী শত শত চা শ্রমিকের ওপর তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের পুলিশ বাহিনীর গুলিতে এখানে শতাধিক চা শ্রমিক শহীদ হয়।
১৯৭১ সনে এখানে পাক সেনাবাহিনী শত শত মুক্তিকামী মানুষকে হত্যা করে লাশ মেঘনার পানিতে ভাসিয়ে দেয়। মোলহেডে বর্তমান সময়ে ‘রক্তধারা’ নামে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মিত হচ্ছে। মোলহেড হতে পারে দেশের অন্যতম সুন্দর ঐতিহ্যবাহী পর্যটন তীর্থ।
বেগম মসজিদ
১৮৮২ সনে ঢাকার বিখ্যাত নবাব পরিবারের এক বিদূষী বেগমের আর্থিক অনুদানে নির্মিত হয় বেগম মসজিদ নামের চাঁদপুর শহরের প্রথম মসজিদ। মসজিদ কমিটির প্রথম সম্পাদক ছিলেন গান্ধী ভক্ত অসাম্প্রদায়িক জননেতা চাঁদপুর গান্ধী হরদয়াল নাগ। বর্তমানে বেগম মসজিদের একটি অনুপম সুন্দর দালান নির্মিত হয়েছে।
লেংটার মাজার
প্রায় দেড়’শ বছর আগে কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলায় সোলায়মান নামে এক ব্যক্তি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি যৌবনে আধ্যাত্মিক সাধনায় উৎকর্ষ লাভ করেন এবং বিভিন্ন অলৌকিক ক্রিয়াকর্ম প্রদর্শন করতে শুরু করেন। সাধারণ মানুষের পোশাক পরিত্যাগ করে, সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে চলাফেরা করতে শুরু করেন। মতলব (উঃ) উপজেলার বদরপুর গ্রামে এসে নিজের আস্তানা তৈরি করেন। হতাশা, অভাব আর জীবনের ওপর আস্থা হারানো হাজার হাজার নারী-পুরুষ তাঁকে ঘিরে সোলায়মান শাহের দরগা গড়ে তোলে। সোলায়মান শাহই লেংটা ফকির নামে খ্যাত। প্রতি বছর এখানে মেলা বসে। এক বিশেষ শ্রেণীর নারী-পুরুষ এখানে প্রতি বছর নেশার মেলা বসায়।
ফরাজিকান্দি নেদায়েত ইসলাম কমপ্লেক্স
শায়খ বোরহান উদ্দিন নামে একজন পীরে কামেল মতলব (উঃ) উপজেলার ফরাজিকান্দি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৩৩ সনে ম্যাট্রিক, ১৯৩৫ সনে ইন্টারমিডিয়েট, ১৯৩৭ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ পাস করে সরকারি চাকুরি গ্রহণ করেন। বহু উচ্চপদে চাকুরি করার পর চাকুরি ছেড়ে মানুষের সেবায় নিয়োজিত হন। ১৯৪৯ সনে নিজ গ্রাম ফরাজিকান্দি উয়েসিয়া মাদ্রাসা স্থাপন করেন। পরবর্তী সময়ে এই মাদ্রাসাকে ঘিরে এক বিরাট কমপ্লেক্স গড়ে ওঠে। বর্তমানে শিক্ষা-প্রশিক্ষণ-গবেষণা, চিকিৎসা সেবা, কল্যাণধর্মী প্রতিষ্ঠান, সমবায়, ক্রীড়া, সংস্কৃতি, সমাজ সচেতনতা ও সংস্কারমূলক প্রতিষ্ঠানসহ এক বিরাট কমপ্লেক্স গড়ে ওঠেছে মেঘনার কূল ঘেঁষে ফরাজিকান্দিতে। হাজার মানুষের মিলনমেলা এই ফরাজিকান্দি কমপ্লেক্স।
তথ্যঃ ডিসি চাঁদপুর ।