স্টাফ রিপোর্টার:
‘পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কিরে হায়/ও সেই চোখের দেখা, প্রাণের কথা; সে কি ভোলা যায়?/আয়, আরেকটিবার আয় রে সখা, প্রাণের মাঝে আয়/ মোরা সুখের-দুঃখের কথা কব, প্রাণ জুড়াবে তায়।/ মোরা ভোরের বেলায় ফুল তুলেছি, দুলেছি দোলায়/বাজিয়ে বাঁশি গান গেয়েছি বকুলের তলায়/ তার মাঝে হল ছাড়াছাড়ি, গেলেম কে কোথায়/ আবার দেখা যদি হল, সখা, প্রাণের মাঝে আয়।’-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
শুক্রবার সকাল নটা। চাঁদপুর সরকারি মহিলা কলেজ রোডটি অন্যদিনের মতো নয়, অনেকখানি ভিন্নতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আজ। নানা বয়সী নারীরা হাঁটছে। কারো পরনে লাল শাড়ি, কারো পরনে থ্রিপিচ। সবার মুখে হাসি। সবাই যেন কোথাও যাচ্ছে। তাদের পিছু পিছু কলেজ গেটের সামনে এসে দাঁড়ালে ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়। কলেজ গেটে বিশাল লাল তোরণ করা হয়েছে। সাঁটানো হয়েছে ব্যানার। আজ চাঁদপুর সরকারি মহিলা কলেজ (চাঁসমক)-এর ৫০ বছর পূর্তি ও প্রাক্তন ছাত্রী পুনর্মিলনী উৎসব উদ্্যাপিত হবে। এ কারণেই এ সড়কে আজ মানুষজনের পদচারণা খুব বেশি।
লাল তোরণ দিয়েই নানা বয়সী নারীরা ঢুকে পড়ছে কলেজ ক্যাম্পাসে, কেউ আবার খানিক প্রয়োজনে বের হচ্ছে। ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে আরো বিস্মিত হতে হয়। সবখানে সাজ সাজ রব। কলেজ মাঠ জুড়ে প্যান্ডেল করা হয়েছে। চারদিকে লাল নীল হলুদ বেগুনী রঙের বেলুন। চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে নারীরা আড্ডা দিচ্ছে। কেউ হাসছে। কেউ গল্প করছে। কারো কারো মাথায় ফুলের মুকুট। লাল গোলাপসহ আরো নানা রকমের ফুল। এদের কেউ সচিব, কেউ চিকিৎসক, কেউ উকিল, কেউ কাজ করেন ব্যাংকে। কেউ বা শিক্ষক। কিন্তু এ অনুষ্ঠানে তাদের বড় পরিচয় হলো এরা সবাই এ কলেজের ছাত্রী। যারা ৪ যুগ আগে এ কলেজ থেকে পাস করে গেছেন, তারা এই পুনর্মিলনীতে এসেছেন সন্তানদেরকে নিয়ে, কেউ এসেছেন নাতি-নাতনি নিয়ে। আবার ক’বছর আগেও যারা পড়ে গেছেন এ কলেজে, তারাও এসেছেন দল বেঁধে। নবীন প্রবীণের মিলন মেলায় মেতে উঠেছেন সবাই। অনেককেই দেখা যায় দল বেঁধে নাচ-গান করতে। কেউ কেউ ব্যস্ত ছিলেন ছবি তোলায়। অল্প বয়সীদের সাজ ছিলো চোখে পড়ার মতো।
কোনো সহপাঠীর সাথে হয়তো বহু বছর পর আরেক সহপাঠীর দেখা। তারা কোলাকুলি করছেন একে অপরকে। হাত ধরে আছেন। তাদের চোখ বলে দিচ্ছে তারা স্মৃতির ভেলায় ভেসে যাচ্ছেন পুরানো সেই দিনগুলোতে, সেই ক্লাসরুমে, কলেজ ক্যাম্পাসের আড্ডায়…
চাঁদপুর সরকারি মহিলা কলেজের ৫০ বছর পূর্তর্ি ও প্রাক্তন ছাত্রী পুনর্মিলনী উৎসব-২০১৬ উদ্যাপন উপলক্ষে ছিলো দিনব্যাপী বর্ণাঢ্য আয়োজন। গতকাল শুক্রবার সকালে বর্ণাঢ্য র্যালী, দুপুরে আলোচনা সভা, বিকেলে আড্ডা ও স্মৃতিচারণ এবং সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক পরিবেশনার মধ্য দিয়ে এ অনুষ্ঠান শেষ হয়। দিনব্যাপী এ অনুষ্ঠানে চাঁদপুর সরকারি মহিলা কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থীবৃন্দ, শিক্ষকবৃন্দ ও সুধী মহলের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন, পতাকা উত্তোলন, শান্তির প্রতীক পায়রা উড়িয়ে অনুষ্ঠানের শুভ উদ্বোধন করেন কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও শিক্ষক এবং চাঁদপুর সরকারি কলেজের অবসরপ্রাপ্ত উপাধ্যক্ষ প্রফেসর শামছুন নাহার।
পরে বেলা ১২ টায় চাঁসমক অধ্যক্ষ প্রফেসর এম এ মতিন মিয়ার সভাপ্রধানে এবং ৫০ বছর পূর্তর্ি ও প্রাক্তন ছাত্রী পুনর্মিলনী উৎসব-২০১৬-এর সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ শাহিন সুলতানা ফেন্সির সঞ্চালনায় আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও চাঁদপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য ডাঃ দীপু মনি।
তিনি তাঁর বক্তৃতাকালে বলেন, পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে কলেজ জীবনের স্মৃতি এসে সবার মনে ভিড় করে। আজ তেমনি একটি অনুষ্ঠান, অন্যরকম একটি দিন। এ কলেজের কোনো উৎসব হলে আমার বেশ ভালো লাগে। মানুষ সব কিছুর মধ্যে একটা যোগসূত্র খুঁজে পায়। আমিও খুঁজে পেয়েছি। এই কলেজটিকে আমার কাছে আপন একটি প্রতিষ্ঠান বলে মনে হয়।
তিনি আরো বলেন, বেগম রোকেয়া নারীদের যে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন সেই স্বপ্ন এখন সরকার বাস্তবায়ন করছে। আমাদের নারীরা সব সঙ্কটে সামনে থেকে কাজ করেছিলো। সেই ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত সব সংগ্রামেই নারীরা এগিয়ে এসেছে। আজকের নারীরা সব ক্ষেত্রেই কাজ করছে। এমন ক্ষেত্র খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে কাজ করার উপযুক্ত নারী নয়। নারীর অগ্রযাত্রার সাথে সাথে দেশেরও নতুন অগ্রযাত্রা হয়েছে। আমাদের ফলাফল আরো ভালো করার জন্যে পরিশ্রম করতে হবে। এ কলেজের উন্নয়নে যা যা করার প্রয়োজন হবে, আমি তাই করবো। কোনো প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে নিতে হলে সবারই অংশগ্রহণ প্রয়োজন। তিনি বিত্তশালী, উদারমনাদের সমাজের কল্যাণে, জেলার ভালো কাজে অংশগ্রহণ করতে এগিয়ে আসতে উদাত্ত আহ্বান জানান।
বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মন্ত্রী পরিষদের অতিরিক্ত সচিব মাকসুদুর রহমান পাটোয়ারী, যুগ্ম সচিব নাছিমা আক্তার, চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক মোঃ আব্দুস সবুর মন্ডল, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান, চাঁদপুর পৌরসভার মেয়র নাছির উদ্দিন আহামেদ, চাঁদপুর চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি সুভাষ চন্দ্র রায়, স্বাধীনতা পদক প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা ডাঃ সৈয়দা বদরুন নাহার চৌধুরী, চাঁদপুর সরকারি মহিলা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর মোঃ মনোহর আলী ও জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডঃ মোঃ জহিরুল ইসলাম।
অন্যান্যের মাঝে উপস্থিত ছিলেন চাঁদপুর সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর ড. এ এস এম দেলওয়ার হোসেন, চাঁদপুর সদরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উদয়ন দেওয়ান, জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক তাফাজ্জল হোসেন এসডু পাটওয়ারী, শামসুল হক মন্টু পাটওয়ারী, মজিবুর রহমান ভূঁইয়া, চাঁসমক উপাধ্যক্ষ মোঃ মাসুদুর রহমান, পুরাণবাজার ডিগ্রি কলেজের উপাধ্যক্ষ রতন কুমার মজুমদার, ডাঃ এসএম সহিদ উল্লাহ, চাঁদপুর প্রেসক্লাবের নবনির্বাচিত সভাপতি বিএম হান্নান, সাবেক সভাপতি শহীদ পাটোয়ারী, সাধারণ সম্পাদক রহিম বাদশা, বাবুরহাট হাই স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ মোঃ মোশারফ হোসেন, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি তপন সরকার, চাঁদপুর পৌরসভার সাবেক প্যানেল মেয়র লায়লা হাসান, মোহসিনা বেগম প্রমুখ।
আলোচনা সভার শুরুতেই পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত করেন ৫০ বছর পূর্তর্ি ও প্রাক্তন ছাত্রী পুনর্মিলনী উৎসব-২০১৬ কমিটির সহ-সভাপতি আয়েশা রহমান লিলি, গীতা পাঠ করেন নিবন্ধন উপ-কমিটির আহ্বায়ক মিঠু রাণী দে। শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন চাঁসমক অধ্যক্ষ এম এ মতিন মিয়া। অনুষ্ঠানে এ কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ, ছাত্রী সংসদের প্রাক্তন ভিপি, জিএসসহ চাঁদপুরের বিশিষ্টজনকে সংবর্ধনা দেয়া হয়। এ পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে যারা এসেছিলেন তাদের সবারই বক্তব্য ছিলো : এমন সম্পর্কের বন্ধন অটুট থাক, পাশাপাশি এগিয়ে যাক তাদের এই প্রিয় বিদ্যাপীঠ।
উল্লেখ্য, চাঁদপুর সরকারি কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৯৬৪ সালে। বর্তমানে এ কলেজে ইন্টারমিডিয়েট, অনার্স ও ডিগ্রি শাখায় ২ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছে।