মিজান লিটন-
জুন থেকে অক্টোবর এই পাঁচ মাস ইলিশের মৌসুম। প্রথম তিন মাসে নদ-নদী ও সাগরে ইলিশের তেমন দেখা না মিললেও ভরা মৌসুমের শেষ ভাগে সমুদ্র উপকূলীয় এলাকায় এবার ইলিশের বান পড়েছে। জেলেদের জালে প্রতিদিনই ধরা পড়ছে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ। সেই ইলিশের চাপে আবারও সরগরম হয়ে উঠেছে চাঁদপুর মাছ ঘাট। রূপালী ইলিশের রাজধানী চাঁদপুর এ কথার যথার্থ প্রমাণ মিলছে ঘাটে ইলিশের ছড়াছড়ি দেখে। প্রতিদিনই গড়ে আড়াই থেকে তিন হাজার মণ ইলিশ ঘাটে ক্রয়-বিক্রয় হচ্ছে। এমন তথ্য জানায় এখানকার মৎস্য আড়তদাররা। গতকাল রোববার ঘাটে প্রচুর ইলিশের আমদানি চোখে পড়ে। আগের দিন মাছের চাপ কিছুটা কম ছিলো। শুক্রবারও ঘাটে প্রচুর ইলিশের দেখা মিলে। দামও অনেক কম।
সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ছোট বড় মিলিয়ে প্রতিটি আড়তে ইলিশ আর ইলিশ। বিক্রি হচ্ছে ১২ হাজার টাকা থেকে ১৪ হাজার টাকা মণ ৪শ’ থেকে ৫শ’ গ্রাম ওজনের ইলিশ। ৬শ’, ৭শ’ ও ৮শ’ গ্রাম ওজনের ইলিশের মণ ১৫ থেকে ১৬ হাজার টাকা। ৯শ’ গ্রাম বা ১ কেজি ওজনের প্রতি মণ ইলিশ ১৮ হাজার থেকে সাড়ে ১৮ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। লোকাল নদীর তাজা ইলিশ থাকলে তার দাম একটু বেশি। চাঁদপুর মাছ ঘাটের প্রবীণ মৎস্য আড়তদার হাজী সিরাজ চোকদার (৭০) জানান, গত ১ মাস যাবৎ ইলিশের আমদানি আল্লাহ দান করায় ভালোই যাচ্ছে। আড়তদার মেজবাহ মাল (৪৫) জানান, লোকাল নদীর মাছ খুবই কম। ঘাটে যা ইলিশ দেখছেন, সবই নামার মাছ। তরুণ মৎস্য ব্যবসায়ী ও আড়তদার মানিক জমাদার (৩৫) জানান, এবার সিজনের শেষ দিকে ইলিশ আমদানি বেড়েছে। দামও কম থাকায় এখন অনেকে ইলিশ কিনে খেতে পারছে।
চাঁদপুর মাছ ঘাটে প্রচুর ইলিশের আমদানি হওয়ায় সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলছে জমজমাট মাছ ক্রয়-বিক্রয় এবং প্রক্রিয়াজাতকরণের কাজ। বিশ্রাম নেয়া দূরে থাক দুপুরে খাওয়ার সময়টুকু পাচ্ছে না সবাই। অবিরাম চলছে বরফ ভাঙ্গার কাজ। পুরো ঘাট জুড়েই শুধু ইলিশের বিকিকিনি চোখে পড়ছে। সবাই ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করছে। আড়তদার ও মৎস্য ব্যবসায়ীরা জানান, লোকাল নদীতে এবং উপকূলীয় এলাকায় ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ ধরা পড়ায় জেলেদের আহরিত সেই ইলিশ বিভিন্নভাবে ভালো দামের আশায় চাঁদপুর নিয়ে আসায় মাছের চাপ কয়েকগুণ বেড়ে যায়। লবণ ইলিশ দেশের বিভিন্ন এলাকায় চাহিদা থাকায় সেখানে সরবরাহ কাজ গত এক সপ্তাহ যাবৎ শুরু হয়েছে। এবার চাঁদপুরে ব্যাপক ইলিশ আসায় এখানকার ছোট বড় মৎস্য আড়তদার, ব্যবসায়ী ও মাছ সরবরাহকারী প্রত্যেকে বেশ লাভের মুখ দেখতে পেয়েছে। শত শত লেবার ইলিশ লোডিং আনলোডিং কাজ দিন রাত করতে পারায় তারাও বেজায় খুশি।
চাঁদপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা রতন দত্ত জানান, গত বছর প্রজনন মৌসুমে মা ইলিশসহ এবার জাটকা আশানুরূপ রক্ষা পাওয়ায় এর সুফল অর্থাৎ এ সিজনে ইলিশের বাম্পার উৎপাদন হয়েছে। লোকাল নদীতে ইলিশ না পাওয়ার কারণ হিসেবে তার মতে নদী অগভীর হয়ে পড়ায় এবং বুড়িগঙ্গাসহ আশপাশের নদী দূষণের প্রভাব চাঁদপুর মেঘনা অববাহিকায় পড়েছে। তাই মোট আহরিত ইলিশের ১০-১৫ ভাগ লোকালে এবং সিংহ ভাগ ইলিশ উপকূলীয় অঞ্চলের। চাঁদপুর মৎস্য বণিক সমবায় সমিতি লিঃ-এর সাধারণ সম্পাদক ইদ্রিছ আলী গাজী জনান, পূর্ণিমা আসার পূর্ব মুহূর্তে এখন অমাবস্যা জো’র এই সময় প্রচুর ইলিশের দেখা মিলে। যার অধিকাংশ মাছের পেটে ডিম রয়েছে। ডিমওয়ালা ইলিশ পুরোপুরি রক্ষা করতে হলে ১০ দিনের অভিযান না দিয়ে তাতে ১ মাস করা হলে মাছের উৎপাদন বহু গুণে বৃদ্ধি পাবে। এদিকে জেলা মৎস্য বিভাগ সূত্রে জানা যায়, পূর্ণিমার ৫দিন আগে ও ৫দিন পরে এবং পূর্ণিমার ১দিন মোট ১১দিন মা ইলিশ ডিম ছাড়ার জন্য সাগর থেকে নদ-নদীর প্রজনন ক্ষেত্র সমূহে বিচরণ করে। এই সময়েই মা ইলিশ ডিম ছাড়ে। সেই প্রজনন এলাকার মা ইলিশ রক্ষার জন্য সরকারের মৎস্য বিভাগ অন্যান্য বছরের ন্যায় এবারও অক্টোবর মাসের ১১দিন চিহ্নিত চারটি প্রধান প্রজনন ৰেত্রের ৬৮৮২ বর্গ কিঃ মিঃ নদী এলাকাসহ দেশের সকল নদ-নদীতে ইলিশ আহরণ, পরিবহন, মজুদ, বাজারজাতকরণ অথবা বিক্রি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। মা ইলিশ রৰায় এবারের অভিযানের সময় হচ্ছে ১৩ অক্টোবর থেকে ২৩ অক্টোবর পর্যন্ত। ইলিশ সংশ্লিষ্ট মৎস্য ব্যবসায়ীদের মতে এ অভিযান ১৩ দিন না রেখে অমাবস্যা-পূর্ণিমার ১ মাস সময় নির্ধারণ করা হলে এখন যেই পরিমাণ ডিমওয়ালা ইলিশ ধরা পড়ছে তা থেকে ডিম আরো বেশি রক্ষা পেতো এবং বর্তমানের চেয়েও আরো দ্বিগুণ ইলিশ উৎপাদন হতো।