চাঁদপুর লঞ্চঘাটে ঘাট শ্রমিকদের নৈরাজ্য ও চাঁদাবাজি এখনো অব্যাহত আছে। শুধু অব্যাহতই নয়, দিন দিন বেড়েই চলছে তাদের নৈরাজ্য। টোলের নামে অবৈধ চাঁদার শিকার হচ্ছে লঞ্চযাত্রী অনেকেই। তাও একবার নয়, দু’বার। অর্থাৎ সদরঘাট থেকে লঞ্চে উঠার সময় একবার, আবার চাঁদপুর ঘাটে নামার সময় একবার। হাতে যে কোনো ব্যাগ থাকলেই হয়, ঘাট শ্রমিকদের চাঁদা দিতেই হবে। তাও আবার এরা বিআইডব্লিউটিএর ঘাট শ্রমিক। তাদের নির্ধারিত পোশাকে লেখা আছে ‘বিআইডব্লিউটিএ ঘাট শ্রমিক’।
চাঁদপুর লঞ্চঘাটে সিএনজি অটোরিকশা চালকদের কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনা হলেও ঘাট শ্রমিকদের দৌরাত্ম্য বেড়ে গেছে। তাদের দৌরাত্ম্য এখন অনেকটা সীমা ছাড়িয়ে গেছে। যদিও কিছুদিন আরো চাঁদপুর বিআইডব্লিউটিএ কর্মকর্তা এ বিষয়টি দেখবেন বলে এ প্রতিবেদককে জানিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবে এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষের কোনো ভূমিকাই দেখা যাচ্ছে না। লঞ্চ যাত্রীরা এই ঘাট শ্রমিকদের দ্বারা চরমভাবে নিগৃহীত হচ্ছে। সবচেয়ে অবাক করার বিষয় হচ্ছে, এই ঘাট শ্রমিকদের গায়ের পোশাকে লেখা ‘বিআইডব্লিউটিএ ঘাট শ্রমিক’। অর্থাৎ এরা বিআইডব্লিউটিএ’র শ্রমিক, তাই বুঝা যাচ্ছে। অথচ সরকারি এ প্রতিষ্ঠানটির শ্রমিকদের দ্বারাই যাত্রীরা হয়রানির শিকার হলেও কর্তৃপক্ষের যেনো কিছুই যায় আসে না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে খোদ বিআইডব্লিউটিএ’র লোকজনের আশ্রয়-প্রশ্রয়েই ঘাটে এই শ্রমিকরা এক ধরনের চাঁদাবাজি করছে এবং চরম নৈরাজ্য চালাচ্ছে।
চাঁদপুর লঞ্চঘাটটি এখন দিনরাত ২৪ ঘণ্টাই হাজার হাজার মানুষের পদচারণায় মুখরিত থাকে। ঢাকা-চাঁদপুর-নারায়ণগঞ্জ ছাড়াও দক্ষিণাঞ্চল নৌরূটে প্রতিদিন চাঁদপুর লঞ্চঘাট থেকে অর্ধ শতাধিক লঞ্চ আসা-যাওয়া করে থাকে। তাই প্রতিদিন হাজার হাজার যাত্রী চাঁদপুর লঞ্চঘাট হয়ে যাতায়াত করে থাকে। এদিকে ঘাট সরকারি নিয়ম অনুযায়ী ইজারা দেয়া হয়। সে মোতাবেক যাত্রীদের প্রতিবার ঘাটে প্রবেশ করতে হলে নির্ধারিত প্রবেশ ফি দিয়ে টিকিট কেটে নিতে হয়। এর বাইরে মালামাল ঘাটে প্রবেশ করতে হলে ঘাটের ইজারা অনুযায়ী নির্ধারিত মূল্য দিতে হবে। সে তালিকা ঘাটের ভেতরে প্রকাশ্যে সাঁটানো আছে। কতটুকু ওজনের মালামালের জন্যে কত টাকা তার মূল্য তালিকাও প্রকাশ্যে দেয়া আছে। সেখানে সর্বনি¤œ কত ওজনের মালের জন্য ইজারার টাকা দিতে হবে তাও উল্লেখ রয়েছে। নিয়ম হচ্ছে এই মালামালের জন্যে যাত্রীকে ঘাটের ইজারার রসিদও দিতে হবে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এই নিয়মের ধারে-কাছেও নেই ইজারাদার এবং ঘাট শ্রমিকরা। যে যেভাবে পারছে জুলুম করছে যাত্রীদের উপর। দেখা গেছে যে, যাত্রী নিজেই তার কাঁধে ঝুলিয়ে অথবা নিজেই হাতে বহন করে ব্যাগ নিয়ে লঞ্চে উঠছে অথবা লঞ্চ থেকে নামছে, আর তখনি ওই বিআইডব্লিউটিএ’র কুলি অর্থাৎ ঘাট শ্রমিকরা এসে ওই যাত্রীর ব্যাগ নিয়ে টানাটানি করছে। তার দাবি, ঘাটের টাকা দিতে হবে। তাও ২০/৩০ টাকা নয়, ২শ’ থেকে তিন শ’ টাকা। অথচ এই ব্যাগ বা মাল ঘাট ইজারার জন্যে নির্ধারিত ওজনের মধ্যে পড়ে না। যাত্রী নিজেই তা বহন করে নিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু তাতেও ঘাট শ্রমিককে টাকা দিতে হবে। এ নিয়ে প্রতিনিয়ত যাত্রীদের সাথে ঘাট শ্রমিকদের ঝগড়া, হাতাহাতি ও মারামারির ঘটনা ঘটছে। বিআইডব্লিউটিএ’র নির্ধারিত পোশাক পরা ৮/১০ জন শ্রমিক সবসময় ঘাটে থাকে। তারা সম্মিলিতভাবে যাত্রীদের নাজেহাল ও হয়রানি করে থাকে। কি পুরুষ কি নারী যাত্রী, কোনো কিছুতেই তাদের বাছবিচার নেই। আরো একটি বিষয় হচ্ছে, যে মালের ঘাট ইজারার টাকা লঞ্চে উঠার সময় একবার দিয়ে আসলো, সে একই মালের জন্যে টাকা দ্বিতীয়বার আবার লঞ্চ থেকে নামার সময় দিতে হয়। এ যেনো এক মুরগীকে দুইবার জবাই করার মতো।
ঘাট শ্রমিকদের এই নৈরাজ্য, চাঁদাবাজি, যাত্রী হয়রানি বিআইডব্লিউটিএ’র কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ ঘাট সংশ্লিষ্ট সকলের সামনে ঘটলেও কেহই কিছুই বলছে না। অথচ সাথেই রয়েছে নৌ পুলিশ ফাঁড়ি এবং বিআইডব্লিউটিএ’র স্থানীয় অফিস।
এ বিষয়ে সম্প্রতি চাঁদপুর বিআইডব্লিউটিএ’র বন্দর কর্মকর্তা আবদুর রাজ্জাকের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, ‘বিআইডব্লিউটিএ একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান। এর কোনো নির্ধারিত শ্রমিক নেই। তাহলে লঞ্চঘাটে যারা পোশাক পরিহিত তাদের বুক পকেটে লেখা রয়েছে ‘বিআইডব্লিউটিএ ঘাট শ্রমিক’ এরা কারা? এর জবাবে তিনি বলেন, এরা ইজারাদার কর্তৃক নিয়োগকৃত শ্রমিক। এরা কি তাহলে একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করতে পারে? এমন প্রশ্নের জবাবে বন্দর কর্মকর্তা হ্যাঁ-না কোনো কিছুই সরাসরি বলেন নি। তার কাছে জানতে চাওয়া হয় সর্বনিম্ন কতটুকু ওজনের মালামালের জন্যে ঘাটে টাকা দিতে হয়। জবাবে তিনি জানান, যাত্রী নিজে বহন করতে পারে এমন মালামালের জন্যে ঘাটের কোনো মূল্য বা ইজারার টাকা দিতে হয় না। আর একটি ঘাটে একবার টাকা দেয়ার পর নামার সময় পুনরায় টাকা দিতে হবে না, যদি না তা লেবার দ্বারা বহন করতে না হয়’। অথচ বন্দর কর্মকর্তার এসব বিবরণের সবই উল্টো দেখা যায় বাস্তবে। টোল আদায়ের কোনো রসিদ দেয়া হয় না। সামান্য পান-সিগারেট বিক্রেতার কাছ থেকেও লঞ্চ থেকে নামার পর ওই ঘাট শ্রমিকদের টাকা নিতে দেখা গেছে।
চাঁদপুর লঞ্চঘাটে শ্রমিকদের নৈরাজ্যের বিষয়টি দেখবেন বলে বন্দর কর্মকর্তা এ প্রদিবেদককে ইতিপূর্বে বললেও তার কোনো কার্যকারিতা দেখা যাচ্ছে না।