সুজন দাস :
ক্রেতারা সরল বিশ্বাসে বাড়তি পুষ্টির আশায় প্রতিদিন বিভিন্ন ধরনের ফল কিনছেন। তবে বছরের পর বছর ফরমালিন মিশিয়ে এই ফলকে বিষাক্ত করে রাখা হচ্ছে। ফলে ফরমালিন দেয়া কিছুতেই বন্ধ হচ্ছে না। এখন চাঁদপুর জেলার প্রায় সব মৌসুমি ফল ও সবজিতে ফরমালিন দেয়া হচ্ছে। গত বছর স্বাস্থ্য অধিদপ্তর প্রকাশিত একটি বুলেটিনে এই চিত্র ফুটে উঠেছে। এক কথায় এখন রাসায়নিক দ্রব্য মিশ্রিত ছাড়া কোনো ফল বা তরিতরকারি বাজারে নেই।
বিষাক্ত ফল বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালত দুদফা বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা দেয়ার আদেশ দিলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খুচরা বাজার তদারক করে ফলে ফরমালিন মেশানো রোধ সম্ভব হবে না। বরং আমদানিকারকরা ফল দেশে আনার পর যে জায়গা থেকে সরবরাহ করে সেখানেই জরুরি ভিত্তিতে পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকতে হবে। বাজারের কোনটি বিষাক্ত ফল কিংবা কোনটি ফরমালিন দেয়া নয় তা বোঝার উপায় নেই। ক্রেতাদের কেউ কেউ অসুস্থ হচ্ছেন দেশী-বিদেশী এসব ফল খেয়ে। কোন দোকানির কী ফল খেয়ে অসুস্থ হচ্ছেন আমজনতা তা প্রমাণের কোনো উপায়ও নেই। জানা যায়, ফরমালিন পরীক্ষা করার সুক্ষ্ম যন্ত্রপাতি চাঁদপুর জেলা নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফরমালিন দেয়া ফল খেলে মারাত্মক রোগ হওয়ার ঝুঁকি থাকে। বিক্রেতারা ফলে ফরমালিন মেশানোর কথা অস্বীকার করেন। বাজারে আম, কলা, আপেল, আঙ্গুর, নাশপাতি, কমলালেবুতে ফরমালিন মেশানো হয়।
দেখা গেছে, দেশের বাইরে থেকে আসা বেশির ভাগ ফল ঘরে রাখলে সহজে নষ্ট হয় না বা পচে না, অনেক দিন একই রকম থাকে। ঘরে থাকলে দেশি ফল যেখানে দুই থেকে চার দিনের মধ্যে নষ্ট হয় সেখানে মাস চলে গেলেও আমদানি করা ফল নষ্ট হচ্ছে না! এর কারণ উদঘাটন করতে গিয়ে জানা যায়Ñ আঙ্গুর, আপেল, নাশপাতি, কমলালেবু ইত্যাদি আমদানি করা ফলে মেশানো হচ্ছে ফরমালিন। আর দেশে উৎপাদিত অপরিপক্ক ফল পাকাতে ব্যবহৃত হয় কার্বাইড কিংবা দেয়া হয় আগুনের তাপ। কার্বাইডে পাকানো ফলে আসল স্বাদ যেমন পাওয়া যায় না তেমন উপকারের বদলে উল্টো দেখা দেয় রোগব্যাধি।
জানা যায়, ফরমালিন আর্সেনিকের চেয়েও ক্ষতিকারক। এতে লিভারের সমস্যাসহ ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি থাকে। এছাড়া আগুনের তাপ বা কার্বাইড দিয়ে পাকানো ফলের পুষ্টি উপাদান নষ্ট হয় এবং ফুড ভ্যালু থাকে না। ফরমালিন হচ্ছে এক ধরনের জৈব এসিড। এই এসিড মানবদেহে বড় ধরনের ক্ষতি করে।
হাজীগঞ্জের এক ফলের আড়তের মালিক জানান, দেশে বেশির ভাগ ফল আসে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, আফ্রিকা, নিউজিল্যান্ড, ব্রাজিল, পাকিস্তান, ভারত ও মিসর থেকে। এসব দেশ থেকে কন্টেইনারে করে সাগর ও নদীপথে তা আনা হয় চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরে। সেখান থেকে ঢাকার মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন এলাকায় নেয়া হয়। দেশের বাইরে থেকে আসা ফল সাধারণ মানুষের কাছে যেতে দেড় থেকে দুই মাস সময় দরকার হয়। আর আমেরিকা থেকে ফল আনতে সবচেয় বেশি সময় লাগে। সেখানে জাহাজে বোঝাই করার পর দেশে আসতে সময় লাগে ৪৫ দিন। কন্টেইনারে আনার কারণে তখন এগুলোতে কিছু দেয়ার প্রয়োজন হয় না। কন্টেইনারে সাজানোর পর তা ঠা- রাখার ব্যবস্থা করা হয়। কন্টেইনারে আলো-বাতাস প্রবেশ করতে পারে না। তাই ফরমালিন দেয়ার প্রয়োজন হয় না। কন্টেইনার থেকে বের করে খোলা অবস্থায় রাখলে এসব ফল ২ থেকে ৩ দিনের বেশি থাকে না। যে কারণে অনেক সময় ফরমালিন মিশ্রিত পানির মধ্যে চুবিয়ে কার্টনে ভরে তা বাজারজাত করতে হয়।
আমদানিকারক বা পাইকারি ব্যবসায়ীদের ফল আমদানির দু-একদিনের মধ্যে বিক্রি হয়ে যায়। তবে খুচরা বিক্রেতাদের বিক্রি করতে দেরি হলে তারা ফরমালিন দিতে পারেন।
২০১০ সালের ১১ মে ফলে রাসায়নিক দ্রব্য মেশানোর সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে বিশেষ ক্ষমতা আইন-১৯৭৪ এর অধীনে মামলা দায়েরের নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। পাশাপাশি রাসায়নিকযুক্ত ফল বিক্রি বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে সরকারের সংশ্লিষ্টদের আদালত কয়েক দফা নির্দেশনা দেন।
খাদ্য ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানান, মহাখালী ফুড টেস্টিং ল্যাবরেটরিতে শুধু খাদ্যপণ্য পরীক্ষা করা হলেও বর্তমানে চাঁদপুর সহ সারা দেশে খাবার ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের ফলমূল আম, আপেল, আনারস, কাঁঠাল, কমলা, কলা, আঙ্গুর, তরমুজ, ডালিম ও আতায় বিষাক্ত কেমিক্যাল ও ডাইং কালার মিশিয়ে কৃত্রিম উপায়ে পাকানো হচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি, টম্যাটো, গাজর, লাউ, কচু, ফুলকপি, ঢেঁড়স, মুলা এমনকি শালগমেও কেমিক্যাল মেশানো হচ্ছে। মাছ তাজা রাখতে ফরমালিন দেয়া হচ্ছে। আজকাল মসলাতেও ভেজাল দেয়া হচ্ছে। ভেজাল পরীক্ষার জন্য সুনির্দিষ্টভাবে একদিকে কোনো ল্যাবরেটরি এখনো গড়ে ওঠেনি, তেমনি মনিটরিং করার জন্য নিয়মিত ও শক্তিশালী কোনো সংস্থাও নেই।